স্থান: আমিনার কক্ষ।
আমিনা: আসো বড় আপা। আপনি তো আজকাল এই পানে আসেন না। আপনি তো ঈদের চাঁদ হয়ে গেছেন। কিছু সংবাদ আছে?
ঘসেটি: তোমার সুখ মাপতে এলাম রাজমাতা। দেখতে এলাম তোমার ভরা সংসার। নবাব পুত্র, নবাব বেগম পুত্রবধূ। আমার অবস্থা তো আজকাল দাসী-বান্দির মত। এককোণে পড়ে থাকি।
আমিনা: আপা, সিরাজ কি আপনারও পুত্র না? সিরাজকে সেই ছোট থেকেই এত আদর দিয়েছন আপনি। আমার শাহজাদী পৌত্রী তো আপনারও নাতনী।
ঘসেটি: আমি আলীবর্দী খানের জ্যেষ্ঠ কন্যা মেহেরুন্নেসা। আমার সন্তান থাকলে সে এই মসনদে থাকত। আমার ইকরাম আজ বেঁচে থাকলে আমিই হতাম রাজমাতা। আমাকে আজ এইভাবে প্রাসাদে অবরুদ্ধ হতে হত না।
লুৎফা: খালাম্মা ছোট মুখে বড় কথা বলার জন্য মাফি। আপনাকে কিন্তু আমরা সবাই মায়ের মত ভালোবাসি। শ্রদ্ধা করি। আপনি কিভাবে পারিবারিক সম্পর্কের বন্ধন অগ্রাহ্য করেন?
ঘসেটি: তোমাদের সুখের দোয়া আমি কখনোই করিনা। তোমাদের সৌভাগ্য আমার অভিশাপ ছাড়া কিছুই নয়।
আমিনা: ছি: একি বলছেন আপনি। পুত্রবধূর সামনে এরকম আচরণ করবেন না আপনি।
ঘসেটি: কে পুত্র আর কেই বা পুত্রবধূ? যে পুত্র আমার সুখ, আমার শান্তি সব কেড়েছে, তাকে আমি মানিনা। যদি জানতাম আমার ইচ্ছার কোনো দাম থাকবে না, শিশুকালেই সিরাজকে মেরে ফেলতে কিছুমাত্র হাত কাঁপতো না।
আমিনা: কি বলেন, কি বলেন আপনি! আপনার আক্রোশের কারণ আমরা সবই বুঝি। আপনি চাইতেন যাতে মায়মুনা আপার পুত্র শওকত জং হোক বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব। শওকত একটা মদ্যপ। আর আপনি কিনা ওকে চাইতেন নবাব করতে? আপনি খুব ভালোভাবেই জানতেন এতে আপনার লক্ষ্যপূরণ হবে। আপনি সহজেই প্রভাব বিস্তার করবেন।
ঘসেটি: আমাকে নিয়ে এতকিছু কল্পনা করো কিকরে? আমি একজন সামান্য রমণী। এসব রাজনীতির কুটিল পরিমণ্ডল থেকে দূরে থাকি। স্বামী-পুত্র সুখ আমার কপালে আল্লাহ্ দেন নি। আমি সামান্য বিত্তের অধিকারিণী হয়ে এক কোণে কোনরকমে দিনযাপন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মহাপরাক্রমশালী নবাব আমায় সেই অধিকারটুকুও দিলেন না।
আমিনা: সিরাজ তো আপনার কোনো ক্ষতি করেনি বড় আপা।
ঘসেটি: তার নবাব হওয়াই কি আমার মস্ত ক্ষতি নয়! সে এখন রাজা, আমি নগণ্য প্রজা মাত্র। সে আমায় তাড়িয়ে দিয়েছে মতিঝিল থেকে। আব্বাজান থাকলে আমার এই অপমান কোনোদিন হতো না। এখন নবাব কবে জানটুকু নেবে তার দিন গুনছি।
লুৎফা: খালা আম্মা ছি: ছি:। আপনি এসব ভাবেন কীকরে। তিনি নবাবী পেয়েছেন ভূতপূর্ব নবাবের থেকে। যোগ্যতা বুঝেই সিংহাসন দিয়েছেন।
ঘসেটি: একদম চুপ করো। সিরাজ তাও আমার বোনপো। কিন্তু তোমার বড়ো বড়ো কথা শুনলে গা জ্বলে যায়।
আমিনা: আপনি অনর্থক তর্ক করছেন।
ঘসেটি: বৃদ্ধ নবাবের থেকে ছল চাতুরী করে তোমরা নবাবী আদায় করেছ। আমি বুঝিনা ভেবেছো!
আমিনা: আপনাকে যথেষ্ট সম্মান করেই বলছি, আমি বীরের মাতা। তাকে কোনোকালেই ছলনা শেখাই নি আমি। তবে এও ঠিক সে একদিন ও শান্তিতে নবাবী করেনি। তার আশপাশে তার অনুগতরাই বিশ্বাসঘাতক হয়ে উঠেছে। আমরা কি সেসব খোঁজ পাইনা? কেবল পরিবারের সদস্যের দুর্নামের হাত থেকে রক্ষা করতে চায় সিরাজ।
ঘসেটি: রাখো তোমার বুলি। তোমাদের এই চোখ রাঙানি কতদিন থাকবে আমিও দেখব।
আমিনা: নবাবের মাতৃস্থানীয়া হয়ে দুশমন পক্ষের সাথে যোগাযোগ রাখাকে আমরা কি হিসেবে দেখব? রাজনৈতিক প্রাধান্য লাভের উচ্চাশায় আপনি অমানবিক আচরণ করবেন?
ঘসেটি: আমার সম্পত্তি রক্ষা করতে আমি কার সাথে কথা বলবো, কি করবো তা কি নবাবের অনুমতিতে করতে হবে এখন থেকে?
আমিনা: এইতো সিরাজ এসেছে। বা’জান বড় আপা কিছু ভুল বুঝছেন। ওনাকে একটু বুঝিয়ে বলো তুমি।
সিরাজ: আপনি জানেন খালা আপনি কি করছেন। আমাকে ক্ষমতাচ্যুত করবার ষড়জন্ত্রে আপনি ইন্ধন যুগিয়েছেন এও আমার অজানা নয়। ক্ষমতার লোভে আপনি নিজ পরিবারের ক্ষতি করবেন না।
ঘসেটি: তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? (মুখ রাগে রাঙা হয়ে উঠেছে)
সিরাজ: সতর্ক করেছি মাত্র। আপনার গতিবিধির ওপর লক্ষণ রাখার ব্যবস্থা করেছি আমি। আপনি আমায় কোলে পিঠে মানুষ করেছেন, ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে আপনার দুর্নাম না করে তার ব্যবস্থা।
ঘসেটি: নবাব! তুমি আমায় বন্দী করলে? তুমি এত নীচ? কেয়ামতের দিন তোমার সব পাপের হিসেবের খাতায় এই পাপ সবার উপর থাকবে।
সিরাজ: আপনার স্বাধীনতা অটুট থাকবে। আপনি কেবল প্রাসাদ ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেন না।
ঘসেটি: (হাততালি দিয়ে) শুনলে রাজমাতা? শুনলে? তোমার গুণধর পুত্র তার মাতৃস্থানীয়াকে বন্দী করছে। তুমি এখনও চুপ করে থাকবে?( হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন কক্ষ থেকে)
আমিনা: আপা যাবেন না, শুনুন আপা! আমার কথাটা শুনুন একবার।
লুৎফা: খালাম্মা শুনুন, শুনে যান। এভাবে যাবেন না।
পর্ব ২:
স্থান: সিরাজের শয়নকক্ষ।
আমিনা: লুৎফা বেটি তুমি সিরাজকে বোঝাও। বড় আপার অনেক তৌহিন হয়েছে। এভাবে ওঁকে ক্যায়াদ করা ঠিক হচ্ছে কি?
সিরাজ: আম্মি তুমিও আমাকে ভুল বুঝলে? তুমি কি জানো না সবাই আমার কিরকম বিরুদ্ধাচরণ করছেন? আমার পরিবারের সবাই আমার মসনদে বসা প্রথমদিন থেকেই ভালো চোখে দেখেননি।
লুৎফা: কিন্তু জাহাঁপনা উনি নিঃসন্তান, বিধবা মহিলা। আপনার মায়ের মতন। আর একবার সুযোগ দেওয়া যেত না?
সিরাজ: লুৎফা তোমার কি আমার ওপর ভরসা নেই? তুমিও এরূপ বলবে আমি কল্পনাও করিনি। নানাজী আমাকে যোগ্যতা বুঝেই নবাব বানিয়েছেন তাহলে সবাই তাঁর কথা অস্বীকার করে কোন হিসাবে?
আমিনা: বড় আপা হোসেন কুলি খাঁ-র মৌত মেনে নিতে পারেননি।
সিরাজ: সবই আমি নানাজীর মতামতে করেছি। আমি স্বাধীনভাবে এই কাজ কখনোই করিনি সেটা খালাকে বুঝতে হবে।
আমিনা: বেশ। তোমরা কথা বলো। রাত হয়েছে। আমি শুতে যাচ্ছি।
লুৎফা: সব্বা খ্যায়ের আম্মিজান।
সিরাজ: সব্বা খ্যায়ের আম্মি।
লুৎফা: আপনিও শুয়ে পরুন।
সিরাজ: না লুৎফা, আমার ঘুম আসবে না। আমি ক্লান্ত। সবাইকে নিজের কাজের কৈফিয়ৎ দিতে দিতে আমি সত্যি ক্লান্ত। লুৎফা, তুমি আমার আশ্রয়। তুমি যদি হাত ছেড়ে যাও আমি কোথা থেকে জোর পাব লড়াইয়ের।
লুৎফা: কিন্তু খালাআম্মা আপনার ওপর যথেষ্টই রেগে আছেন। এরপর যদি এমন কিছু –
সিরাজ: থামলে কেন লুৎফা বলো..
লুৎফা: আপনাকে যদি মেরে ফেলার সাজিশ করে, তাহলে আমি আর জোহরা তো পথে বসবো নবাব।
সিরাজ: আমি বেঁচে থাকতে তোমাদের গায়ে আঁচ লাগতে দেব না। আমি কথার খেলাপ করিনা তুমি জানো লুৎফা।
লুৎফা: জাহাঁপনা ক্ষমা করবেন। আমি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে সত্যি ভীত।
সিরাজ: এই সিরাজউদ্দৌলা কুঠিয়াল ওয়াটসনকে বাধ্য করেছি কলকাতার কাশিমবাজার দুর্গের প্রাচীর ভেঙে ফেলতে। আমি একবার ভাবিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে। কিন্তু এখন লুৎফা ওই সাহস পাচ্ছি না কেন?
লুৎফা: আপনি চিন্তা করবেন না। সকলেই আছে আপনার সাথে।
সিরাজ: মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছ তুমি বেগম। আমার মন্ত্রী, সেনাপতি সবাই আমার বিপক্ষে। চারিদিকে শুধু অবিশ্বাস আর ষড়যন্ত্র। আমি কি একেবারেই একা তবে?
লুৎফা: আপনার কিছুসময় বিশ্রাম প্রয়োজন। আপনি সবটা অনায়াসেই পার করে ফেলবেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
সিরাজ: আমার সময় নেই লুৎফা। আমাকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাকে বাংলা বাঁচাতে হবে।
লুৎফা: কি বলছেন আপনি। তাহলে আলিনগর সন্ধি?
সিরাজ: সেসব কবেই চুকে বুকে গেছে। কোম্পানি যেকোনো সময় রাজধানী আক্রমণ করতে পারে।
লুৎফা: এত বড় স্পর্ধা পেল কীকরে বণিকরা?
সিরাজ: ঘরের লোক সদর দরজা খুলে দিলে দুশমনকে সওগাত জানালে কতখানি আটকানো সম্ভব?
লুৎফা: যদি এদের কে সাজা দেওয়া যায়?
সিরাজ: আর কাকে কাকে কায়াদ করব বল। রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, মীরজাফর নাকি আমার কিসমত?
লুৎফা: আপনি বিশ্রাম নিন। এখন অনেক কঠিন কাজ বাকি।
সিরাজ: আজ রাতটা আমরা দুজন থাকি শুধু। আর কেউ না। কতদিন প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারি নি। আমার রাজত্বে সংসারের অভাব বেগম।
ঢং ঢং ঢং…
সিরাজ: আমায় যেতে হবে লুৎফা। আমার যাওয়াটা দরকার।
লুৎফা: না যাবেন না। আজ রাতটুকু থেকে যান।(গলা ধরে এসেছে প্রায়)
জোহরা দৌড়ে এসেছে মায়ের কাছে। ভয় পেয়েছে বুঝি।
জোহরা: আব্বু কোলে নেবে না?
সিরাজ পেছনে ফিরে তাকালো মাত্র। নীচু হয়ে কপালে ছোট্ট চুমু এঁকে দিলেন। লুৎফার হাতে ঠোঁট ছোঁয়ালেন মমতায়। এগিয়ে যাচ্ছেন সিরাজ। দরজার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন বেগম। এই দেখা শেষ দেখা নয় তো?