চাটগাঁ দুর্গ আরাকানীদের অধিকৃত রাজধানী। চাটগাঁ খুবই বড় শহর এবং পূর্বদেশে বিখ্যাত বন্দরও। এর একদিকে কাশ্মীর, চিন, ক্যাথে (cathay?) এবং মহাচীনের পাহাড় এবং অন্য সীমান্তে বঙ্গোপসাগর। পশ্চিম দিকটি ঘিরে রয়েছে গভীর নদীজাল আর বিপুল বিস্তৃত সমুদ্র। জল বা সড়ক পথে এই অঞ্চলে প্রবেশ করা খুবই দুঃসাধ্য। এই ভূমিখণ্ডটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সমস্যাসঙ্কুল কাজ। এই দেশের মানুষদের মগ বলা হয় যেটি এসেছে মহামিলইসাগ(ঘৃণ্য কুত্তা) থেকে। স্থানীয় প্রবাদে বলা হয় নামটি স্বর্গ থেকে ভেসে আসা। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী ছাড়া অন্যান্যদের তাদের দেশে প্রবেশ করতে দেয় না। খ্রিষ্টিয়রা সমুদ্র পথে এই অঞ্চলে ব্যবসা করতে এসেছিল। এখানে খুবই ভাল হাতি পাওয়া যায়; ঘোড়ার চাহিদা মারাত্মক। বর্তমান লেখক খানইখানান[মীর জুমলা] থেকে শুনেছিল আরাকানের হাতির সৌন্দর্য এবং চেহারা, যে কোনও অঞ্চলের হাতিকে হার মানিয়ে দেয়। এদেশে ধাতুর কিছু খনি রয়েছে। বাসিন্দাদের কোনও ধর্মবিশ্বাস নেই, তবে কিছুটা হিন্দু ধর্মের সঙ্গে তুলনীয়। জ্ঞানীদের রাওয়ালি বলা হয়; রাওয়ালিদের জীবনযাপন অনেকটা সেওরাহদের[শ্বেতাম্বর জৈন] মত। এই দেশের রাজা খুবই কড়া হাতে শাসন চালায়। চাটগাঁ বন্দর আর দ্বীপের প্রশাসক এবং মানুষেরা রাজাদের কাছে নত হয়ে থাকে। রাজারা এতই মুর্খ যে, সূর্য মাথায় থাকা অবস্থায় রাজসভা বসায় না, কারন সূর্য নাকী তাদের ছোট ভাই, ছোট ভাই মাথায় থাকলে বড়ভাই কী করে রাজসভা বসায়’। ফরমানে তারা উপাধি লেখে ‘সূর্যের বড় ভাই, সোনার প্রাসাদ আর শ্বেত হস্তির মালিক’। তারা জারজ-সন্তানকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনে করে এবং নিজেদের বোনের সঙ্গে তার বিয়ে দেয়। ১১৬৫তে শায়েস্তা খানের চাটগাঁ দখলের পরে আমি তাদের প্রাসাদের নথি থেকে এসব তথ্য উদ্ধার করেছি। তাদের ইতিহাসের নানান সময় জানতে গেলে জনগন উত্তর দেয় যেদিন থেকে প্রথম রাজা রাজত্ব শুরু করে, সেদিন থেকেই বছর গোণা শুরু হয়। নতুন রাজা রাজত্ব শুরু করায় পুরোনো বছর সব মুছে গেছে, নতুন করে বছর গোণা শুরু হয়েছে। প্রাচীন রাজার রাজত্ব চলেছিল ১১২৭ বছর(যদুনাথ সরকার মন্তব্যে লিখছেন স্থানীয় বর্মি বছর সূত্রে এটা হবে ১০২৭)। তাদের অসংখ্য কামান রয়েছে, তাদের নাওয়ারার সংখ্যা সমুদ্রের তরঙ্গের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যায়। তাদের অধিকাংশ জাহাজ ঘুরাব এবং জলবা আঙ্গিকের; খালুস আর ধুম, ঘুরাবের থেকেও আকারে বড়। এই জাহাজগুলো এত শক্ত কাঠের তৈরি(আস ছবইকালবাদার) যে জম্বুরক এবং ছোট কামানের গোলার আঘাত সে সব জাহাজ ধ্বংস করতে পারে না। [পরের দিকে] রাজা ফিরঙ্গি হার্মাদ হানাদারদের বাংলা লুঠ করতে নিয়োগ করায়, তারা আর এই কাজে আরাকানি জাহাজ পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
পুরোনো চাটগাঁর বর্ণনা
বাংলা আর আরাকানের সঙ্গে জুড়ে থাকা একটি ভূখণ্ড আরাকান। ফেনি নদীর তীরে জগদিয়ার মুঘল থানা থেকে চাটগাঁ পর্যন্ত রাস্তা সম্পূর্ণ বন্য জঙ্গলে ঢাকা। পাহাড়ের তলাতেও গভীর জঙ্গল। এই অঞ্চলে কোনও জীবিত বস্তুর অস্তিত্ব নেই। ফেনি নদী টিপেরা পাহাড় থেকে বেরিয়ে জগদিয়া হয়ে বয়ে সমুদ্রে পড়েছে। বর্ষা মরশুম ছাড়া জল ভরা ৯৯টি নালা ফেনি এবং চাটগাঁ কে জুড়েছে। চাটগাঁ দখলের পর সব কটা নালার ওপরে শায়েস্তা খান সেতু, পুল বানান। ঢাকা থেকে চাটগাঁর পথে ছটি খাঁড়ি বা বাহার নৌকা বাহিত হয়ে পেরোতে হয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রীপুরের নদী, সেটি এত বড় যে নৌকোয় একবার পারাপার করতে সারা দিন কেটে যায়।
কর্ণফুলি নদীর তীরে ছোড় বড় কয়েকটি পাহাড় গা ঘেঁসাঘেঁসি পাহাড় রয়েছে। ছোট টিলাটি মাটি থেকে উঠে বড় টিলার সমান হয়ে চাইছে। সব ক’টা পাহাড় গোল আর লম্বা হয়ে উঠে গেছে এবং সবক’টি একসঙ্গে সুরক্ষিতভাবে ঘিরে [চাটগাঁ ] দুর্গ বানানো হয়েছে। এটি আলেজান্ডারের র্যাম্প্যান্টের মত শক্ত এবং এর চূড়াগুলি ফলকউলবুর্জের মত উঁচু। শব্দালঙ্কার দিয়েও পরিখাটির তল পাওয়া মুশকিল [সেটি এত গভীর], ভাবনা দিয়েও সুউচ্চ প্রাচীরের মাথায় পৌঁছনো যাবে না [সেটি এত উঁচু]।
দুর্গের মধ্যে পূর্বদিকে একটি আটফুট চওড়া খানা আছে, এই ধার দিয়েই টিপেরা পাহাড় থেকে নেমে এসে সমুদ্রে পড়া কর্ণফুলি নদী বইছে। পাহাড়ের পশ্চিম এবং কিছুটা উত্তরদিক জুড়ে, এই খানাটির কাছাকাছি একটা বড় এবং দীর্ঘ পুষ্করণী আছে।পাহাড়গুলো এতই আকাশ ছোঁয়া এবং জঙ্গল এতই ঘণ যে এগুলি অতিক্রম করার চিন্তাও মনে উদয় হয় না। দুর্গের মধ্যে দুটি ঝরণা রয়েছে। বরষা মরশুমে ঝর্ণাটির জল কর্ণফুলি নদীতে পড়ে এবং সে সময় এটির প্রস্থ এতই চওড়া হয়ে যায় যে এতে একটি জলবা নৌকো স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারে। বর্ষার সময় ছাড়া দুর্গের বাসিন্দারা ঝরণার জল কর্ণফুলি নদীতে পড়তে দেয় না, জল বেঁধে রেখে তাদের দৈনন্দিনের কাজে ব্যবহার করে। একটি উঁচু স্থানে পীর বদরের আস্তানা রয়েছে। মাজারে আসা ভক্তরা অভুক্ত থেকে পীর বদরের উপাসনা করেন। মগ বিধর্মীরা মাজারের পাশের ওয়াকফ ফরমানওয়ালা গ্রামগুলোয় বসবাস করে। তারা মহান মৃতদের প্রতি উপাসনা করে এবং উপহারও দেয়। যদিও অসম্ভব, কিন্তু কেউ যদি কামানকে দুর্গের পশ্চিম দিকের কোণে টিপেরা পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যেতে পারে, সেই কামানটির গোলাকে দুর্গের বাইরে ছুঁড়ে ফেলা মুশকিল। কর্ণফুলির অন্য দিকে চাটগাঁ দুর্গের উল্টোদিকে, প্রতিরক্ষার জন্যে প্রয়োজনীয় উপকরণ সহকারে একটা উঁচু সুরক্ষিত দুর্গ আছে।
প্রতি বছর আরাকান রাজ সৈন্য আর গোলাবারুদ ভর্তি শতখানের জাহাজ পাঠান নতুন নতুন কার্মকারীর[সেনাপ্রধান] নেতৃত্বে পাঠালে পুরোনো বছরের জাহাজগুলো আরাকানে ফিরে যায়। চট্টগ্রামে আরাকান রাজের বেশ কিছু বিশ্বাসী কর্মঠ প্রতিনিধি চাটগাঁ সরকারের দায়িত্বে থাকে। তিনি নিজের নামে, অধিবাসীদের ব্যবহারের জন্যে সোনার মুদ্রা জারি করেন।
বহু প্রাচীন সময় বাংলার এক সুলতান ফকরুদ্দিন সম্পূর্ণভাবে চট্টগ্রামে বিজয়ী হন। তিনি শ্রীপুর থানার উল্টো দিকে চাঁদপুরে নদী বেড় দিয়ে বাঁধ, আল বানান। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমান আমাদের জানান দেয় ফকরুদ্দিন এখানে মসজিদ এবং মাজার তৈরি করান।
মগেদের হাতে চাটগাঁ
বাংলা যখন মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়ে কানুনগো দপ্তরে নথিভূক্ত হয়, সেই নথিতে চাটগাঁ কে অমিমাংসিত বকেয়া [জেলা] হিসেবে দেখানো হয়েছে। বাংলার মুরাসাদ্দিরা সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া বেতন না দিয়ে কর্মচারীদের চাটগাঁর রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দিত! বাংলার সুলতানের রাজত্বের শেষের দিকে, মুঘলদের বাংলা বিজয়ের প্রথম সময়ে যখন সারা দেশের মানুষ খুবই অনিশ্চিয়তার ঘোরে রয়েছে, সে সময় চাটগাঁ আবার মগদের নিয়ন্ত্রণে গেল। তারা আকাশে কোনও পাখি রাখল না, জমিতে কোনও পশু বাঁচতে দিল না, জঙ্গলের বহর বাড়ল, তার ঘণত্ব চরম বৃদ্ধি পেল। সমস্ত রাস্তা এমনভাবে বন্ধ করেদিল যে সাপও চলতে পারল না, বাতাসও বইতে পারল না। তারা খুব সুরক্ষিত দুর্গ বানাল এবং সেটিরে নিরাপত্তায় রাজকীয় নৌবহর রাখল। বেশ কিছু দিন জায়গাটি দখলে রাখার পর তারা দৃষ্টি দিল বাংলার দিকে। [শায়েস্তা খানের আগে] কোনও সুবাদারই এই সমস্যার সমাধান করে উঠতে পারে নি, তাদের শাস্তিও দিতে পারেন নি। একমাত্র জাহাঙ্গিরের রাজত্বে ইব্রাহিম খান ফতে জং চাটগাঁ দখল করে মগেদের শাস্তি দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন[কিন্তু তাঁর পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়]।
বাংলার মগের মুল্লুকে ফিরিঙ্গি মগ হার্মাদি বন্ধ হল
চাটগাঁ হার্মাদ জলদস্যুদের কার্যকলাপ
সম্রাট আকবরের বাংলা দখলের সময় থেকে শায়েস্তা খানের সুবাদারির আগে পর্যন্ত সময়ে মগ এবং ফিরঙ্গিরা [পর্তুগিজ] নদীপথে আক্রমন করে দশকের পর দশকজুড়ে বাংলায় লুঠতরাজ চালিয়েছে। তারা হিন্দু মসলমান, পুরুষ স্ত্রী, বড় ছোট, ছোটলোক ভদ্রলোক, দুচারজন অথবা বড় দল কোনও কিছু বাছ বিচার না করে ধৃতদের দাস বানিয়ে হাত ফুটো করে সেই ফুটোয় বেতের পাত ঢুকিয়ে, জাহাজের খোলে একের ওপরে অন্যজনকে ডাঁই করে ফেলে রাখত। সকালে বিকেলে তাদের আফোটা চাল ছুঁড়ে দিত ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্যে। দাস বিক্রির এলাকা অবদি নিয়ে যাওয়ার যাত্রায় যারা বেঁচে যেত, তাদের কিছুজনকে গ্রামে নিয়ে জমি চাষে লাগাত, তাদের অপমান করত। অন্যান্যদের দক্ষিণের বন্দরে বয়ে নিয়ে ডাচ, ব্রিটিশ এবং ফরাসী ব্যবসায়িদের বিক্রি করে দিত। কোনও কোনও সময় তারা দাসেদের ওডিসা রাজের অধীনে থাকা তমলুক বা বালেশ্বরে উঁচু দামে বিক্রি করত[কলকাতা থেকে মেছেদা হয়ে সমুদ্র সৈকত দিঘা যাওয়ার পথের নরঘাট নামক জায়গায় মানুষ বিক্রি হত বলে, যায়গারির নাম নরঘাট হয়েছে – বিশ্বেন্দু]।
মগেরা কীভাবে ব্যবসাটা করত
জাহাজ ভর্তি দাস নিয়ে তারা তমলুক বা বালেশ্বরের উপকূলের কিছু দূরে নোঙ্গর ফেলে দাঁড়াত। দাস পৌঁছনোর খবর এবং দাসেদের মূল্যের সংবাদ দিয়ে জাহাজ থেকে কেউ একজন তীরে পৌঁছত। স্থানীয় আধিকারিকেরা দল বেঁধে তীরে দাঁড়িয়ে কাউকে অর্থ দিয়ে হার্মাদদের জাহাজে পাঠাত। হার্মাদেরা যদি মনে করত পাঠানো অর্থটি তাদের মনোমতন তাহলে দাসেদের তারা লোকটির সঙ্গে তীরে পাঠিয়ে দিত।
ফিরঙ্গি হার্মাদেরা দাস বিক্রি করে দিত। মগেরা দাস বিক্রি করত না, দাসেদের তাদের জমি এবং অন্যান্য উৎপাদনের কাজে জুতে দিত। বহু উঁচু জাতের সৈয়দ, বহু সৈয়দ বংশের মহিলা দাসত্বের অবমাননা মেনে নিতে বাধ্য হত, বহু সময় এই সব মানুষের রক্ষিতা(ফরাসওয়াসুহাবত) হয়ে জীবন কাটিয়ে দিত। এই সব অঞ্চলে মুসলমান যে ধরণের অসম্মান সহ্য করেছে, সেটা ইওরোপে তাদের সহ্য করতে হয় নি। বহু সুবাদারের রাজত্বে এই ঝামেলা বাড়ত, কিছু সুবাদারের সময়ে কমত – কিন্তু কোনও সুবাদারই এই অত্যাচার থামাতে পারেন নি।
হার্মাদ, মগেরা যেহেতু বহুকাল ধরেই লুঠ এবং দাস ব্যবস্থা চালু রেখেছিল, তাই তাদের এলাকায় জনসংখ্যা বাড়তে শুরু করে এবং বাংলায় জনসংখ্যা দ্রুতহারে কমতে থাকে। ঢাকা থেকে চাটগাঁর মধ্যের দিয়ে বয়ে চলা নদীগুলোর দুপাশে পরিবারের সংখ্যা কমতে থাকে। একদা বাংলার একটি জেলা বাঙ্গালা(ঢাকার একাংশ এবং বাকেরগঞ্জ) সাধারণভাবে অতীতে শাহী সরকারকে সুপুরির ব্যবসায় বিপুল পরিমানে রাজস্ব দিত। কিন্তু দাস ব্যবসায়ীরা এই অঞ্চল জুড়ে দাসত্বের আগুণ ঝাড়ু, লুঠ এবং মানুষ দখলে নেওয়ার কাজ এমন তীব্রভাবে চালাতে শুরু করে যে এই অঞ্চলে একটাও বাড়িতে আগুণ জ্বালাতে কোনও মানুষ পড়ে রইল না[সক্কলে এলাকা ছাড়া হল। এই এলাকার নাম হল মগের মুল্লুক – বিশ্বেন্দু]। অবস্থা এমন হল যে ঢাকার প্রশাসকের সমস্ত উদ্যম ব্যয় হতে থাকল ঢাকার নিরাত্তার দিকে নজর দিতে এবং জলসস্যুরা যাতে ঢাকার উপান্তে না আসতে পারে তার জন্যে ঢাকার নালাগুলো লোহার শৃংখল দিয়ে বেঁধে রাখা হল এবং শহরের নদী, খালগুলোয় অসংখ্য বাঁশের(নাই) সেতু তৈরি করতে হল।
বাংলার নৌবাহিনীর হতাশা
হয়ত শুনতে বাড়াবাড়ি মনে হবে, তাও বলা দরকার, মগ-হার্মাদদের হামলা নিয়ে বাংলা সুবার নাওয়ারা দলের নাবিকেরা এতই আতঙ্কে থাকত যে ১০০ দলের মুঘল নাওয়ারা বাহিনী যদি ৪টি হার্মাদ-মগ শত্রু জাহাজ দেখত, এবং তাদের মধ্যে দূরত্ব যদি খুব বেশি থাকত, তাহলে বাংলার জাহাজগুলি খুব লড়াই করার ভান করত এবং মনে করত তারা খুব লড়াই দিয়েছে। দূরে দাঁড়িয়ে লড়াই লড়াই খেলাকে তারা জয় বলে অভিহিত করত। নিজেদের বীরত্বে উজ্জীবিত হত। কিন্তু দুই দলের মধ্যে যদি দূরত্ব কম হত, এবং শত্রুর হাতে তারা অবশ্যম্ভাবীভাবে যুদ্ধ ছেড়ে ছুড়ে, নাবিক, হাল বওয়া মাঝি এবং অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত সেনারা মগ-হার্মাদদের হাতে ধরাপড়ার ভয়ে জাহাজ ছেড়ে জলে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যেত।
শাহ সুজার নাওয়ারা বাহিনীর সেনানায়ক জনৈক আশুর বেগ একদা ২০০টি নৌকো নিয়ে নদীতে টহল দিচ্ছিলেন। দূরে হার্মাদ দলের শাহী বাহিনীর এক দশমাংশ আকারের শত্রুর নৌকো দেখা গেল। তাদের দেখেই আশুর বেগ ভয়ে থরহরিকম্পমান; তীব্র উত্তেজিত আশুর বেগ চিৎকার করে জাহাজের মাঝি বা প্রধানকে বললেন ‘আলি ভাই আশ বেদেহ(আমায় ঝোল দাও)! মাঝি বিভ্রান্ত হয়ে উত্তর দিল ‘হে প্রধান সেনাপতি, আমি এই সময় ঝোল কোথা থেকে পাব? কিছুক্ষণ পরে হার্মাদেরা আমাদের সক্কলকে সুন্দর ঝোল বানিয়ে খাওয়াবে’। প্রচন্ড উত্তেজিত এবং পাগলপারা হয়ে কাঁদতে কাঁদতে আশুর বেগ বলতে লাগল ‘ওরে বিভ্রান্ত সেনা, আমায় ঝোল দে’ এবং মাঝিও বলতে লাগল ‘আমার সঙ্গে ঝোল নেই। আমি কোথা থেকে পাব?’। ঘটনা হল সেনারা যুদ্ধের সময় নির্দেশ দিয়ে বলত ‘নাও ভাল করে সামলাও’। ভয়ঙ্করভাবে ভীত হয়ে আশুর বেগ সে সব নির্দেশ ভুলে গিয়ে ঝোল চাইতে শুরু করে – এমনই ছিল তাদের প্রভাব।
মোঘল সাম্রাজ্যের অন্য কোনও সীমান্তের বিধর্মী কোনও রাজাই মুঘল বাহিনীকে এতটা আতঙ্কিত করে রাখতে পারে নি; বরং বিধর্মী রাজারা তাদের প্রজা, জমি, ধনসম্পদ রক্ষা করতে মুঘলদের কাছে মাথা নামিয়ে থেকেছে এবং মুঘলেরা প্রায় বিনা বাধায় একের পর এক এলাকা দখল করেছে। বাংলাতেই উল্টো ঘটনা ঘটল। যে সব সুবাদারের শাসনে হার্মাদেরা কম আঘাত হানত, তারা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করত। কোনও প্রশাসকই এই শয়তান আদিবাসীদের অত্যাচার, লুঠ, দখলদারি রোখার চেষ্টা করে নি, দিনের পর দিন তাদের চাপের কাছে মাথা নামিয়েছে এবং নিজেদের [ভুল] অক্ষমতাকেই জাহির করেছে।
হার্মাদদের পথ
জাহাঙ্গিরের সময় মগেরা ঢাকায় অত্যাচার এবং মানুষ্য হরণ করতে আসত খিজিরপুরের মধ্যে দিয়ে ঢাকার দিকে আসা ব্রহ্মপুত্রের নানান নালা বাহিত হয়ে। ব্রহ্মপুত্রের একটি সরু আলদেওয়া খাঁড়িতে খিজিরপুরের অবস্থান। বসতিগুলো ছাড়া গোটা এলাকা বর্ষা মরশুম এবং শীতে জলে ডুবে থাকত। এই সময়টা হার্মাদেরা দল বেঁধে সেখানে যেত এবং থানাগেড়ে বসত। কিছু বছর পরে নালাগুলি শুকিয়ে গেল এবং ব্রহ্মপুত্রের ওপরে হার্মাদদের যাত্রাপথ হেঁটে পার হওয়া যেত। ফলে হার্মাদদের জন্যে এই দিকের জলপথটা বন্ধ হয়ে গেল এবং যাত্রাপুর এবং বিক্রমপুরের দিকদিয়ে ঢোকার পথটাও হার্মাদদের জন্যে অনেকটা সীমাবদ্ধ ছিল। পরের দিকে ঢাকার অন্যান্য অঞ্চল এবং পরগণায় অবাধে হার্মাদেরা হানা দিতে পারত বলে, তারা ঢাকা শহরে লুঠপাট করতে চেষ্টা করত না।
বাংলা লুঠ এবং মানুষ হরণ করতে তারা চাটগাঁ থেকে বেরিয়ে শাহী সরকারের আংশিক নিয়ন্ত্রণে থাকা ভুলুয়া হয়ে, যার ডান দিকে সন্দ্বীপ দ্বীপ এবং বাঁ দিকে দিলাবর জমিদারের নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চল পেরিয়ে সংগ্রামগড় পৌঁছত। এখান থেকে তাদের যদি যশোর, হুগলী এবং ভূষণা লুঠের ইচ্ছে থাকত তাহলে গঙ্গা দিয়ে এগোত; আর যদি তারা বিক্রমপুর, সুনারগাঁও এবং ঢাকা লুঠ করতে চাইত তাহলে ব্রহ্মপুত্র ধরে এগোত। সংগ্রামগড়[প্রথম অনুবাদক যদুনাথ মন্তব্য করছেন, রেনেলের মানচিত্রে সংগ্রামগড়ের চিহ্ন নেই। আলমগিরগড় বিষয়ে ৯৪৩ পাতায় এবং বলা হয়েছে এই অঞ্চলের নাম পরিবর্তন করে আলমগিরগড় হয়েছে এটি শ্রীপুরের ২১ কোশ দূরে(৯৪৪ পাতা), এটা যতদূরসম্ভব রেনেলের মেন্দিগঞ্জ। কাফি খান একে সংগ্রামগড় বলেছেন] অবস্থিত বদ্বীপ অঞ্চলের খুবই প্রান্ত এলাকায় যেখানে ঢাকা এবং অন্যান্য গ্রান শহরের অবস্থান। এটি গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। নদী দুটি একসঙ্গে প্রবাহিত হয়ে ভুলুয়া আর সন্দ্বীপ পার করে সমুদ্রের সঙ্গে মিশেছে। প্রাচীনকালে এখানে সংগ্রাম নামক কোনও এক ব্যক্তি একটি গড় বা দুর্গ তৈরি করেছিল। এই দুই নাম জুড়ে তৈরি হয়েছে সংগ্রামগড়। এখানে যদি একটি সুরক্ষিত দুর্গ তৈরি করা যেত, তাতে যদি অস্ত্রশস্ত্র সৈন্য বাহিনী এবং সুরক্ষার নানান হাতিয়ার থাকত এবং একটি বড় নাওয়ারা বাহিনী একে নিরাপত্তা দিত, তাহলে বাংলায় মগেদের অত্যাচার কিছুটা হলেও রোখা যেত।
ফিরঙ্গি জলদস্যু
বহু ফিরঙ্গি চট্টগ্রামে আনন্দসহকারে বাস করত এবং সরকারের পক্ষ থেকে মুঘল শাহী এলাকায় মানুষ এবং সম্পদ লুঠের কাজে আরাকানিদের সহায়তা করত[টিকায় যদুনাথ লিখছেন, তারা যে অঞ্চলে বাস করত তার নাম ফিরঙ্গি বন্দর বা শুধুই বন্দর; এটা কর্ণফুলি নদীর দক্ষিণ পাড়ে সঙ্গমস্থলের খুব কাছেই অবস্থিত]। তাদের লুঠের অর্ধেক সম্পদ আরাকান রাজার জন্যে বরাদ্দ ছিল। এই গোষ্ঠীকে বলা হত হার্মাদ[টিকায় যদুনাথ লিখছেন, শব্দটা আরমাদ, যেটি আরমাডার কথ্যরূপ। আরমাদ শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে কালিমতইতাইবাত-এ]। এদের যুদ্ধ সরঞ্জাম সাজানো অতি তীব্রগতির ১০০ জলবা নৌকোর বাহিনী ছিল। বাংলার সুবাদার[নবাবও বলাহত] এদের লুঠ কাজে খুবই বিব্রত ছিলেন। তাঁদের দুর্বলতার জন্যে হার্মাদদের নিরন্তর হামলা রোখা সম্ভব হচ্ছিল না। হার্মাদেরা আরাকান রাজার বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল ছিল না, তাই আরাকান রাজা মুঘল ভূখণ্ড[বাংলা] লুঠ করতে তাদের বাহিনী পাঠাত না। আরাকানেরা ফিরঙ্গিদের সঙ্গে ভৃত্যের মত ব্যবহার করত এবং তাদের লুঠের ভাগ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকত।
১৬৬৫র ডিসেম্বরের শীতে [হার্মাদদের প্রতি আরাকান রাজার বিশ্বাসঘাতকতা আর শায়েস্তা খান হার্মাদদের প্রতি আলাপ আলোচনার যে হাত বাড়িয়ে দেন, তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে] ৪২টা জালবা নৌকো ভর্তি করে ফিরিঙ্গিরা পরিবারবর্গ নিয়ে নোয়াখালির মুঘল থানাদার ফরহদ খানের আশ্রয়ে অভিবাসিত হয়। ফরহদ খান, ফিরিঙ্গিদের নোয়াখালিতে উদারচিত্তে এবং দায়শীল মনোভাবে রেখে তাদের প্রধান মুর এবং আরও কয়েকজনকে ঢাকায় শায়েস্তা খানের দরবারে পাঠান। শায়েস্তা খানের দরবারে তাদের রাতেই অপূর্ব খেলাত পরিয়ে সম্বর্ধনা এবং অন্যান্য অপ্রত্যাশিত উপহার সামগ্রি দেওয়া হয়। নবাব তাদের প্রশ্ন করলেন ‘মগ জমিদারেরা তোমাদের কত মাইনে নির্ধারণ করেছিল?’ ফিরঙ্গিরা উত্তর দিল, ‘সমগ্র মুঘল রাজ্যটাকেই আমাদের মাইনে হিসেবে ওরা উতসর্গ করেছিল। আমরা বাংলাকে জায়গির হিসেবে ভেবে নিয়েছিলাম। বছরে ১২ মাস আমরা কোনও বাধা ছাড়াই রাজস্ব সংগ্রহ[লুঠ] করতাম। আমাদের কোনও আমিলও ছিল না অথবা আমিনও ছিল না; আমাদের রোজগারের অংশ কাউকে দিতেও হত না। জলের আমরা [জল] পথে সমীক্ষা করি। আমাদের রাজস্ব[লুঠ] কোনও দিন বাকি থাকে নি। যে সব গ্রামে বিগত ৪০ বছর লুঠ করেছি, তার সমস্ত নথি আমাদের কাছে আছে’। এই বক্তব্য থেকে হার্মাদদের ভাবনা এবং বাংলা সরকারের দৌর্বল্য বুঝতে পারি।
ফিরঙ্গিদের আত্মসমর্পনে বাংলার মানুষ নিশ্চিন্ত হল। নবাবের পক্ষ থেকে ফিরিঙ্গিদের ২০০০ টাকা দেওয়া হল এছাড়াও সাম্রাজ্যের তোষাখানা থেকে মুরকে মাসে ৫০০টাকা এবং অন্যন্যদের ইচ্ছেপূরণ করা ভাতা দেওয়া হল।
এইভাবে বাংলায় ফিরিঙ্গি মগ হার্মাদি বন্ধ হল।
চাটগাঁ বিজয়, ১৬৬৬খ্রি
শাহ সুজার নবাবির সময় নাওয়ারা দেখাশোনা করার জন্যে যে পরগণাটির রাজস্ব বরাদ্দ করা হয়েছিল, সেই পরগণাটির মুতাসাদ্দিদের[করণিক] ঘুষখোরি, অত্যাচারে কোনও আদায়ই ঢাকার খাজাঞ্চিতে জমা হত না। নাওয়ারার সেনানায়কদের অধিকাংশ চরম দারিদ্রে ডুবেছিল। তারা যেহেতু নিজেরাই জীবনধারণে অক্ষম হয়ে পড়ে, এবং নবাবের এ বিষিয়ে খুব বেশি উৎসাহ না থাকায়, সামগ্রিকভাবে নৌবহরটি ধ্বংস হয়ে যেতে থাকে। মীর জুমলা বাংলায় নবাব হলে ধ্বংস হতে বসা বাংলার নাওয়ারা গড়ে তোলার জন্যে ১৪ লক্ষ টাকার নতুন বন্দোবস্ত করেন। তিনি শাহ সুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে বুঝেছিলেন বাংলার সেনাবাহিনীতে নাওয়ারর গুরুত্বটি। তিনি যখন নাওরার পুরোনো ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন ব্যবস্থা নাওয়া কাঠামো গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছেন, সে সময় দুর্ভাগ্যবশত আসাম অভিযানে প্রাণ হারান। আসামে তার সঙ্গে বহু নাওয়ারা সেনানায়কের মৃত্যু ঘটে। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলার নাওয়ারার কাঠামো প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়।
[১৬৬৪র শুরুর দিকে] ঢাকার অধীনস্থ বাগাদিয়া জমিদারিতে হার্মাদেরা আক্রমন চালিয়ে, মুনাব্বর খানকে পরাজিত করে। ঘটনাটা হল, সে সময় বাগদিয়ায় প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া কিছু ভাঙাচোরা নৈকো ইত্যাদির কাঠামো নিয়ে নাওয়ারা অধ্যক্ষ, সদরইসাইরাব উপাধিদার হিসেবে পাহারায় ছিলেন জমিদার মুনাব্বর খান। হার্মাদদের আক্রমণের সংবাদে তার বাহিনী পালিয়ে যেতে থাকে। এই সংবাদে শায়েস্তা খানের পুত্র, নায়েব-নাজিমের সহকারী, ঢাকার ফৌজদার আকিদত খান, ইসমাইল খান তারিন এবং অন্যান্য নবাবি সেনাপতিকে মুনাব্বর খানের সাহায্যে পাঠান। এই বাহিনী, ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া মুনাব্বর খানের বাহিনীকে ফিরিয়ে আনে। ইসমাইল খান আর তার বাহিনী নতুন করে যুদ্ধ শুরু করলেন দেখে মুনব্বর খান নতুন করে তার ভাঙাচোরা বাহিনীকে নিয়ে যুদ্ধ শুরু করলেও, হার্মাদদের দেখে নৌকোর সেনারা জলে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। একটি মাসকেটের গুলি লাগে ইসমাইল খানের পায়ে। নাবিকহীন নৌকোটি ভাসতে ভাসতে তীরে পৌঁছলে সেনাপতির প্রাণ বেঁচে যায়। নাওয়ার সব নৌকো ধ্বংস হয়ে যায়।
হার্মাদি রুখতে শায়েস্তা খানের ভাবনা
১৬৬৪র ৮ মার্চ ঢাকার নতুন নায়েব নাজিম বাংলার পশ্চিমাংশের রাজধানী রাজমহলে প্রবেশ করেন। সেখানে তাকে জানানো হল বাংলার নাওয়ার হালত এবং বিপক্ষের জোরের জায়গাটি। তিনি বিষয়টি বুঝে নাওয়ারার দারোগা, মহম্মদ বেগ আবাকাশকে নির্দেশ দিলেন নাওয়ারা গড়ে তোলার পরিকল্পনা তৈরি করতে। একই সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে এবং মহম্মদ বেগের প্রস্তাবগুলী গ্রহণ করতে আকিদত খানকে পত্র লিখলেন। তিনি মহম্মদ বেগের পরামর্শে কাজি সামুকে নাওয়ার মুশারফ নিয়োগ করে তাদের খেলাত এবং নানান উপহার দিয়ে দিয়ে ঢাকা পাঠালেন। নাওয়ারা গড়ে তোলার কাজের প্রধান প্রয়োজন ছিল কাঠের যোগান আর নৌকো তৈরি আর সারাইএর কাঠামো বিস্তার। প্রতিটা জেলার প্রতিটা মাউসায় যেখানে কাঠের যোগান সুপ্রতুল সেখানে গোমস্তার[নুহাসাল] হাতে পরওয়ানা পাঠিয়ে প্রচুর সূত্রধর আর কাঠ ঢাকা পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হল। হুগলী, বালেশ্বর, মুরাং, চিলমারি, যশোর আর খড়িবাড়ি [এবং অন্যান্য এলাকায়] যেখানে নাওয়ারা তৈরি করার কাঠামো রয়েছে, সেখানে যতটা পারা যায় নৌকো তৈরি করে ঢাকায় পাঠাতে নির্দেশ পাঠানো হল। নবাব তার দরবারে ডাচেদের নৌ সেনানায়কের[ক্যাপ্টেন] সঙ্গে কথা বললেন, ‘তোমরা প্রত্যেক বছর বাংলায় প্রায় কোনও শুল্ক না দিয়ে বিপুল পরিমান অর্থের ব্যবসা কর। হার্মাদদের কারনে বাংলায় হিন্দু আর মুসলমান ব্যাপারি আর শ্রেষ্ঠীদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তোমরা যাদের ওপর নির্ভর করে ব্যবসা আর লাভ কর, তাদের সুরক্ষায় তোমরা প্রয়োজনে তোমাদের দেশ থেকে জাহাজ আনিয়ে মগেদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে শাহী সেনাকে সাহায্য কর। আরাকানে তোমাদের যত কুঠি আছে বন্ধ করে দাও। এটা যদি না করতে পার, তাহলে জেনে রাখ, সাম্রাজ্য জুড়ে তোমাদের ব্যবসা, যাতায়াত এবং যে লভ্যাংশ তোমরা পাচ্ছ সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে। ডাচ সেনানায়ক উত্তর দিল, ‘এই গুরুত্বপূর্ণ এবং মহান প্রস্তাবে আমার একমত না হয়ে উপায় নেই, কিন্তু আমাদের কর্তাদের[ডাচ ইন্ডিজের গভর্নর জেনারেল] নির্দেশ ছাড়া আমি একপাও এগোতে পারি না। আমি তাঁর সম্মতি পাওয়ার জন্যে আপনার প্রস্তাবগুলো অবশ্যই লিখে পাঠাব’। সেনানায়কের এই সানুনয় নিবেদনে নবাব একমত হয়ে বললেন ‘যত শীঘ্র সম্ভব উত্তর পাওয়ার জন্যে প্রস্তাবটি লিখে পাঠাও’। তিনি সেনানায়ককে এ বিষয়ে একটি পরওয়ানা এবং ডাচ কর্তার জন্যে উপহার আর সম্মান জানাতে একটি রত্নখচিত তরোয়ালের খাপ আর একটি খেলাত দিলেন। তবে সর্বশক্তিমানের ইচ্ছায় ডাচেদের সামরিক সাহায্য শাহী সেনাবাহিনীর প্রয়োজন হয় নি।
আরাকানের জমিদারের প্রত্যক্ষ্য সহায়তায় ফিরিঙ্গিরা চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করে বাংলা জুড়ে ডাকাতি, অপহরণ এবং লুণ্ঠন চালাত। বাংলা লুঠের কিছু অংশ তারা আরাকান জমিদারের সঙ্গে ভাগ করে নিত। বাংলার নবাব তার এক বিশ্বস্ত আমলা শেখ জিয়াউদ্দিন ইউসুফকে দারোগা হিসেবে লাঢিকল[রেনেলের মানচিত্রে চাঁদপুরের কাছে] বন্দরের দায়িত্ব দিয়ে পাঠান; বন্দরটি ঢাকার কাছে এবং এখান থেকে ফিরঙ্গি ব্যবসায়ীরা বসতি স্থাপন করে লবন ব্যবসা চালাত। তিনি জিয়াউদ্দিনকে বলে পাঠিয়েছিলেন, এই ফিরঙ্গিরা যেন চাটগাঁর হার্মাদ ভাইদের শাহী সাহায্য এবং সম্মান দেওয়ার এবং প্রয়োজনে মুঘল সেনাবাহিনীতে কাজ দেওয়ার প্রস্তাবটি লিখে পাঠায়, সেই ব্যবস্থাটা তাকে করতে হবে। জিয়াউদ্দিন তাদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ চিঠি লিখতে থাকেন।
শায়েস্তা খান নতুন নাওয়ারা বাহিনী তৈরি করলেন
১৬৬৪র ১৩ ডিসেম্বর শায়েস্তা খান ঢাকায় প্রবেশ করলেন। তার সমস্ত ইচ্ছে শক্তি, পরিকল্পনার বুদ্ধি তখন নিয়োজিত ছিল নাওয়ারা বাহিনী গড়ে তোলার কাজে; একটি মুহুর্তও তিনি নাওয়ারা তৈরির পরিকল্পনা ভুলে থাকতেন না; সারাক্ষণ তিনি বাহিনীর প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি, বাহিনীর নিয়মিত রসদ সরবরাহ পরিকল্পনা, বাহিনীর চাহিদা মেটানো, জাহাজ তৈরি কাঠামো তৈরি, বিশাল বিশাল জাহাজ তৈরির ভাবনা এবং সেগুলি তৈরির উপকরণ জোগাড় ইত্যাদি মাথায় রাখতেন। নবাবের খুব পুরোনো বিশ্বস্ত, যুদ্ধ-পরীক্ষিত, জ্ঞানী, দক্ষ এবং বৃদ্ধ মনসবদার হাকিম মহম্মদ হুসেইন জাহাজ তৈরি পরিকল্পনার কাজে নিয়োজিত হলেন। নাওয়ারার মুশারফ কাজি সামুকে নিয়োগ করা হল হাকিম মহম্মদ হুসেইনএর সহকারী হিসেবে। শায়েস্তা খান যখন আসমে অভিযানে যান, তখন তিনি ঢাকার নাওয়ারা বাহিনী রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছিলেন দক্ষ, বিশ্বাস্ত, চতুর এবং সারাক্ষণ কাজের মধ্যে ডুবে থাকা বাংলার আমলা কাজি সামুকে। নাওয়ারা পরগণা আর নাওয়ার আমলা আর কর্মচারীদের জায়গিরগুলো থেকে রাজস্ব আদায়ে দায়িত্ব দেওয়া হল শাহী, নানান খবর রাখা আমলা করণিক কিশোর দাসকে। নাওয়ারা দপ্তরের প্রত্যেকটি পদে দক্ষ কার্যকর আধিকারিক নিয়োগ করা হল। নবাবের প্রত্যক্ষ নজরদারিতে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ৩০০টি সুসজ্জিত জাহাজের নাওয়ারা বাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হল নায়েব-নাজিমের দপ্তর। সে সব আমলা মীর জুমলার প্রয়াণের পরে বিধ্বস্ত অবস্থায় দিন কাটাতেন, তারা শায়েস্তা খানের উদ্যমের পরিবর্তনের প্রভাব অনুভব করতে পারছিলেন।
যুদ্ধের বুনিয়াদ নির্মাণ
সংগ্রামগড়ে গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্রের মিলন ঘটেছে। নবাব হুগলির ফৌজদার মহম্মদ শরিফকে বড় বাহিনী, আমলা এবং অস্ত্র দিয়ে সংগ্রামগড়ের থানাদার নিযুক্ত করলেন এবং তাকে যথেষ্ট রসদ ব্যবহার করে সেখানে একটা কেল্লা তৈরি করতে নির্দেশ দিলেন। ২০০টি নৌকোর বাহিনী নিয়ে আবুল হাসানকে সেখানে নিয়োগ করা হল নদীতে টহল দিতে এবং অগ্রগামী শত্রুবাহিনীকে বাধা দিতে। ১০০টি নৌকো দিয়ে মহম্মদ বেগ আবাকাশকে ধাপায় থানা গাড়তে এবং যদি শত্রু আবুল হাসানের ওপর আক্রমন করে তাহলে তাকে সাহায্য করার জন্যে।
ধাপা[রেনেলের মানচিত্রে ধাপা কি কিলা] থেকে সংগ্রামগড় অবদি বড় শক্তপোক্ত ১৮ কোসের রাস্তা, আল তৈরি করা হল যাতে বর্ষাতেও ঘোড়া এবং পদাতিক বাহিনীর ঢাকা থেকে সংগ্রামগড়ে যাতায়াতে অসুবিধে না হয়।
সংগ্রামগড় এবং চাটগাঁর মাঝামাঝি সন্দ্বীপের অবস্থান। মুঘল বাহিনীর গড় হিসেবে সন্দ্বীপের ভূমিকা অনন্য। চট্টগ্রামে বাহিনী নিয়ে অভিযানের আগে তিনি পরিকল্পনা মাফিক জমিদারিটি দিলাবর খানের থেকে দখল নেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। ১৬৬৫র ১২ নভেম্বর সন্দ্বীপ দখল নিয়ে সেখানে মুঘল থানা তৈরি করা হল।
মুঘল বাহিনীতে ফিরঙ্গিদের যোগদান
বাংলায় নায়েব-নাজিম হয়ে আসা থেকে শায়েস্তা খানের মাথায় ফিরঙ্গি হার্মাদদের হয় তাদের মন জিতে, না হয় তাদের ধ্বংস করে, তাদের কাবু করার পরিকল্পনা ভাঁজছিলেন। আমরা আগেই জানিয়েছি তাঁর পরিকল্পনার প্রথম রণনীতিটি ছিল জিয়াউদ্দিন ইয়ুসুফকে ফিরিঙ্গদের মন জয় করতে পাঠানো। নবাবের সঙ্গে সাক্ষাতে আসার জন্যে জিয়াউদ্দিন তাদের নিয়মিত চিঠি লিখতেন। নবাব যখন [রাজমহল থেকে] ঢাকার দিকে আসছিলেন, তখন হুগলীর [পর্তুগিজ?] ক্যাপ্টেন রাস্তায় তার সঙ্গে দেখা করে। নবাব তাকে নানান সম্মান জানিয়ে চাটগাঁয়ে ফিরঙ্গি দস্যুদের নবাবি বাহিনীতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে চিঠি লিখতে বললেন। চাটগাঁয়ে এতসব ধরণের চিঠি পৌঁছনো, নবাব বাহিনীর সন্দ্বীপ দখল করে থানা তৈরি ইত্যাদি খবর চরেরা আরাকান রাজাকে দিতে থাকল। খবরে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আরাকান রাজ চাটগাঁয়ের প্রশাসক তার ভাইপোকে ব্যাপারটা গোপনে বিশদে খোঁজ নিয়ে চাঁটগাঁ এবং তার কেল্লা ইত্যাদির নিরাপত্তা এবং ফিরঙ্গি হার্মাদদের মন ভোলানোর নির্দেশ দেয়। রাজা ফিরিঙ্গিদের পরিবারবর্গকে আরাকানে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়ে প্রশাসককে জানায় আকারান রাজ খুব তাড়াতাড়ি চাটগাঁয়ে সম্পূর্ণ সুসজ্জিত যুদ্ধ জাহাজ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। তার মনে হচ্ছিল মুঘল পক্ষ যেহেতু ফিরঙ্গিদের মন জেতার চেষ্টা করছে, তাই ফিরঙ্গিদের মহিলা শিশুদের আরাকানে এনে নিজেদের জিম্মায় নিলে সুযোগ মত তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। মুঘল বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্যে একের পর এক চিঠি চাটগাঁয়ে পৌঁছনো এবং মুঘল বাহিনীর সন্দ্বীপ দখল করে থানা তৈরির সংবাদে ফিরঙ্গিদের মন ভয়ে এবং আশায় ভরে উঠল, এবং তারা ৪২টা জলবা নৌকো করে নোয়াখালিতে ফরহদ খানের আশ্রয়ে পৌঁছয়[আলমগিরনামার ৯৪৬ পাতায় লেখা হচ্ছে, ‘ফিরিঙ্গিরা [আরাকানিদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা] জানতে পেরে, আরাকানিদের বিরুদ্ধে লড়াই করল এবং বেশ কিছু জাহাজ জ্বালিয়ে দিল এবং বাংলার বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্যে তাদের সমস্ত রসদ সহায় সম্বল জাহাজ নিয়ে বাংলার নবাবের বাহিনীতে যোগ দিতে রওনা হয়ে গেল। ১৬৬৫র ১৯ ডিসেম্বর কামান, বন্দুক অন্যান্য অস্ত্র সজ্জিত হয়ে এবং তাদের পরিবারবর্গসহ সমস্ত ফিরঙ্গি ৫০টি জলবা ভর্তি করে নোয়াখালি পোঁছল’]।
অবলম্বে আক্রমনের পরিকল্পনা তৈরি হল
ফিরঙ্গি নেতা ক্যাপ্টেন মুর নবাবের সমক্ষে বললেন, ‘আরাকানিদের আত্মগর্ব এবং গাধামোর জন্যে রাজা এবং তার পরামর্শদাতারা চাটগাঁয়ে আরাকানি নিরাপত্তার বেড়াজাল আর কেল্লায় যুদ্ধ উপকরণের ঘাটতি পূরণ করছিল না, তারা [নিরাপত্তা বিধানের জন্যে] আমাদের ওপর ভরসা করত। কিন্তু তারা মুঘলদের সন্দ্বীপ দখলের সংবাদ পাওয়া থেকেই সচেতন হয়ে [চাটগাঁয়ের নিরাপত্তার জন্যে] বড় সৈন্যদল তৈরির নির্দেশ দিয়েছে। যদি নিরাপত্তা বেড়াজাল তৈরি করার আগেই মুঘল বাহিনী আক্রমন করে তাহলে চাটগাঁ দখলের সুফল মিলতে পারে’। চাটগাঁ দখলের পরিকল্পনা সারাক্ষণ নবাবের মাথায় থাকায়, তিনি বুঝতে পারলেন ফিরঙ্গি নেতার বক্তব্যে সারবত্তা রয়েছে, এবং যেহেতু ফিরঙ্গিরা মুঘল বাহিনীতে যোগ দিয়েছে, তার ফলে শাহী বাহিনীর জয়ের সুযোগ অনেক বেড়ে গেছে। তিনি এই সুযোগ হাতছাড়া হতে দিতে রাজি হলেন না।
মুঘল বাহিনীর সীমান্ত জগদিয়া থেকে চাটগাঁর দূরত্ব ৩০ কোস এবং পথটিতে বসতির কোনও চিহ্ন নেই। আক্রমনকারী বাহনী যতক্ষণ না চাটাগাঁয়ে পৌঁছচ্ছে, অবরোধ কায়েম করছে এবং শহর দখল করছে, তাদের রসদ সরবরাহ করে যেতে হবে বাংলা ভূমি থেকেই। বাংলার সেনারা যেহেতু মগেদের নামে ভীত-সন্ত্রস্ত তাই জলপথে রসদ পৌঁছনোর ভাবনা ত্যাগ করা হল, যদিও এই প্রদেশে নৌকো ছাড়া রদসদ পাঠানোর অন্য কোনও উপায় নেই। তাই জাহাঙ্গিরের রাজত্বে ইব্রাহিম খান ফতেহ জঙ্গ, চাটগাঁ আগ্রমনের পরিকল্পনার দুবছর আগেই ভুলুয়া আর জগদিয়া থেকে রসদ পাঠানোর পরিকল্পনা ছকে নিয়েছিলেন।
বাহিনীর গড়ন
ঠিক হল নবাবের পুত্র বুজুর্গ উম্মিদ খানের ৪০০০ বাহিনী চাটগাঁ অভিযানের নেতৃত্ব দেবেন আর [ঢাকা থেকে] নবাব রসদ সরবরাহের বিষয়টি স্বয়ং নজরদারি করবেন। যদি অবরোধ দীর্ঘ কাল ধরে চলতে থাকে তাহলে তিনি অবস্থা বুঝে পুত্রের বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেবেন। ২৪ ডিসেম্বর ১৬৬৫[আলমগিরনামার ৯৪৮ পাতায় যাত্রার কথা ২৫ তারিখ উল্লেখ করে বাহিনীর গঠন সম্বন্ধে বলা হয়েছে, ‘বুজুর্গ উম্মিদ খানের ২০০০ বাহিনী, নবাবের নিজস্ব তাবিনান[অনুগামী], সৈয়দ ইখতিয়াস খান বারহা, সুবল সিংহ শিশোদিয়া, মীনা খান, করন খাজি এবং অন্যান্য’] যাত্রার জন্যে শুভ মুহূর্ত নির্ধারণ করে বুজুর্গ উম্মিদ খান ঢাকা থেকে রওনা হলেন। তার অধীনে গেলেন ইখতিয়াস খান, ২৫০০ সেনা [১০০০ অতিরিক্ত], সরআন্দাজ খান, ১৫০০ সেনা [৮০০ অতিরিক্ত], ফরহাদ খান, ১০০০ সেনা [১৫০ অতিরিক্ত], কারাওয়াল খান ১০০০ সেনা [৮০০ অতিরিক্ত], রাজা সুবল সিংহ শিশোদিয়া ১৫০০ সেনা [৭০০ অতিরিক্ত], ইবন হুসেইন, নাওয়ারার দারোগা, ৮০০ সেনা [অতিরিক্ত ২০০], মীর মুর্তাজা, গোলাবারুদের দারোগা ৮০০ সেনা [১৫০ অতিরিক্ত বাহিনী] এবং অন্যান্য শাহী আমলা নিয়ে বিশেষ কিছু কাজ করা ছাড়া তাদের সব নগদী এবং আহদি অনুগামী আর নবাবের মাইনে করা ২৫০০ বাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু হল। সব আমীর, মনসবদার, সর্দার এবং জমাদারের শ্রেণী অনুযায়ী খেলাত, ঘোড়া, তরোয়াল এবং ঢাল দিয়ে সম্মান জানানো হল। মীর আবদুল ফাতাহকে দেওয়ান নিযুক্ত করা হল, মহম্মদ খলিল হলেন বক্সী আর বাহিনীর সংবাদলেখক। ঢাকা থেকে মীর মুর্তাজা এবং সন্দ্বীপ থেকে ইবন হুসেইন, মহম্মদ বেগ আবাকাশ, মুনাব্বর খান জমিদার এবং নাওয়ারার অন্যান্য জমিদার, নবাবের সেনার জমাদার হায়াত খান, যিনি সন্দ্বীপ দখলের বাহিনীতে ছিলেন, তাদের সকলকে নোয়াখালি গিয়ে ফরহাদ খান এবং ক্যাপ্টেন মুর এবং অন্যান্য ফিরঙ্গি বাহিনী, যারা চাটগাঁও থেকে ঢাকায় এসে শাহী বাহিনীতে যোগ দিয়েছে, তাদের সঙ্গে রাজপথ এবং জলপথে যোগ দিতে বলা হল।
ঘোড়াঘাটে মোতায়ন থাকা আশকর খান ঢাকায় ফিরে এলেন[আলমগিরনামায় বলা হয়েছে, কমল, প্রাক্তন আরাকানি রাজপুত্র, যিনি শাহজাহানের সময় রাজার অত্যাচারে ঢাকায় পালিয়ে এসেছিলেন, তাকে ঢাকাস্থিত মগেদের সঙ্গে নিয়ে মীর মুর্তাজার সঙ্গেও যোগ দিতে বলা হল। এবং আশ্বাস দেওয়া হল, তাকে মগ গোষ্ঠী প্রধান হিসেবে স্বীকার করা হবে। চাটগাঁর প্রশাসকের কাছে এক মগের হাত দিয়ে শাহী পরওয়ানায় আত্মসমর্পনের বার্তা দিয়ে মাফ করার কথা বলা হল]।
ইবন হুসেনের নেতৃত্বে ২৮৮টা যুদ্ধ জাহাজের কাঠামো
ঘুরাব ২১; সালব ৩; খাসা ১৫৭; জালবা ৯৬; বাছারি ২; পারেন্দা ৬; অন্যান্য ৩ মোট ২৮৮
নবাবের প্রাণশক্তি
এই সব আয়োজন করার আগে মীর মুর্তাজা ঢাকা থেকে প্রচুর পরিমান কুঠার সংগ্রহ করেছিলেন। তাছাড়া পরওয়ানা জারি করে পরগপণা থেকে হাজার হাজার কুঠার জড়ো করা হল। এই কুঠারগুলি বাহিনীর সঙ্গে পাঠানো হল রাস্তায় জঙ্গল পরিষ্কার করে রাস্তা তৈরি করার জন্যে। প্রত্যেক দিন নবাব তার সেনানায়কে পরিকল্পনা আর পরামর্শ দিয়ে চিঠি লিখতেন এবং এবং রাস্তার অবস্থা, শত্রুর অবস্থান ইত্যাদি তথ্য জানতে চাইতেন। যেদিন বাহিনী ঢাকা থেকে রওনা হল, তিনি জেনানার বাইরে দুপুর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলেন। আবার দুপুরের নমাজ থেকে রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত তিনি বাহিনীর ভাবনাই ভাবছেন। প্রাসাদে যদি কোনও নতুন ভাবনা তার মাথায় খেলত, তিনি তৎক্ষণাৎ সেটি সেনানায়কদের কাছে লিখে পাঠাতেন। মহম্মদ খলিল তার সঙ্গে রোজ যোগাযোগ রাখত এবং নতুন কোনও ঘটনা ঘটলে তাকে অবিলম্বে খবর দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া ছিল। নবাবের বাহিনীর সঙ্গে যাওয়া জনৈক বিশ্বাসী ভৃত্য শেখ মুবারককে নির্দেশ দেওয়া ছিল রোজকার ছোট বড় সব ধরণের ঘটনা লিখে নবাবকে পাঠানোর এবং তার যা মনে হয় সে সব নবাবজাদাকে খানকে জ্ঞাত করার।
সেনাবাহিনীর খাদ্য
[শস্য] গোলা সংক্রান্ত আমলাকে নির্দেশ দেওয়া ছিল, ব্যাপয়ারিরা যে পরিমান ঢাকায় শস্য আনে তার অর্ধেকটা বাহিনীর জন্যে রসদ হিসেবে পাঠাতে হবে। বাংলার প্রতিটা ফৌজদারকে পরওয়ানা পাঠিয়ে বলা হল বাহিনীর জন্যে সব রকম রসদ পাঠাতে হবে। Yasawwalsদের এসব দেখাশোনা করতে নিয়োগ করা হয়। নবাবের ব্যবস্থা এতই চমৎকার ছিল যে মোটামুটি ঢাকার দামেই বাহিনীতে শস্য পাওয়া গিয়েছে।
সমুদ্র আর স্থলপথে অগ্রগতি
বুজুর্গ উম্মিদ খান তার বাহিনী নিয়ে কয়েক দিনের মধ্যে কয়েকটি গভীর নদীখাত পেরিয়ে গাছ কেটে, রাস্তা সুসর করে এগিয়ে [আলমগিরনামার ৯৪৯ পাতায় অগ্রগামী বাহিনীর অভিযানের বর্ণোনা দেওয়া হয়েছে ফারহাদ খান গাছ কাটার বাহিনী আর তীর ধনুক এবং মুখোশ পরা পদাতিক বাহিনী নিয়ে এগিয়ে নোয়াখালি থেকে মীর মুর্তাজা এবং অন্যান্য সহযাত্রীর সঙ্গে জুড়ে এগিয়ে চললেন এবং জগদিয়া সীমান্ত চৌকিতে পৌঁছলেন। ইবন হুসেইন এবং তার সাথীরা নোঙ্গর ফেলে দাঁড়িয়েছিল। ১৪ তারিখে ফারহাদ খান এবং সাথীরা সতর্ক হয়ে ফেনি নদী পার হলেন। ২০ তারিখ একটি হ্রদের কাছে পৌঁছলেন, যেখান থেকে চাটগাঁ এক দিনের পথ। তিনি সেখানে বুজুর্গ উম্মিদ খানের পৌঁছনোর জন্যে অপেক্ষা করে রইলেন। সেনানায়ক ফেনি পেরোলেন ১৭ তারিখে এবং সেখানে পৌঁছলেন ২১এ ফারহাদ খান আর মীর মুর্তাজার থেকে ৮ কোস পিছনে আর চাটগাঁ কেল্লা থেকে ১০ কোস দূরে; যেখানে জঙ্গল খুব ঘণ সেখানে অপেক্ষা করলেন। ফারহাদ খান রোজ জঙ্গল কেটে, রাস্তা তৈরি করে একটু একটু করে এগোতে থাকেন। বুজুর্গ উম্মিদ খানের অপেক্ষার জায়গা থেকে ২০ কোস দূরে, চাটগাঁর অধীনস্থ ডুমরিয়ায় নাওয়ারা অপেক্ষা করছিল’] চলে ফেনি নদী পেরিয়ে মগেদের সীমান্তে প্রবেশ করলেন। নবাবের নির্দেশ ছিল মনসবদার সুলতান বেগের অধীনে কিছু অশ্বারোহী এবং পদাতিক দিয়ে নদীর তীরে একটি থানা তৈরি করার। ফেনি যেহেতু সাগরে মিশেছে, আশংকা ছিল মগেরা আচম্বিতে ঢুকে এসে শাহী বাহিনীকে রাস্তায় আক্রমন করতে পারে। ঠিক হল নোয়াখালি থেকে ইবন হুসেইন নাওয়ারা নিয়ে সমুদ্র ধরে যাবেন আর ফারহাদ খান, মীর মুর্তাজা এবং হায়াত খান ভূমি পথ ধরে এগোবেন। যদি সম্ভব হয় তারা কর্নফুলির নদীর মুখ দখল করবেন এবং চিটাগাঁয় আক্রমন শানাবেন। আর যদি অবস্থা প্রতিকূল বোঝেন তাহলে তারা বুজুর্গ উম্মিদ খানের বাহিনীর পৌঁছের জন্যে অপেক্ষা করবেন। বুজুর্গ উম্মিদ খানকে জঙ্গল স্তরে স্তরে কেটে কেটে উপকূল ধরে এগোতে হচ্ছিল, সেই গতিতেই সমুদ্র ধরে নাওয়ারা এগোচ্ছিল; ভূমিপথ আর সমুদ্রে এগোনো এবং থামা মোটামুটি একই গতিতে সঙ্গে চলছিল, যাতে দুটি বাহিনী আলাদা না হয়ে পড়ে।
সেনানায়কেরা নোয়াখালি থেকে রওনা হয়েছেন। ইবন হুসেইন খুব তাড়তাড়িই খামারিয়া খাঁড়িতে পৌঁছলেন, এটা চাটগাঁয়ের দুই স্তরের আগে পৌঁছে পথ ধরে অগ্রগামী বাহিনীর সামনের জঙ্গল কাটলেন। ফারহাদ খান, মীর মুর্তাজা এবং পথ ধরে এগোনো বাহিনীও জঙ্গল কেটে কেটে এগোচ্ছেন। তারা ইবন হুসেইনের বাহিনীর সঙ্গে মিললেন ২১ জানুয়ারি ১৬৬৬। দ্রুত জঙ্গল কেটে এগোনো বুজুর্গ উম্মিদ খান [মূল] বাহিনী নিয়ে আবির্ভূত হলেন খামারিয়ার তিন কোসের মধ্যে।
প্রথম নৌযুদ্ধ ২৩ জানুয়ারি
২২ জানুয়ারির সন্ধ্যায় ইবন হুসেইনের কারাওয়াল[খবর জোগাড় করা বাহিনী] খবর আনল শত্রুর নাওয়ারা, মুঘল বাহিনীর থেকে ৬ ঘন্টার দূরত্বে কাঠালিয়া খাঁড়িতে অপেক্ষা করছে। ইবন হুসেইন নৌকোতে অপেক্ষা করা শাহী এবং নবাবী বাহিনীর সেনাপতিদের সংবাদটা জানালে নাওয়ারা বাহিনী আক্রমণ করার জন্যে তৈরি হল। রাত্রে তিনি খাঁড়ির মুখে নজরদারি করে কয়েকটা নৌকোকে এগোনোর নির্দেশ দিলেন। পরের সকালে কারাওয়ালেরা খবর দিল শত্রুর বাহিনী শাহী নাওয়ারার দিকে আক্রমন করার লক্ষ্যে এগোতে শুরু করেছে। ইবন হুসেইন, বুজুর্গ উম্মিদ খানকে খবর পাঠিয়ে যুদ্ধের জন্যে তৈরি হওয়ার কথা বললেন, যদিও ঝোড়ো বাতাস আর বিশাল ঢেউ শাহী নৌকোগুলোকে প্রায় ডুবিয়ে দেওয়ার অবস্থায় তৈওরি করছিল। মহম্মদ বেগ আবাকাশের নৌকোয় থাকা আবুল কাশিম জানালেন একমাত্র ঝোড়ো হাওয়া থামলেই নৌকো নিয়ে এগোনো যাবে। তীরে দাঁড়ানো এক তুর্কি সেনা মহম্মদ বেগের দিকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে বলছিল, ‘আপনি কী পাগল হলেন, এই ঝোড়ো হাওয়া আর গভীর উত্তাল সমুদ্রে আপনি জাহাজ ভাসাবার কথা ভাবছেন?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘ভাই রে, যদি পাগল না হতাম তাহলে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতাম না’।ফারহাদ খান, মির মুর্তাজা এবং হায়াত খান স্থলপথ ধরে জঙ্গল কেটে কেটে নাওয়ার গতিতে এগোতে থাকলেন। জঙ্গল এত গভীর আর ঘণ যে তাদের জঙ্গল কেটে এগোনো সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।
শত্রুর ১০টা ঘুরাব আর ৪৫টা জলবার গুচ্ছ দেখা গেল। মুঘল বাহিনীকে দেখতে পেয়েই মগেরা কামান দাগতে শুরু করেছে। ক্যাক্টেন মুর এবং অন্যান্য ফিরঙ্গি তীব্র বেগে শত্রুর দিকে জল কেটে এগিয়ে গেলেন। পিছনে এগোলেন ইবন হুসেইন। শাহী বাহিনীর তীব্র আক্রমনের মুখে শত্রুরা প্রতিরোধ খাড়া করতে পারল না, ঘুরাবে চড়া সেনারা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল আর জলবাগুলো মুখ ঘুরিয়ে পালিয়ে গেল। ইবন হুসেন ছেড়ে যাওয়া ঘুরাবগুলো দখল নিয়ে তাদের পিছনে ধাওয়া করার মনস্থ করলেন। কিন্তু বাধ সাধল বাঙালি সেনারা, যারা জীবনে কোনও দিন মগেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতে নি। এমন কী শত বছর বয়সীও কেউ মগ-হার্মাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতার কথা ভাবে নি। ইবন হুসেইন তাদের কথা মানতে বাধ হলেন, কিন্তু নৌবহরের পুরোনো অবস্থান বললে আরও একটু এগিয়ে গিয়ে যেখানে ঘুরাবগুলো দখলে নিয়েছিলেন সেখানে সন্ধে অবদি থানা গাড়লেন এবং সন্ধের পরে খামারিয়া খাঁড়িতে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
হঠাতই দূরে দুটো-তিনটে পতাকাশোভিত[বাইরাক] জাহাজ দেখা গেল। মগেরা সকালে কাঁঠালিয়া খাঁড়ি থেকে তাদের গর্বের বিশালাকায় খালু আর ধুমএর মত বড় জাহাজ নিয়ে যুদ্ধের জন্যে বেরিয়ে খামারিয়া খাঁড়ির কাছে হুরলা খাঁড়িতে দুটি বড় জাহাজ এবং আরও কয়েকটাকে দাঁড় করিয়ে রেখে, শত্রুকে তাচ্ছিল্য করে মাত্র ১০টা ঘুরাব আর ৪৫টা জলবাতেই মনে করছিল শাহী নাওয়ারাকে [পরাজিত আর] নৌকো দখল করার জন্যে এইটুকু বাহিনীই যথেষ্ট। এখন পতাকাওয়ালা দুটো তিনটে জাহাজের দেখা মিলল।
ইবন হুসেইন তার বাহিনীকে উত্তেজিত করে তুলতে বললেন, ‘ভাই সকল পালিয়ে যাওয়া জলবাগুলো তাদের বড় জাহাজের সঙ্গে যোগ দিয়েছে; শত্রু আমাদের ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে; আমাদের আর শত্রুকে সময় দেওয়া ঠিক হবে না; অবস্থার সম্পূর্ণ সুযোগ নিতে হবে, আসুন আমরা সর্বশক্তিমানের নামে শত্রুর ওপর সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের হাতে তাদের পরাজয় অনুভব করি’। বাংলার সেনানীর ওপর এই উত্তেজকর বক্তব্যের ফল ফলল; তারা হুরলা খাঁড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে সায় দিল। শত্রু, খাঁড়ির ভিতর থেকেই বিপক্ষের এই রণনীতি বুঝতে পেরে সমুদ্রে তারা নৌবাহিনীকে যুদ্ধনীতির মত সারবদ্ধ করে দাঁড় করাল। ইবন হুসেইন অকুস্থলে পৌঁছে বিপক্ষের বাহিনী দেখে বুঝলেন নিজেদের বাহিনী আলেকজান্ডারের নৌবাহিনী থেকেও অনেক বেশি শক্তিশালী। শত্রুর বড় জাহাজের কামানের মুখে নিজেদের ছোট জাহাজগুলোকে ধ্বংসের মুখে না পাঠিয়ে দূর থেকে কামান দাগতে শুরু করলেন আর বড় জাহাজ[সলব] আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপরে যৌথভাবে শত্রুর সামনের সারির কাছাকাছি গিয়ে আক্রমন করার কথা ভাবলেন। শত্রুপক্ষের দিকে কামান দাগতে দাগতে তিনি একজনকে সলবগুলি দ্রুত ডেকে পাঠানোর জন্যে বার্তা পাঠালেন। সন্ধ্যের নামাজের সময় জাহাজগুলো পৌঁছল। সে সময় থেকে সকাল হওয়া পর্যন্ত মুঘল বাহিনী আর শত্রুপক্ষের মধ্যিখানে এক কামান মাত্র দূরত্ব রইল[আলমগিরনামার ৯৫০ পাতায় লিখছে, [প্রথম নৌ যুদ্ধের পরে] শত্রুরা পালাল। ইবন হুসেইন তার বাহিনী নিয়ে দ্রুত ছেড়ে যাওয়া ১০ ঘুরাব আর ৩টে হালিয়া[জলবা] দখলে নিলেন। দূরে শত্রুর বড় জাহাজ[নাওয়ারাইবুজুর্গ] নিয়ে শত্রুর বাহিনীর সার দেখা গেল। ইবন হুসেইনের তাড়ায় [৯৫১ পাতা] তারা কর্ণফুলি নদীর ভিতরে ঢুকে যায়; এবং যেহেতু বড় জাহাজ সঙ্গে ছিল না, তাই তিনি তাদের পিছনে তাড়া করে কর্ণফুলি নদীতে না ঢুকে সমুদ্রে নির্দিষ্ট একটি জায়গা দেখে শত্রুর ওপর নজরদারি করে রাতটি সেখানে কাটানোর পরিকল্পনা করলেন। বুজুর্গ উম্মিদ খান [যুদ্ধ, বিজয় আর অগ্রগতির] খবরটি পেয়ে কোনও সময় না নিয়েই ফারহাদ খান এবং মীর মুর্তাজাকে তাড়াতাড়ি জঙ্গল সাফা করে রাস্তা তৈরির পিছনে বেশি সময় না দিয়ে এগিয়ে এসে নাওয়ার সঙ্গে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনিও রাস্তা তৈরি কাজ বন্ধ রেখে জঙ্গল কেটে তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসতে লাগলেন। পরের দিন ২৪ জানুয়ারি, ফারহাদ কর্ণফুলির তীরে উপস্থিত হলেন। ইসলামিক বাহিনী দেখে শত্রুপক্ষ হতোদ্যম হয়ে গেল।]।
দ্বিতীয় নৌযুদ্ধ, ২৪ জানুয়ারি
পরের দিন সকালে, মুঘল বাহিনী তাদের বিজয় পতাকা উর্ধ্বে তুলে, যুদ্ধ দামামা, বিউগল এবং ট্রাম্পেট বাজিয়ে শত্রুর কামানের দিকে এগিয়ে চলল প্রথমে সলব, তারপরে ঘুরাব শেষে পাশাপাশি জলবা এবং খাসা সাজিয়ে নিয়ে। মুঘল বাহিনীর যুদ্ধ ঊন্মাদনা দেখে শত্রুরা সমস্ত সাহস আর শক্তি হারিয়ে মুখ ঘুরিয়ে পালিয়ে যাবার ভাবনা ভাবতে থাকে। প্রথমে মগেদের বড় জাহাজগুলো এবং তারপরে সেগুলোর সঙ্গে জুড়ে থাকা জলবাগুলো এবং যে সব জাহাজ [আগের দিন দুপুরে] যুদ্ধ করেছিল, সে সব কটা শত্রুপক্ষের[মুঘল বাহিনী] থেকে মুখ ঘুরিয়ে একে অপরকে টেনে নিয়ে পালিয়ে গেল।
ইবন হুসেইন কোনও রকম তাড়াহুড়ো না করে, বাহিনীকে ঘিরে থাকা নিরাপত্তাজাল ছিন্ন না করে, শত্রুপক্ষর ছেড়ে অবস্থানটি দখল করলেন। দুপুর ৩টে নাগাদ শত্রুর নাওয়ারা বহর কর্ণফুলির মুখে পৌঁছে নদী বেয়ে আরও ওপরের দিকে উঠে চাটগাঁ কেল্লার সামনে একটি দ্বীপে দাঁড়াল এবং তারা চাটগাঁর তীরে নৌকোগুলো তুলে নিতে থাকে। শাহী বাহিনী কর্ণফুলি নদীর মুখ দখলে নিল। মগেরা কর্ণফুলি নদীর মুখে [আরেক দিকে] ফিরিঙ্গি বন্দর গ্রামের কাছে যেখানে একসময় ফিরঙ্গিরা থাকত, সেখানে জলের কিনারায় বাঁশের মুখ ছুঁচোল করে পর পর খাড়াই করে একটা প্রতিরক্ষা দেওয়াল[স্টকেড] তৈরি করে তার পিছনে যথেষ্ট পরিমান গোলাবারুদ আর তেলিঙ্গাদের [আরামানি যোদ্ধা] জমা করতে থাকে। মুঘল বাহিনী কর্ণফুলি নদীর মুখে ঢুকলে এই প্রতিরক্ষা দেওয়ালগুলো থেকে তাদের দিকে মাস্কেট আর বন্দুক থেকে গুলি ছোঁড়া শুরু হয়। ইবন হুসেইন অধিকাংশ মুঘল জাহাজ নদীতে ঢুকিয়ে নিয়ে, সেনাবাহিনীকে নদী তটে নামিয়ে তীব্র আক্রমন শুরু করন। মুঘলদের আক্রমণের মুখে পড়ে বাঁশের সারগুলির পিছনে থাকা মগ সেনাবাহিনী পালিয়ে যায় এবং মুঘলেরা বাঁশের প্রতিরক্ষাগুলো পুড়িয়ে দিয়ে জাহাজে ফিরে আসে।
আরাকানি নৌবহর ধ্বংস হল
উৎফুল্ল হৃদয়ে এবং তীব্র আশায় পরপর সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে, ইবন হুসেইন শত্রুর ওপর সমস্ত শক্তি জড়ো করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ক্যাপ্টেন মুর এবং অন্যান্য ফিরঙ্গি সেনাপতি এবং অন্যান্য নবাবি সেনানায়ক [যেমন] মহম্মদ বেগ আবাকাশ এবং মানওয়ার খান জমিদার অন্যান্য এলাকা থেকে তীব্র গতিতে ধেয়ে এসে অকুস্থলে পৌঁছলেন। দুপক্ষের তীব্র যুদ্ধ আরম্ভ হল। চিটাগং কেল্লা থেকে [মুঘলদের দিকে] গুলি আর কামানের গোলা ছোঁড়া হল। শেষে জয় হল মুঘল বাহিনীর। শত্রুরা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হল। তাদের বহু মাঝি আর সৈন্য নৌকো থেকে নদীতে ঝাঁপ দিল; অনেককে যুদ্ধবন্দী করা হল; অধিকাংশ সেনাকে খুঁজে পাওয়া গেল না, কয়েকজন জলে ডুবে মরল। অনেকেরই মুঘল বাহিনীর তরোয়াল, তীর আর বল্লমের আঘাতে প্রাণ গেল। যারা তীরে পৌঁছতে পারল, ভগ্নদূতের মত যুদ্ধের সংবাদ নিয়ে গেল। শত্রুর বহু জাহাজ আগুণ লেগে ডুবল, কিছু জাহাজ মুঘলেরা ধাক্কা মেরে ছিদ্র করে ডোবাল, আর বাকি ১৩৫টা জাহাজ মুঘলেরা দখল নিল [কর্ণফুলি নদী যুদ্ধ আকবরনামাতে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে ‘[২৪ জানু] ইবন হুসেইন শাহী নৌবহর নিয়ে কর্ণফুলি নদীতে ঢুকলেন এবং যেসব নৌকোবহর পালিয়ে এসেছিল সেগুলোকে তিনি আক্রমন শানালেন। দিনের দ্বিতীয় প্রহরে আরও বড় যুদ্ধ হল। শেষ পর্যন্ত শাহী বাহিনী বিজয়ী হল, শত্রুপক্ষ পালিয়ে গেল, তাদের অধিকাংশ সেনা মারা পড়ল, অনেককে বন্দী করা হল, বহু জলে ঝাঁপিয়ে ডুবে মারা গেল]; দখল নেওয়া জাহাজগুলোর মধ্যে ছিল – খালু ২; ঘুরাব ৯; জাঙ্গি ২২; কোষা ১২; জলবা ৬৭[৬৮৯ হওয়া উচিৎ]; বালাম ২২।
ইতিমধ্যে যুদ্ধের খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন বুজুর্গ উম্মিদ খান তীব্র গতিতে চাটগাঁয়ের সন্নিকটে পৌঁছে যান। কেল্লার চৌকিদার কেল্লাদারকে মুঘল পদাতিক বাহিনী পৌঁছবার সংবাদ দিল। নদী যুদ্ধের হারের ধাক্কা এবং দুয়ারে মুঘল বাহিনী পৌঁছে যাওয়ার সংবাদে, মুঘল বাহিনীর থেকে সংখ্যায় বেশি থাকা সত্ত্বেও ভীত সন্ত্রস্ত মগেরা কেল্লা ছেড়ে পালিয়ে যায়।
যুদ্ধের পরের রাত
সেই রাতে[৯৫১ পাতায় আকবরনামা বলছে – ‘শাহী বাহিনী বিজয়ের পরে চাটগাঁ কেল্লার পাশে কর্ণফুলি নদীতে অপেক্ষা করতে থাকে। চাটগাঁয়ের যে সব ফিরঙ্গি [নোয়াখালি না গিয়ে] থেকে গিয়েছিল, বা যারা আরাকান থেকে চাটগাঁর ফিরঙ্গিদের উদ্ধার করতে এসেছিল, সক্কলে ইবন হুসেইনের সঙ্গে মুলাকাত করে। এ বিষয়ে ক্যাপ্টেন মুর অসামান্য সহায়তা করেন। পরের দিন [২৫ জানুয়ারি] বুজুর্গ উম্মিদ খান বাকি বাহিনী নিয়ে চাটগাঁ কেল্লার পাদদেশে পৌঁছলেন। ভূমি এবং জল উভয় দিকেই মুঘল বাহিনী কেল্লা ঘিরে ফেলল। কেল্লার অন্দরে থাকা বাহিনী বহু তর্কবিতর্ক করে একমত হল যে তারা মুঘল বাহিনীকে প্রতিহত করতে পারবে না, তারা নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করতে থাকে [এবং কেল্লা ছেড়ে পালিয়ে যায়]।পরের দিন ২৬ জানুয়ারি, মুঘল বাহিনী কেল্লার দখল, চিটাগাঁ প্রদেশের দখল এবং ছেড়ে যাওয়া গোলাবারুদ এবং নৌবহরের দখল নিল। চিটাগাঁর প্রশাসক ছিলেন আরাকান রাজার কাকার পুত্র, তাকে এবং আরও কিছু আত্মীয়স্বজনকে বন্দী করা হল। মোট বন্দী হল ৩৫০ জন, এবং দখল হল ১৩২টা যুদ্ধ জাহাজ এবং ১০২৫ ব্রোঞ্জ আর লোহার কামান, প্রচুর ম্যাচলক, এবং জম্বুরক[উটের পিঠ থেকে চালানো কামান], প্রচুর বারুদ, অন্যান্য গোলাবারুদ, তিনটি হাতি। মগেদের হাতে অপহৃত হওয়া বাংলার বহু চাষী যারা সেখানে মগেদের বন্দী ছিল, তাদের মুক্তি দেওয়া হল’] দুজন বিশ্বাসী সেনার তত্ত্বাবধানে দুজন বন্দীর হাতে আরাকান রাজার প্রতিনিধি কিলাদারকে চিঠি লিখে প্রধান সেনাপতি জানালেন, ‘তুমি কেন নিজেকে আর তোমার পরিবারকে ধ্বংস করবে? আমাদের তরবারির বলপ্রয়োগে তোমাদের ধরে হত্যা করার আগে তোমরা যদি স্বেচ্ছায় ধরা দাও, তাহলে সবার পক্ষে মঙ্গল। তোমরা দুর্গ আমাদের হাতে তুলে দিয়ে সম্পত্তি আর তোমারদের সুরক্ষা নিশ্চিত কর’। অসহায় কিলাদার বুঝতে পারলেন তার পক্ষে মুঘল বাহিনীর শরণাগত হওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। তিনি উত্তর দিলেন, আজ রাতটায় আক্রমন করা থেকে বিরত থাকুন আগামী কাল সকালে আমি আপনাদের প্রবেশ করতে দেব।
চাটগাঁ কেল্লার পতন
২৬ জানুয়ারি ১৬৬৬র প্রত্যুষেই মগেরা কেল্লার বাহিনী প্রধান দ্বার উন্মুক্ত করে ইবন হুসেইনকে আমন্ত্রণ জানাল। তিনি হেঁটে কেল্লায় ঢোকার আগেই মুনাব্বর খান জমিদার কেল্লায় প্রবেশ করে আগুণ ধরিয়ে দিলেন। কেল্লা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। আগুণ এতই তীব্র ছিল যে কেল্লার ভিতরে থাকা একজনও দাঁড়াতে পারছিল না, ইবন হুসেইন আগুণ নিভোতে ব্যর্থ হলেন। তিনি মগেদের বাইরে বার করে নিয়ে এলেন।
আগুণ নিভলে তিনি দুর্গে ঢুকে সম্পত্তি দখলে নিলেন। বিজয় সংবাদ তিনি কিলাদার মার্ফৎ ঢাকার নবাবের কাছে পাঠালেন। এছাড়াও তিনি বুজুর্গ উম্মিদ খানকেও বিজয় সংবাদ জানালেন।
কেল্লার ওপর পাড়ে যে সব মগ ছিল প্রত্যেকে পালিয়ে গেল। উল্টো দিকের কেল্লারও পতন ঘটল। উল্টো দিকের কেল্লার আশেপাশে মগেদের দাস হিসেবে জীবন কাটানো বাংলার মুসলমান কৃষকেরা পালিয়ে যাওয়া মগেদের ওপর গত কাল আক্রমন চালায় এবং পরের দিনও আক্রমন করে। তারা জনৈক মগ নেতাকে হত্যা করে, দুটি হাতি দখল নেয় এবং সেগুলো ইবন হুসেইনের সামনে উপস্থিত করে। কেল্লার চারটি হাতির মধ্যে দুটি আগুনে পুড়ে মারা যায় দুটি মুঘল বাহিনীর কব্জায় আসে।
বিজয়ীদের পুরষ্কার
২৯ জানুয়ারি বিজয়ের সংবাদ ঢাকায় নবাবের সকাশে পৌঁছল। সর্বশক্তিমানকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বাহিনীর প্রত্যেককে হাত খুলে, খেলাত, ঘোড়া, হাতি উপহার দিলেন। গরীবদের ভিক্ষা দিলেন, ঢাকাজুড়ে আনন্দের সঙ্গীত বাজানোর নির্দেশ দিলেন। অপরিমেয় সম্পদ পেল ফিরঙ্গিরা; সেনাপতি আর নাওয়ারা সেনাদের একমাসের অতিরিক্ত বেতন দিলেন।
সেই দিনই নবাব বিজয় সংবাদ মুঘল দরবারে পাঠালেন। সংবাদটি যখখন দরবারে পৌঁছল[আলমগিরনামা বলছে, ‘শাবানের শেষে[ফেব্রুয়ারি ১৬৬৬] যখন দরবারে সংবাদটি পৌঁছল, সম্রাট চাটগাঁর নাম দিলেন ইসলামাবাদ], সম্রাট আনন্দের বাজনা বাজানো নির্দেশ দিলেন, বিজয়ের সঙ্গে জুড়ে থাকা প্রত্যেককে উপহারের কথা ঘোষণা করলেন’ – নবাব পেলেন সম্রাটের নিজের দেওয়া দামি রত্নখচিত তরোয়াল, দুটি হাতি, সোনার ঝালরে মোড়া দুটি ঘোড়া, একটি বিশেষ খেলাত, এবং তাকে সাধুবাদ জানিয়ে একটি সাম্মানিক ফরমান। বুজুর্গ উম্মিদ খান, ফারহাদ খান, মীর মুর্তাজা, ইবন হুসেইন এবং মহম্মদ বেগ আবাকাশের পদোন্নতি ঘটল। ইবন হুসেইনকে মনসুর[আলমগিরনামা সূত্রে মুসাফফর] খান আর মীর মুরতাজাকে মুজাহিদ খান উপাধি দেওয়া হল।
চাটগাঁয় নতুন সরকার
২৭ জানুয়ারি ১৬৬৬ বুজুর্গ উম্মিদ খান চাটগাঁ কেল্লা অঞ্চলে ঢুকে প্রতিটি মানুষের জান মালের আশ্বাস দিলেন এবং নিজের বাহিনীর সেনাকে লুঠ না করারও নির্দেশ দিলেন, যাতে আগামী দিনে এই এলাকাটিতে মানুষ বাস করতে সঙ্কোচ না করে [এখানেই বদলিয়ান লাইব্রেরির পুথিটি শেষ হয়েছে। এটি শেষ করার জন্যে আমি আলমগিরনামার দ্বারস্থ হই]।
বুজুর্গ উম্মিদ খান চাটগাঁতে বেশ কিছুদিন থেকে গেলেন নানান সমস্যা সমাধানের জন্যে। মিয়ানা খানকে চাটগাঁর উত্তরে পাঠানো হল চাষীদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিতে এবং জীবন জীবিকা নিশ্চিত করতে। সেখানে একটা থানা তৈরি হল। তাজ মিয়ানা তার অনুগামী এবং ১০০ মাস্কেটিয়ার্স নিয়ে থানাদার নিযুক্ত হলেন। তাঁর কাজ হল চিটাগাং থেকে ফেনি নদী পর্যন্ত রাস্তার নিরাপত্তা বিধান করা এবং সেটিকে পাহারা দেওয়া।
রাম্বু অধিকার এবং পরিত্যাগ করা হল
চাটগাঁ থেকে চার দিনের পথ রাম্বু বন্দর। এটি চাটগাঁ এবং আরাকানের মধ্যবর্তী অবস্থানে রয়েছে। রাম্বু কেল্লায় পাহারা দেয় প্রচুর সেনা। মির মুর্তাজাকে রাম্বুতে পাঠিয়ে চাষীদের মন জেতা, যাতায়াতের রাস্তা চেনা, ব্যবসা এবং অঞ্চলটিকে বোঝার উদ্যম নিতে বলা হল। যদি মনে হয় তাহলে রাম্বু অবরোধ করার নির্দেশও দেওয়া হল। মীর মুর্তাজা ১২ দিন ধরে বন্ধুরতম রাস্তা, ঘণ জঙ্গল এবং নানান গভীর নদী নালা পেরিয়ে রাম্বুর এক কোসের মধ্যে পৌঁছলেন। পরের দিন সকালে তিনি কেল্লা আক্রমন করলেন। আরাকান রাজার পুত্র রাওলি কেল্লার প্রশাসক। সে মীর মুর্তাজাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বাহিনী নিয়ে কেল্লার পাশের পাহাড়ের কোলে জঙ্গলে পালিয়ে গেল। তাদের পিছু নিয়ে কয়েকজনকে মীর মুর্তাজা হত্যা করলেন। যারা পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল তারা বেরিয়ে এসে আত্মসমর্পণ করল এবং তাদের বন্দী করা হল। বহু মুসলমান রায়তকে সেখানে দাস করে রাখা হয়েছিল, তাদের মুক্তি দেওয়া হল এবং তারা দেশে ফিরল।
রাম্বুর বিজয়ের সংবাদ পেয়ে এবং রাম্বুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে আরাকানের রাজা স্থলপথে সেনা বাহিনী পাঠালেন। এই খবরে বুজুর্গ উম্মিদ খান, মিয়ানা খান, জামাল খান দিজলাক এবং আরও অনেককে মীর মুর্তাজার নিরাপত্তা বিধান করতে নির্দেশ দিলেন। রাম্বু বিজয়ের পর মীর মুর্তাজা, শত্রুর আগমনের সংবাদ পেতে ১০০ জন মাস্কেটিয়ার্স রাম্বু থেকে দেড় কোস দূরে নদীর তীরে মোতায়েন করে রেখেছিলেন। একদিন সাতটি হাতি নিয়ে একটা বিশাল আরাকানি বাহিনী হঠাত উদয় হয়ে মাস্কেটিয়ার্সদের ওপরে চড়াও হয় এবং মাসকেটিয়ার্সদের অনেকে পালিয়ে যায়। আক্রমণের সংবাদে মীর মুর্তাজা বিশাল বাহিনী নিয়ে, নদী নালা পার হয়ে, চওড়া করে কেটে রাখা খাদ পেরিয়ে শত্রু দলকে আক্রমন শানায়; বিপুল যুদ্ধের পরে শত্রুরা পালায়। বিজয়ীরা তাদের পিছনে ধাওয়া করে বহু সেনা খুন করে, অনেককে গ্রেফতার করে। বাহিনীর ৮০টা কামান, বহু মাস্কেট এবং অন্যান্য যুদ্ধ রসদ উদ্ধার করে।
চাটগাঁ থেকে রাম্বুর মধ্যে অংশটা ঘণ জঙ্গল, পাহাড় এবং বেশ কিছু নদী এবং ঝরণায় কাটাকুটি খেলা, এবং সে নদীগুলি নৌকো ছাড়া পেরোনো মুশকিল, বর্ষাকালে গোটা রাস্তা বন্যার জলে ভর্তি থাকে। তাই দুটি প্রান্তে যোগাযোগ রাখা খুব সমস্যার সমস্যার বুঝে এবং এই বছর শুধু একটি গুদাম থাকায় এবং বর্ষাকাল কাছেই এসে পড়ায় আরাকানে মুঘল বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়। বুজুর্গ উম্মিদ খান বুঝলেন বর্ষায় এই দুই অঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সে সময় রসদ পাঠানো সমস্যার, তাই তিনি মীর মুর্তাজাকে রাম্বু থেকে চাষী, জমিদার নিয়ে সরে এসে চাটগাঁয়ের কাছেই দখিন কোলে(নদীর দক্ষিণতম অংশ) আশ্রয় নিতে বলে। তিনিও তাই করলেন।