১৫২৬ সালে ঐতিহাসিক পানিপথ প্রান্তরে ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে বাবুর যে ভারতবর্ষে মুঘল আধিপত্য কায়েম করেছেন তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কেননা পানিপথের প্রথম যুদ্ধে জয়ী হয়ে তিনি হয়েছিলেন শুধুমাত্র দিল্লির অধিপতি, হিন্দুস্তানের নয়। তখনো পর্যন্ত বাবুর নিজেকে পুরো ভারতবর্ষের সম্রাট নামে নামাঙ্কিত করতে পারেননি। প্রকৃতপক্ষে ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে বাবুর নিজেও ততটুক মনঃতুষ্টিতে ভোগেননি কারণ তিনি জানতেন ভারতবর্ষে তখনো ওঁত পেতে আছে শক্তিশালী রাজপুত যোদ্ধা ও বিদ্রোহী আফগান নরপতির দল। ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদ বাবুরের পানিপথের যুদ্ধে জয়লাভকে ভারতে চাগতাই তুর্কির আধিপত্য কায়েম বলে উল্লেখ করেছেন। পুরো ভারতবর্ষে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ হলেও ভারতের সম্রাট হিসেবে বাবুরের রাজ্য অভিষেকের জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরো এক বছর। ১৫২৭ সালে খানুয়ার প্রান্তরে রাজপুত নেতা রানা সংগ্রাম সিংহকে পরাজিত করে বাবুরের সে সাধ পূর্ণ হয়। ভারতবর্ষের ইতিহাসে চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকারক যুদ্ধ খানুয়ার যুদ্ধের আদিঅন্ত জানবো আজ।
খানুয়ার যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
পানিপথের প্রথম যুদ্ধের অব্যাহতির পর বাবুরকে মোকাবেলা করতে হয় দুইটি বিরোধী শক্তির। একদিকে বিদ্রোহী রাজপুত সম্প্রদায় এবং অন্যদিকে আফগান নেতাদের চক্রান্ত। তাই পানিপথে লোদীর বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করেও বাবুর যেন স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। তখনো পর্যন্ত তাকে দিল্লী ও আগ্রা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু দুর্দমনীয় বাবুর কখনোই তা চাননি। ভারতবর্ষে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার চাবি যখন তার হাতে তখন নিজেকে আর নিবৃত্ত রাখতে পারেননি বাবুর। শুরু হয় তার রাজনৈতিক তৎপরতার দহরমমহরম। তিনি প্রথমেই লক্ষ্য করলেন তার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় গলার কাটা হয়ে বিঁধে আছে আফগান নেতা দাঊদ খান, ইব্রাহিম খান ও আলম খান এবং তার সাথে রাজপুত নবজাগরণের নেতা রানা সংগ্রাম সিংহ।
তাই ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করার ঠিক পরেই বাবুর দোয়াবের আফগান নেতাদের শায়েস্তা করেন। এদিকে মাঝপথে দেখা দেয় নতুন এক বিড়ম্বনা। হিন্দুস্তানের গরম আবহাওয়া সইতে না পেরে কাবুলে ফিরে যেতে লাগল সৈন্যদের একাংশ। বাবুর এদের ধরে রাখার চেষ্টা চালান। তিনি তাদের বুঝাতে সক্ষম হোন যে এখানে স্থায়ীভাবে বাস করলে তাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। এক্ষেত্রে বাবুর সৈন্যদের মধ্যে ধর্মীয় আবেগ লেপ্টে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ফলে তার অনুরোধে কাজ হয়। রাজপুতরা আশা করেছিল মুঘল সৈন্য যদি এভাবে কাবুল ফিরতে থাকে তবে তারা ক্রমশ দুর্বল হতে থাকবে। কিন্তু যখন মুঘল সৈন্যগণ হিন্দুস্তানে থাকার পণ করে তখন রাজপুতদের সে আশা গুড়েবালিতে রূপান্তর হয়ে যায়।
এদিকে দোয়াবের আফগান নেতারাও ক্রমে বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। অন্যদিকে বাবুর তার সেনাপতিদের জায়গির প্রদান করে তাদের বিশেষ আস্থাভাজন হোন। ফলে ভারতে তার অবস্থানের ভিত্তি ধীরে ধীরে পাকাপোক্ত হতে থাকে। একে একে বিয়ানা, গোয়ালিয়র, জৌনপুর বাবুরের হস্তগত হয়। বাবুরের পুত্র হুমায়ূন যখন একই সময়ে বিজাপুর ও কনৌজ দখল করে বসেছেন তখন মেবারে রানা সংগ্রাম সিংহ ক্রোধে ফুঁসছেন। এই সময়ে রাজপুত পুনর্জাগনের নেতা রানা সংগ্রাম তার শক্তি ও সক্ষমতার চূড়ান্ত রূপ দেখিয়ে দখল করলেন ভিলসা, চান্ডেরী ও রনথোম্ভর। এসব অঞ্চল রাজপুতদের আয়ত্তে আসার কারণে তাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। তাছাড়া, আজমীর, সিক্রি ইত্যাদি অঞ্চলের নেতৃবৃন্দ রানার বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। দিল্লির অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে রানা সংগ্রাম মধ্যভারত ও গুজরাটে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেন। পানিপথের যুদ্ধের অব্যবহিত পর থেকেই রানা বাবুরের প্রতি পরশ্রীকাতরতায় ভোগতে থাকেন। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, রানা এর আগে বাবুরকে ভারত আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানান এবং প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাকে যথাযথ সাহায্য প্রদান করেননি। রানা সংগ্রাম ভেবেছিলেন বাবুর বোধহয় সম্পদ লুট করে আবার কাবুলে ফেরত যাবেন কিন্তু যখন দেখলেন বাবুরের স্বপ্ন পুরো ভারত জয় করার তখন তার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগেন। রানা সংগ্রামের এমন যুদ্ধকেন্দ্রিক তৎপরতার দরুন বাবুর তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অগ্রসর হন। ইতিহাসে এটাই খানুয়ার যুদ্ধ নামে পরিচিত।
খানুয়ার যুদ্ধ
বাবুর যখন পানিপথের যুদ্ধে ব্যস্ত তখন রানা সংগ্রাম এই সুযোগে বিয়ানায় অভিযান করে বিদ্রোহী আফগান নেতা হাসান ও মেওয়াটের সাথে চুক্তি করেন। আফগান নেতা হাসান খানের পুত্র পানিপথের যুদ্ধে বন্দী হলেও বাবুর তাকে মুক্তি প্রদান করেন এবং মুক্তিপ্রাপ্ত সেই হাসান খানের পুত্রই রানার সাথে মিত্রতা করে বসেন। এমন সব প্রতিবন্ধকতার গ্যাঁড়াকলে আবদ্ধ হয়ে অবশেষে বাবুর ১৫২৭ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই ফেব্রুয়ারি রানা সংগ্রামের বিরুদ্ধে পূর্ন রণসাজের সাথে যুদ্ধযাত্রা করেন। এর আগে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যুদ্ধপূর্ববর্তী সময়ে করণীয় সম্পর্কে বাবুর তার সেনাপতিদের সাথে বৈঠকে বসেন। আগ্রায় সৈন্য রেখে পাঞ্জাবে বাবুরকে অবস্থান করতে সেনাপতিগণ তাগাদা দেন। তাদের ভাষ্যমতে আপাতত এ যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম। কিন্তু বাবুর বুঝতে পেরেছিলেন এ যুদ্ধ অনিবার্য। আজ হোক কাল হোক রাজপুতদের সাথে তাকে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে। স্বাভাবিকভাবে বাবুর তাদের পরামর্শ এড়িয়ে যান। ওদিকে ছোট ছোট রাজপুত রাজ্যের সমন্বয় গঠিত কনফেডারেশন বায়ানার সীমান্তে আক্রমণ চালায়। ফতেহপুর লুট করে। মুঘল শহরের মসজিদ ধ্বংস করে। শেষে বাবুর তার হিন্দুস্তানী মিত্রসহ ২৫ হাজার সৈন্যসমেত খানুয়ার প্রান্তরে অবস্থান নেন। রাজপুতগণ খানুয়ার পানির উৎস দখল করে নিতে পারে এই শংকায় বাবুর পানির উৎস আগেই তার আয়ত্তে আনেন। ওদিকে ১৫ মার্চ, ১৫২৭ আরেকটি নাটকীয় ঘটনা ঘটে। সেদিন রাতে সুলতান হুসাইন মির্জার নাতি কাসিম হুসাইন বাবুরের সাহায্যের জন্য ৫০০ সৈন্য প্রদান করেন। অতঃপর ১৬ ই মার্চ রাজপুত ১ লাখ ২০ হাজার সৈন্যের সাথে মুখোমুখি হোন বাবুর। পানিপথের যুদ্ধকৌশল গ্রহণ করে মুঘল বাহিনী। প্রথমেই রাজপুত সৈন্যদের ঠেকাতে পরিখা খনন করা হয়। পরিখার পিছনে শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয় ঘোড়া ও গরুর গাড়ি।
আর তার আড়ালে পদাতিক সৈন্যদের সুবিধাজনক জায়গায় রাখা হয়। বাবুর তার সেনাবাহিনীকে তিনটি ভাগে ভাগ করেন। মধ্যভাগে বাবুর নিজে নেতৃত্ব দেন। শুরু হয় যুদ্ধ। এ যুদ্ধে মুঘলরা বুঝতে পারে রাজপুতরা অপরাপর হিন্দুস্তানী সৈন্যদের মত না। এরা জীবন দিবে তবু পিছপা হবেনা। বাবুর এ যুদ্ধে তার প্রধান অস্ত্র কামান দ্বিতীয়বারের মত ব্যবহার করেন। কামানের তোপে রাজপুত হস্তিবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। উপরন্তু তাদের হাতির আঘাতেই তাদের বিশাল এক অংশ মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। এরপরে রাজপুত বাহিনী সম্মিলিতভাবে পদাতিক সৈন্য দিয়ে মুঘলদের উপর হামলে পড়ে। অন্যদিকে মুঘল সৈন্যরা মুহূর্তে যুদ্ধকৌশল পরিবর্তন করে ফেলে। রাজপুতদের ওপর পেছন দিক থেকে আক্রমণের কথা থাকলেও তা না করে বাবুরের নির্দেশে চারদিক হতে ঘিরে ফেলা হয় তাদের। তুলঘুমা পদ্ধতির ফাঁদে পড়ে দিকভ্রান্ত হয় রাজপুত কনফেডারেশন। অবশেষে রানা সংগ্রামের সকল হম্বিতম্বি জলাঞ্জলি যায় এবং যুদ্ধে মুঘল বাহিনী জয়ী হয়। খানুয়ার যুদ্ধ জয়ের পর বাবুর যমুনা নদী পেরিয়ে চাণ্ডেরী দুর্গ দখল করেন। রানা সংগ্রামের সুসজ্জিত বাহিনী পরাজিত হয় বলতে গেলে বাবুরের অসাধারণ যুদ্ধকৌশলের কাছে।
কেন এত গুরুত্বপূর্ণ খানুয়ার যুদ্ধ ?
ঐতিহাসিকগণ মনে করেন পানিপথের যুদ্ধ অপেক্ষা খানুয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সর্বাধিক। অনেকে এই যুদ্ধকে ভারতের ইতিহাসের চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকারক যুদ্ধ বলে মত দেন। কেননা পানিপথের যুদ্ধে বাবুর পরাজিত করেছিলেন কেবলমাত্র দিল্লির সুলতানকে। আর খানুয়ার যুদ্ধে তাকে মোকাবেলা করতে হয়েছিল প্রায় ভয়ংকর হয়ে উঠা রাজপুত ও আফগান বিদ্রোহী শক্তিকে।
এ যুদ্ধে বাবুরের পরাজয় হলে ভারতবর্ষের ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লিখিত হত। ঐতিহাসিক রাসব্রুক উইলিয়াম এ সম্পর্কে একটি মন্তব্য করেন
“মেবারের সুনাম ও শক্তির প্রতি নির্ভরশীল গোষ্ঠী মাত্র একটি প্রচণ্ড আঘাতে ধূলিসাৎ হয়ে যায় এবং ভারতবর্ষের রাজনীতিতে এদের আর তেমনভাবে গণ্য করা হয়নি”
খানুয়ার যুদ্ধে জয়ী হয়ে বাবুর সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেন হিন্দুস্তানের সম্রাট হতে তার সামনে কার্যত আর কোন বাধা রইল না। এই যুদ্ধের পর বাবুর সুলতান উপাধি ত্যাগ করে ‘পাদশাহ’ বা ‘বাদশাহ ‘ উপাধি গ্রহণ করেন।
তথ্যসূত্র :
দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস : অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান
মোঘল সাম্রাজ্যের সোনালি অধ্যায়- সাহাদত হোসেন খান