মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী শাহ নিশাপুর রাজার উত্তরাধিকারী নবাব। ম্যাকলয়েড নামে এক স্টিমারের ডেকে দাঁড়িয়ে ভাবছেন তার অতীত আর বর্তমান নিয়ে l তিনি ১৮৪৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮৫৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ বছর অযোধ্যা শাসন করেছিলেন। তার রাজত্বে প্রজারা তো অসুখী ছিল না ! তবে কেন তার বিরুদ্ধে এমন কঠিন অভিযোগ? হ্যা, কিছুদিন ধরে ই তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন ইংরেজদের মনোভাব l পলাশীর যুদ্ধের পর একশো বছর ধরে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একের পর এক ভারতীয় স্বাধীন রাজ্য গুলো দখল করে চলেছিল। কখনও যুদ্ধ করে, কখনও বা ছলে বলে কৌশলে। তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন কুক্ষিগত করার এই প্রক্রিয়া থেকে বাদ যাবে না অযোধ্যাও। তাদের ষড়যন্ত্রের এই ধারাবাহিকতায় ১৮৫৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি অযোধ্যার পঞ্চম ও শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ তাঁর মাথার মুকুট খুলে জেমস উট্রামের হাতে তুলে দিলেন।
ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি তো অনেক দিন ধরেই নানা রকম কূটকৌশল চালিয়ে অযোধ্যা কে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে যুক্ত করার পরিকল্পনা করছিলেন। এরই সূত্র ধরে ডালহৌসি ১৮৫৭ সালে অন্যায়ভাবে তাদের রাজ্যের সাথে নবাবকে সংযুক্ত হওয়ার নির্দেশ দেন l চুপ থাকেননি তিনি , এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন এবং নতুন চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন ‘তোমরা আমার মসনদ নিতে পারো, আমার রাজ্য নিতে পারো কিন্তু আমার দস্তখত নিতে পারবে না ‘। এটাই হলো কাল! এই অস্বীকৃতির ফলে তাকে লক্ষ্মৌ থেকেও চিরনির্বাসিত করার জন্য লর্ড ডালহৌসি আর এক অপমানজনক চিঠি পাঠান, সেখানে লিখা ছিলো,” নবাব নাচ-গান নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাঁর প্রজারা অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে আছে, তিনি রাজ্য পরিচালনায় ব্যর্থ তাই যে কোনো সময় গৃহযুদ্ধ হতে পারে আর এই গৃহযুদ্ধ লাগলে কিছুতেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জনগণকে বাঁচাতে পারবে না , সেজন্য নবাবের খেতাব রেখেই তাকে কলকাতায় স্থানান্তর করতে হবে”। লর্ড ডালহৌসির এই প্রতারণা চুক্তির ফলে তাকে ছেড়ে চলে আসতে হচ্ছে তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয় অওয়ধ।
ইতিহাস বলছে, ১৮৫৬ সালের ৬ মে কলকাতার পশ্চিমে গঙ্গার তীরে বিচালিঘাটে জেনারেল ম্যাকলয়েড নামে এক স্টিমারে করে মেটিয়াবুরুজে পা রাখেন ওয়াজেদ আলী শাহ। তার মনে মনে ইচ্ছে, কাউন্সিলের কর্তাদের সাথে আলোচনা করে উদ্ধার করবেন তার সিংহাসন। আর এখানে সফল না হলে যাবেন লন্ডনে, রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে এর সুষ্ঠু সমাধানের জন্য । কিন্তু পরিস্থিতির চক্রব্যূহে এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকার কারণে লন্ডন যাওয়া আর হয়ে ওঠে না নবাবের, ইংরেজ সরকারের সাথে বহু দেনদরবার করেও অবশেষে কোনো কূল-কিনারা করতে না পেরে আপাতত কলকাতায় থেকে যান রাজ্যহারা নামমাত্র নবাব হয়ে এবং তার পরিবর্তে তার মাকে পাঠান ইংল্যান্ডে l তখনো কলকাতায় ভালোভাবে স্থায়ী হননি নবাব, নিতে রাজি হননি প্রস্তাবিত পেনশনও। কেনোই বা নেবেন ? কারণ তিনি অপেক্ষা করছেন ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার হস্তক্ষেপের । লন্ডনে ‘ অযোধ্যা মিশন’ তখন সক্রিয় l তাঁর হয়ে ক্রমাগত চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁর মা-বেগম আউলিয়া ও তাঁর সহযোগীরা। এরই মধ্যে ঘটে গেলো নতুন এক ঘটনা বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জ্বলে উঠলো মহাবিদ্রোহের আগুন।
এর ফলে ব্রিটিশ জনমত পুরোপুরি ঘুরে গেলো ভারতীয়দের বিরুদ্ধে। রাজমাতার মিশন পুরোই ব্যর্থ হলো l এদিকে কোম্পানির সরকার এই বিদ্রোহের তাণ্ডবে দিশেহারা l হঠাৎ মেটিয়াবুরুজের অস্থায়ী বাসস্থান থেকে গ্রেফতার করলো ওয়াজেদ আলীকে। পাছে বিদ্রোহীরা জোড় করে ওয়াজেদ আলীকে নেতা হিসেবে তুলে ধরে , হয়তো সেই ভয়েই ফোর্ট উইলিয়ামে তাড়াতাড়ি গৃহবন্দি করা হয় তাঁকে। আশ্চর্য ! ভারতের একজন স্বাধীন নবাবের সেখানে বন্দী থাকতে হলো ২৫ মাস, বিদ্রোহ মিটে যাবারও আট মাস পর তিনি ছাড়া পান। ওয়াজিদ আলি নিজে এই বিদ্রোহ সমর্থন না করলেও তাঁর স্ত্রী- হযরত মহল সিপাহী বিদ্রোহের দুঃসাহসী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ছেলে বিরজিস কদ্রকে নতুন নবাব ঘোষণা করে তিনি চালিয়ে গেলেন কঠোর সংগ্রাম l কারো কারো মতে নবাবের বন্দিত্বই ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা করেছিল l
যাই হোক এক সময় মুক্তি পেলেন নবাব l কিন্ত কোন কূলকিনারা পাচ্ছেন না l কি করবেন নবাব ? উপায় না পেয়ে মেনে নেন পেনশনও । ছাড়া পেয়ে বড় রাজ্য লক্ষ্ণৌকে কলকাতার মেটিয়াবুরুজে এনে ‘মিনি লক্ষ্ণৌ’ গড়ে তুললেন। শ্রীপান্থের ‘মেটিয়াবুরুজের নবাব’- বই থেকে জানা যায় ব্রিটিশ সরকার থেকে পাওয়া মাসে এক লাখ টাকার পেনশন সাহায্যে তিনি মেটিয়াবুরুজে একের পর এক প্রাসাদ বানাতে শুরু করেন- মুরাসা মঞ্জিল, নূর মঞ্জিল, আদালত মঞ্জিল ইত্যাদি। দরিয়া তার খুব পছন্দের, তিনি বলতেন আমি যেখানেই যাবো দরিয়া আমার সাথে যাবে l তাই গুমতি নদীর স্মৃতি হুগলি নদীতে এসে মিলিত হলো l শুরু হলো এক নতুন জীবন l তার পৃষ্ঠপোষকতায় ক্রমে ক্রমে শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান হয়ে ওঠে কলকাতা। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার নবাবের এই সংস্কৃতিমনষ্কতার কথা তাদের নথিপত্রে তেমন বিশেষ কিছু উল্লেখ করেনি। তাদের রেকর্ডে প্রাধান্য পায় নবাবের স্ত্রীদের বিস্তারিত বিবরণ l নবাব কতটা অপদার্থ ছিল তার প্রমান উপস্থাপন করাই ছিলো আসলে তাদের মুখ্য বিষয় l
পরবর্তীত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক রোজি লেইউলিন জোনস তার “দ্যা লাস্ট কিং ইন ইন্ডিয়া”এবং “ট্রু টেলস অব ওল্ড লক্ষ্ণৌ” বইয়ের মাধ্যমে নবাবের জীবনের এই অজানা ইতিহাস গুলো আবার আমাদের সামনে নিয়ে আসে। চলুন ওয়াজিদ আলীর শিল্প সাধনায় বিরিয়ানি, সরোদ, কত্থক নৃত্য, ঠুমরি, ইত্যাদি কিভাবে বাংলার সাথে জড়িয়ে গেল তা মেটিয়াবুরুজের ইমামবাড়া থেকে ঘুরে এসে জেনে নেই l
রাজ্যহারা নবাবের কলকাতা শহরে গড়ে তোলা দ্বিতীয় এক লক্ষ্মৌ যদিও অযোধ্যার রাজধানী লক্ষ্মৌর সাথে তুলনা চলে না, কিন্তু এখানেও তিনি সেই রাজকীয় জৌলুস, প্রাসাদ, বাগান, চিড়িয়াখানা গড়ে তোলেন। আসলে মেটিয়াবুরুজের চার দেয়াল ঘেরা ইমামবাড়ার সংস্কৃতির জগৎ ছিলো বাইরের পৃথিবী থেকে প্রায় ভিন্ন। সেখানে তিনি মুঘল দরবারি সংস্কৃতির শেষ ছায়াতে সংস্কৃতির এক নব প্রাণকেন্দ্র গড়েন। স্বয়ং ওয়াজেদ আলী শাহ নির্মিত এই ইমামবাড়া লক্ষ্ণৌ ইমামবাড়ার ক্ষুদ্র সংস্করণ অথচ সত্যিই কি রাজকীয়! উনিশ শতকের উপনিবেশকালে কলকাতার বিজ্ঞজনেরা নিজেদরকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যাস্ত l হিন্দুদের কাছে এ সময় টি ছিল ভারতীয় রেনেসাঁর সময় l অন্যদিকে অভিমানবোধ থেকে মুসলমানরা নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছিল ঐ সংস্কৃতি থেকে l নিজেদের বন্দী করে রেখেছিল চার দেওয়ালের মধ্যে l নবাবের কাছেও এ যেন নতুন পরিবেশ l নিজেকে বহিরাগত ভাবতে চাইলেন না l শুরু হলো নতুন সংগ্রাম l কলকাতায় নির্বাসিত প্রাক্তন নবাব ওয়াজিদের পৃষ্টপোষকতায় ধ্রুপদী শিল্প-সংস্কতির কেন্দ্র হয়ে ওঠে মেটিয়াবুরুজ। এখানে আরও পরিণত আকারে ‘রাধা কানহাইয়া কা কিসসা’ মঞ্চস্থ হতে থাকে। ১৮৫৯ থেকে ১৮৭৫-এর মধ্যে মেটিয়াবুরুজে অন্তত ২৩টি জলসার আয়োজন করেন তিনি। ওয়াজিদ আলি শাহ নিজে ছিলেন শিল্পী এবং সাহিত্যিক। নবাব হওয়ার আগেই ১৮৪৩ সালে ভাই সিকন্দর হাসমতের সম্মানে এক জলসার আয়োজন করেছিলেন তিনি। এই কিস্সাকেই বলা যায় প্রথম আধুনিক উর্দু নাটক। কৃষ্ণ ছিলেন তাঁর রোল মডেল। যমুনাতীরে পূর্ণিমা রাতে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের লীলা নবাবের চিরকালীন অনুপ্রেরণা ছিলো। কৃষ্ণের রাসলীলা থেকেই লক্ষ্ণৌয়ে ‘রহস’-এর সৃষ্টি। রহস নাটক হল নৃত্যনাট্য, যেখানে নির্দিষ্ট গল্প থাকতো। ওয়াজিদ আলির রহস বস্তুত অপেরা, যেখানে তিনি ব্রজ অঞ্চলে কৃষ্ণের জীবন নিয়ে প্রচলিত নৃত্যের সঙ্গে নিজস্ব কত্থকের কম্পোজিশন মিলিয়েছিলেন। তবে ওয়াজেদ আলীর নাট্যপ্রয়াস কলকাতার নাটকমঞ্চকে আদৌ প্রভাবিত করেছিলো কিনা এমন তথ্য পাওয়া না গেলেও কত্থক নাচের সংস্কৃতিকে নবাব যে স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন, কলকাতার সেই লক্ষ্ণৌ ঘরানাকে রসিক মহলে আদৃত করে তোলার পেছনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ রাখে না। তিনি সৃষ্টি করেছিলেন ‘রহস’ নামের এক বিশেষ আঙ্গিকের নৃত্যনাট্য। মহারাজ ঠাকুর প্রসাদের থেকে কত্থক শিখেছিলেন ওয়াজিদ আলি শাহ।
১৮৭৫ সালে তিনি- ‘মুসাম্মি বা বানি’ নামে কত্থক নিয়ে একটি সচিত্র বই লেখেন যা মেটিয়াবুরুজে লিথোগ্রাফ করে ছাপা হয়। কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে এই বইয়ের পান্ডুলিপি ও মুদ্রিত রূপ দু’টিই আছে। তাঁর সময়ে কত্থক শুধু হিন্দু শিল্পীদের মাঝে আবদ্ধ ছিলো না, মুসলমান শিল্পীরাও একে গ্রহণ করে আরো পরিণত করেন।
লক্ষ্ণৌয়ে ঘরানার কত্থকশিল্পীরা ওয়াজিদের সূত্রেই কলকাতায় সমাদৃত হন। আর ঠুমরির তো কথাই নেই। বস্তুত ওয়াজেদ আলীর দাক্ষিণ্যে সেসময় গুরুত্বপূর্ণ কবি, গায়ক, বাদকদের কাছে মেটিয়াবুরুজ হয়ে উঠেছিলো ধ্রুপদী ধারার কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতের এক অবধারিত গন্তব্য। লক্ষ্মৌ ঠুমরির টানে পাথুরিয়াঘাটা থেকে রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর ,যদুভট্ট, অঘোরনাথ পাড়ি দিতেন মেটিয়াবুরুজে। লক্ষ্ণৌয়ে ওয়াজেদ আলীর দরবারেই ঠুমরি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছায়। আর মেটিয়াবুরুজ থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার বুকে। বহু ঠুমরি গান রচনা ও রাধাকৃষ্ণের রাসলীলাকে কত্থক ফর্মে নৃত্যনাট্য রূপ দেওয়ার মতো চিরস্মরণীয় কাজ করে গেছেন তিনি। নবাব নিজেও কম গান লেখেননি। এমনকি দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত ‘বাঙালীর গান’-এও (১৯০৬) ওয়াজেদ আলীর লেখা তিনটি গান ঠাঁই পেয়েছে। সবচেয়ে বিখ্যাত বোধহয় নবাবের-“যব ছোড় চলে লক্ষ্ণৌ নগরী” এই গানটি,যেটা বড় বেদনায় একদিন মসনদ হারা নবাব রচনা করেছিলেন। আশা করেছিলেন, হয়তো একদিন ফিরতে পারবেন তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয় লক্ষ্ণৌ নগরীতে, কিন্তু তা আর কোনদিন সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
মেটিয়াবুরুজের দরবার যন্ত্রসংগীতেও অতুলনীয়। ‘তারিখ-ই-পরিখানা’-য় ওয়াজিদ লিখেছেন, তিনি বিখ্যাত সেতারি কুতুব আলি খানের কাছে সেতার শেখেন। সেনি ঘরানার ওস্তাদ বসত খান মেটিয়াবুরুজে রবাব নিয়ে আসেন। সুরশৃঙ্গারও তাঁরই আনা, ওয়াজেদ আলী তবলা নামক যন্ত্রটিকেও জনপ্রিয় করেন। তিনি বিখ্যাত বিনকারও ছিলেন । ওয়াজেদে আলীর আহ্বানে কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দরবারে সুরবাহার বাজিয়েছিলেন। এই দরবারেই নাকি ওস্তাদ নিয়ামতুল্লা খান আধুনিক সরোদ সৃষ্টি করেন। এগারো বছর তিনি ওয়াজেদ আলীর কাছে ছিলেন। সানাই, এসরাজ, সুরবাহার,সরোদের সঙ্গেও জড়িয়ে তাঁর নাম।
এখানেই শেষ নয়। কুস্তি, মোরগ লড়াই, ঘুড়ি উড়ানো, পায়রা পোষা- এ সবে নবাবের আশক্তি ছিলো প্রচুর। কলকাতার আরও অনেক ঐতিহ্যের সূচনাই মেটিয়াবুরুজ। কলকাতার প্রথম চিড়িয়াখানাও তাঁর সৃষ্টি। সেখানে জীবজন্তুর সংখ্যা ও বৈচিত্র ছিল ঈর্ষণীয়। শোনা যায় ডারউইন তার এই চিড়িয়াখানা নিয়ে ভীষণ আগ্রহী ছিলেন l তার বন্ধু Edward Blyth এর কাছ থেকে নবাবের সব নতুন নতুন জীবজন্তুর খবর নিতেন l সাপ যে পালা যায় তার কাছ থেকেই তো শিখলেন কলকাতাবাসী l
খাদ্য রসিক নবাবের হাত ধরেই মেটিয়াবুরুজে প্রবেশ করে ‘দমপোক্ত’ বা ঢিমে আঁচে রান্না খাবার, বিশেষ করে বিরিয়ানি। পোলাও, কোরমা, বিরিয়ানি, শিরমল, শাহী টুকরা থেকে শুরু করে জর্দা- কলকাতাবাসীর জিভে এসব সুখাদ্যের অনুপ্রবেশ ঘটে ওয়াজেদ আলী শাহের মাধ্যমেই। অওয়াধি বিরিয়ানি আর কলকাতার বিরিয়ানি’র মধ্যে তফাৎ একটাই, তা হলো-আলু। বিরিয়ানিতে আলুর প্রচলনও তাঁর হাতেই কি না, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। লক্ষ্ণৌয়ে পানের কদর আজও কম নয়। কিন্তু ব্রিটিশ তথ্যসূত্র এই সৃষ্টিশীল নবাবকে ঠিকভাবে বিবৃত করেনি কোনোদিন, উল্টো প্রচার করতে চেয়েছে তিনি ছিলেন খানিকটা নারীসুলভ, মদ্যপায়ী, নারীআসঙ্গ লিপ্সু অথচ তাম্বুলবিলাসী হলেও নবাব এক ফোঁটা মদ বা আফিম কখনো স্পর্শ করেননি। ওয়াজেদ আলীর বিরুদ্ধে কোম্পানির শাসনকর্তাদের অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ইংরেজদের কাছে যে যে কারণে তিনি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেননি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই কারণগুলোর জন্যই তিনি পৃথিকৃৎ এর মর্যাদা পেতে পারেন।
ওয়াজেদ আলী শাহ যখন স্টিমারে করে কলকাতার বিচালিঘাটে এসে পা রাখলেন তখন তিনি জানতেন না কতদিন তাকে এই কলকাতায় থাকতে হবে l অথচ তাঁকে আমৃত্যুই থেকে যেতে হয়েছিলো কলকাতায়। ১৮৮৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর, সেদিন কলকাতার মেটিয়াবুরুজের আকাশটা ছিলো নিশ্চুপ, কোনো এক বেদনা আকাশকে ঘিরে বসেছিলো, নদীর ঢেউয়ের শব্দে ছিলো বিরহের গান কেননা সেইদিন অওয়ধের শেষ নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ কলকাতার মাটিতেই তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একুশটি তোপধ্বনি করে তাঁকে স্বাগত জানানো হয় যে শহরে , সেই শহরের সিবতাইনবাদ ইমাববাড়ায় রয়েছে তাঁর কবর। এই ইমামবাড়ায় রয়েছে ওয়াজেদ আলী শাহ এর প্রতিকৃতি। যেটি তার জীবিত অবস্থায় এঁকেছিলেন কোনো এক চিত্রশিল্পী। ইংরেজ তাঁর রাজ্য কেড়ে নিয়েছিলো কিন্তু জীবনের রস-উপভোগ থামিয়ে দিতে পারেনি। চরম বিপর্যয়ের মধ্যেও ওয়াজেদ আলী তাঁর নবাবী জীবনচর্যার কোনও তালভঙ্গ হতে দেননি। আর এ জন্যই আমাদের সংস্কৃতি আরো সমৃদ্ধ হয়েছে। ওয়াজেদ আলীর জীবনচর্চার উদ্ধার কোনো অস্তমিত রাজ মহিমার গুণকীর্তন নয়, আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের শিকড় সন্ধান। তাই আমরা তাকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। রাজত্ব হারালেও, রাজকীয় মেজাজ ছাড়তে পারেননি ওয়াজিদ আলি শাহ। তবে লখনৌ ছেড়ে আসার যন্ত্রণা কখনও মন থেকে যায়নি। নির্বাসিত অবস্থায় তিনি বলেছিলেন, “একটা সময় ছিল, যখন আমার পায়ের তলায় থোকা থোকা মুক্তো চাপা পড়ত। এখন শুধু ওপর থেকে এক নিষ্ঠুর রোদ আর পায়ের তলায় কাঁকর”। এই কথার মধ্যে যেমন প্রকাশ পায় প্রাক্তন নবাবের দীর্ঘশ্বাস, তেমনি এক শিল্পরসজ্ঞ কবি মনেরও পরিচয় পাওয়া যায়।
আপনি কি জানতেনঃ ইমামবাড়া হলো এমন একটি উপাসনালয় যেখানে ধর্মালোচনা,পাঠ এবং ছেলেদের শিক্ষাদানের কাজও চলে। আজ এই সার্কুলার গার্ডেনরিচ রোডে অবস্থিত এই ইমামবাড়ায় ঘুমিয়ে আছেন হতভাগ্য নবাব, তাঁর দুই সন্তান ও অন্যান্য বংশধরেরা।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার – আল হাসান