ক্লিওপেট্রা, একজন ভুবন ভোলানো সুন্দরী নারীর নাম। এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে, যিনি ক্লিওপেট্রার নাম শোনেন নি। আর ক্লিওপেট্রা মানেই তো সৌন্দর্যের প্রতীক। মিশরের শেষ ফারাও ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্য নিয়ে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু কোথাও তার গায়ের রং সম্পর্কে লেখা হয় নি। ক্লিওপেট্রার গাত্রবর্ণ তবে কেমন ছিলো? শ্বেতাঙ্গ, নাকি কৃষ্ণাঙ্গ?
সম্প্রতি প্রচারিত নেটফ্লিক্সের ডকুড্রামা সিরিজ ‘আফ্রিকান কুইনস’ এর একটি পর্ব ‘ক্লিওপেট্রা’-র ট্রেইলারে রাণী ক্লিওপেট্রার ভূমিকায় কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেত্রী অ্যাডেল জেমসের আত্মপ্রকাশে ভয়ানক ক্ষুব্ধ মিশরবাসীর দাবী, ক্লিওপেট্রা নাকি কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন না। অথচ ক্লিওপেট্রার গায়ের রং নিয়ে লিখিত কোনো দলিল এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি।
ইরানি কার্পেটে মোড়ানো ক্লিওপেট্রাকে প্রথম দেখায় ভালোবেসেছিলেন জুলিয়াস সিজার। সিজারের বন্ধু মার্ক অ্যান্টনিও মত্ত হয়েছিলেন ক্লিওপেট্রার প্রেমে। না জানি কতো পুরুষের মনকে বশ করেছিলেন ক্লিওপেট্রা তার রূপ দিয়ে। সুতরাং, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, রাণী ক্লিওপেট্রা একজন অসম্ভব আকর্ষণীয় ও আবেদনময়ী নারী ছিলেন। কিন্তু গায়ের রং ফর্সা হলেই কি কেবল আকর্ষণীয় হওয়া যায়? কৃষ্ণাঙ্গ কোনো রমণীর ক্ষেত্রে কি ‘সুন্দর’ শব্দটি এতোটাই বেমানান?
আমাদের সবার পরিচিত এই ক্লিওপেট্রা মূলত সপ্তম ক্লিওপেট্রা। তার আগে আরো ছয় জন ক্লিওপেট্রা ছিলেন। আলেকজান্ডারের সেনাপতি প্রথম টলেমীর হাত ধরেই মিশরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো টলেমী রাজবংশের শাসন। মিশরে এই শাসনের যুগকে বলা হতো হেলেনিস্টিক যুগ। টলেমী বংশের পুরুষ সদস্যদের নামকরণ হতো ‘টলেমী’ এবং নারী সদস্যদের নামকরণ হতো ‘ক্লিওপেট্রা’, ‘আর্সিনো’, কিংবা ‘বেরেনিস’ নামে। প্রথম টলেমী যেহেতু আলেকজান্ডারের সেনাপতি ছিলেন, সেহেতু ক্লিওপেট্রার শরীরে মেসিডোনীয় রক্তই বহমান –এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আর এ বিচারে মিশরীয়দের দাবী সত্যি হতে পারে, অর্থাৎ ক্লিওপেট্রা শ্বেতাঙ্গ হতে পারেন।
তবে একটি বিষয় অস্বীকার করা যাবে না যে, ক্লিওপেট্রার বাবা দ্বাদশ টলেমী কিন্তু নবম টলেমীর একজন অবৈধ সন্তান ছিলেন এবং দ্বাদশ টলেমীর মা একজন বহিরাগত অপরিচিত নারী ছিলেন। টলেমীরা নিজেদের মেসিডোনীয় রক্তকে বিশুদ্ধ রাখবার উদ্দেশ্যে নিজেদের পরিবারের মধ্যেই বিয়ে করতেন। কিন্তু এর ব্যতিক্রম অবশ্যই হয়েছে। এমনই এক ব্যতিক্রম হলেন খ্রিস্টপূর্ব ১১৬ সালে জন্ম নেয়া নবম টলেমীর জারজ সন্তান দ্বাদশ টলেমী। প্রাচীন মিশর ছিলো উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার একটি অংশ। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে স্থানীয় কোনো নারীর সঙ্গে নবম টলেমীর প্রণয়ের সম্ভাবনা কিন্তু একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
সে সময় টলেমীদের নিজেদের মধ্যে এতো বেশি প্রতারণা ও ষড়যন্ত্র দানা বাঁধতো যে, একে অপরকে হত্যা করতে করতে তাদের বৈধ উত্তরাধিকারীর অভাব প্রকট হয়ে উঠলো। একাদশ টলেমী যখন তৃতীয় বেরেনিসকে হত্যা করলেন এবং এ কারণে তিনি নিজেও আলেকজান্দ্রিয়ানদের হাতে নিহত হলেন, তখন মিশরের পরবর্তী ফারাও কে হবে, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব শুরু হলো। উপায়ান্তর না দেখে দ্বাদশ টলেমীকেই বসানো হলো মিশরের সিংহাসনে।
দ্বাদশ টলেমীর ছয় জন সন্তানের মাঝে একজন ছিলেন চতুর্থ আর্সিনো, ক্লিওপেট্রার ছোট বোন। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে তুরস্কে আবিষ্কৃত একটি কঙ্কাল পরীক্ষা করে জানা যায়, এটি চতুর্থ আর্সিনোর কঙ্কাল হতে পারে। কঙ্কালটি ছিলো সংকর ধরনের- কিছুটা ইউরোপীয়, কিছুটা প্রাচীন মিশরীয় এবং কিছুটা কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান। বোনের শারীরিক বৈশিষ্ট্য থেকে সহজেই ক্লিওপেট্রার শারীরিক বৈশিষ্ট্যের একটি ধারণা পাওয়া যায়। সুতরাং ক্লিওপেট্রা যে শ্বেতাঙ্গই ছিলেন, কৃষ্ণাঙ্গ নয়, এ ব্যাপারে হলফ করে কিছু বলা যায় না।
ক্লিওপেট্রা দেখতে কেমন ছিলেন, তার বার্লিন বাস্ট থেকে সে ব্যাপারে কিছুটা ধারণা মেলে। ক্লিওপেট্রার এই আবক্ষমূর্তিটি সম্ভবত তিনি রোমে থাকাকালীন তৈরী করা হয়েছিলো। মূর্তিটিতে সাধারণ সুন্দরী এক নারীর মুখাবয়ব দৃশ্যমান, তেমন বিশেষ কিছু লক্ষণীয় নয়। এই বার্লিন বাস্টের সাথে ক্লিওপেট্রার আলেকজান্দ্রিয়ান মুদ্রাতে অঙ্কিত মুখাবয়বটি দারুণভাবে মিলে যায় এবং তা সর্বকালের সেরা সৌন্দর্যের কোনো বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে না। গ্রীক দার্শনিক প্লুতার্কের মতে, ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্য অতুলনীয় ছিলো না।
আসলে দশ জন সাধারণ সুন্দরী নারীর মতোই ক্লিওপেট্রাও ছিলেন একজন সুন্দরী নারী। তবে তার ব্যক্তিত্ব ছিলো অন্যদের চেয়ে আলাদা। একমাত্র ক্লিওপেট্রা হিসেবে তিনি বাবা, ভাই/স্বামী ও ছেলের সাথে সহশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। টলেমী বংশে মিশরীয় ভাষায় পারদর্শী একমাত্র রাণী ছিলেন এই ক্লিওপেট্রা। তিনি ছিলেন আকর্ষণীয়, আবেদনময়ী। তার কথা বলার ভঙ্গিমাও ছিলো অন্যদের চেয়ে আলাদা, যা তার সাধারণ নারীরূপকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলো। কোনো এক যাদুকরী ক্ষমতা তার মাঝে ছিলো, যার কারণে অসংখ্য পুরুষের হৃদয়ে ভালোবাসার সুর বেজে উঠেছিলো ক্লিওপেট্রাকে প্রথম বার দেখেই।
ক্লিওপেট্রার গায়ের রং যা-ই হোক না কেনো, তার সাথে তার সুন্দর মুখাবয়বের কোনো সম্পর্ক নেই। খুবই দুঃখজনক ব্যাপার যে, নেটফ্লিক্স বাতিলের পক্ষে মিশরের প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ একটি অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর করেছে। অপরাধ একটাই, কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাডেল জেমসকে ক্লিওপেট্রা হিসেবে কাস্ট করা। অথচ ক্লিওপেট্রার গায়ের রং নিয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তত্ত্ব আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয় নি। কেনো আজও আমরা কোনো রাণী, রাজকুমারী কিংবা সুন্দরী রমণীর চরিত্রে কৃষ্ণাঙ্গ কাউকে কল্পনা করতে পারি না? এই বর্ণবাদ কবে শেষ হবে?
রেফারেন্স:
- ‘মিশরীয় মিথলজি আদি থেকে অন্ত’ -এস এম নিয়াজ মাওলা
- Why are Netflix and Egypt arguing over whether Cleopatra was black?
- বাস্তবে ক্লিওপেট্রা দেখতে রূপবতী নাকি আবেদনময়ী নারী ছিলেন?
- মিশর: রানী ক্লিওপেট্রা কালো ছিলেন না