ভাবা যায়, গাছেরও আছে অন্য উদ্ভিদের সাথে যোগাযোগের জন্য একধরণের নেটওয়ার্ক, Wood-Wide-Web (WWW), আমাদের ফেসবুকের মতো বন্ধু, এবং নিরাপদ যোগাযোগের জন্য পাসওয়ার্ড! অবাক করা ব্যাপার না?
আমরা যখন মাটির উপর দিয়ে চলাফেরা করি, শুনতে পাই পাখীর কুজন-কিচিরমিচির। অন্যদিকে, মাটির উপরে যে বৃক্ষরাজিকে আমরা জানি বাকশক্তিহীন-নীরব, মাটির নীচে তারা কিন্তু অনেক সরব, তাদের নিয়মিত কথোপকথন হয় অন্য জাতের বন্ধু-উদ্ভিদের সাথে। তাদের শেকড়ের সাথে অন্য উদ্ভিদের চলে অর্থপূর্ণ সংলাপ, বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির আদান-প্রদান, ফেসবুকের মতো বন্ধুত্ব, এবং নিরাপদ থাকার প্রচেষ্টা। কেমন করে তা’ সম্ভব?
আমরা জানতেও পারছি না, আমাদের ঠিক পায়ের নীচে প্রতিদিন ঘটছে কত বিস্ময়কর সব কর্মকান্ড। গাছের শেকড় তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ বিশেষ ছত্রাকের সাথে অনেক কিছুই বিনিময় করছে প্রতিনিয়ত। আমরা যেমন World-Wide-Web (WWW)-এর মতো আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে অন্যের সাথে ভাবের আদান-প্রদান করি, তেমনি গাছেরও রয়েছে Wood-Wide-Web (WWW)। গাছের যোগাযোগের এই মাধ্যম মাইকোরাইজাল নেটওয়ার্ক (mycorrhizal networks) নামেও পরিচিত। আমাদের World-Wide-Web প্রযুক্তির বয়স মাত্র ৩০-৩৫ বছর; অথচ আমরা মাত্র সেদিন জানলাম যে গাছ তাদের Wood-Wide-Web ব্যবহার করে আসছে লক্ষ-লক্ষ বছর ধরে। অবিশ্বাস্য!
মহাকাশের অনন্ত গভীরতার মতোই ভূগর্ভে গাছের এই পারস্পারিক বন্ধুত্বের WWW নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি। গাছের নিজস্ব এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বড় গাছগুলো তাদের ছোট্র প্রতিবেশী ছত্রাকের (fungi) কাছে পুষ্টি সরবরাহ করে থাকে। ছত্রাক হলো ‘ব্যাঙের ছাতা’ বলতে আমরা যা’ বুঝি, সে রকমের উদ্ভিদ। পুরোনো বড় গাছেরও প্রয়োজন পড়ে বিশেষ খাদ্যের, যা’ শুধু সরবরাহ করতে পারে ছত্রাকের মতো ছোট-ছোট বিশেষ উদ্ভিদ।
আমরা যদি নিজেদেরকে সঙ্কুচিত করে মাটির গভীরে ডুব দিতে পারতাম, তাহলে হয়তো বিস্ময়কর এক রাজ্য দেখতে পেতাম। বুঝতে পারতাম, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য গাছ এবং ছত্রাক পারস্পরিক কল্যানে তাদের WWW-কে কতো কার্যকরভাবে ব্যবহার করে আসছে। আরো দেখতে পেতাম বড় কিছু গাছের শেকড়গুলো পরে আছে সাদা রঙের মোজার মতো কিছু আবরণ। শেকড়ের এই সাদা আবরণগুলোই একধরণের ছত্রাক (ectomycorrhizal fungi)। বন্ধুত্বপূর্ণ ছত্রাক তাদের হাইফায় (hyphae) মাটির মধ্যে বিস্তৃতি করে বিশেষ এনজাইম দিয়ে আহরিত দুর্লভ নাইট্রোজেন এবং ফসফরাসকে এমন আকারে রূপান্তরিত করে, যা’ বড় গাছের শেকড় সহজেই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। ছত্রাকের চুলের চেয়েও সরু হাইফায়ের কাজই হলো বন্ধু গাছের জন্য ‘সহজ-লভ্য-নয়’ এমন খাদ্য সংগ্রহ করা, যেমন নাইট্রোজেন এবং ফসফরাস। এক মুঠো মাটিতে জালের মতো পেঁচিয়ে থাকা এই হাইফায়ের দৈর্ঘ্য কয়েক কিলোমিটার।
বিনিময়স্বরূপ ছত্রাকের এমন প্রচেষ্টার পারিশ্রমিক হিসেবে বন্ধু গাছ সূর্যের আলো থেকে ফটোসিনথেসিসের (photosynthesis) মাধ্যমে উৎপন্ন করা শর্করা বা চিনি এবং কার্বন সরবরাহ করে ছত্রাককে। এ দু’টো খাদ্য ছত্রাকের সার্বিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আবার অধিক পরিমানের নাইট্রোজেন এবং ফসফরাসযুক্ত মাটির গাছ কোন কোন ছত্রাককে নেটওয়ার্ক থেকে বাদ দিয়ে দেয়। এই একই বিষয়কে ফেসবুকের ভাষায় আমরা বলি কোন বন্ধুকে ‘আনফ্রেন্ড’ করা। কি আশ্চর্য মিল! তাই না?
মজার ব্যাপার হলো, সব গাছের সাথে বন্ধুত্ব করতে চায় না ছত্রাক। বন্ধু নির্বাচনে ছত্রাকরা যেমন খুবই খুঁতখুঁতে, বৃক্ষরাও তাই। যেমন, অস্ট্রেলিয়ার মধু ছত্রাকের (honey fungi) সাথ ইউক্যালিপটাস গাছের কখনো হয় না বন্ধুত্ব। এর কারণ হলো, ইউক্যালিপটাস গাছের শেকড় নষ্ট করার পিছনে এই মধু ছত্রাকই দায়ী। আমাদের মনুষ্য ভাষায়, এরা এক ধরণের হ্যাকার (hackers)। এরা কৌশলে প্রবেশ করে ইউক্যালিপটাস গাছের WWW নেটওয়ার্কে, তারপর ইউক্যালিপটাসের শেকড়ে ছেড়ে দেয় কম্পিউটার ভাইরাসের মতো তাদের বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান। মধু ছত্রাকের এই মহামারীর মতো শেকড় নষ্ট করার ভাইরাসের আক্রমন দাবানলের মতো এক গাছ থেকে অন্য গাছে ছড়িয়ে পড়ে। যদি তাই হয়, তাহলে প্রশ্ন: গাছ কি করে বোঝে কোন ছত্রাক তার বন্ধু, আর কোনটা তার শত্রু?
গাছের শেকড় এবং ছত্রাকের আছে পাসওয়ার্ড ! ইন্টারেষ্টিং না? একটি ছত্রাক যখন একটি বন্ধু গাছের শেকড়ের সাথে যোগাযোগ করে, তখন ছত্রাক তার পাসওয়ার্ড হিসেবে এক বিশেষ প্রোটিন ঐ শেকড়ে নিঃসরণ করে। গাছের শেকড় তা’ চেনার চেষ্টা করে। এই বিশেষ প্রোটিন হলো ছত্রাকের পাসওয়ার্ড, যা’ গাছের প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে ‘কথা বলতে’ ব্যবহার করা হয়। গাছের শেকড় ছত্রাকের পাসওয়ার্ড চিনতে না পারলে, গাছের প্রতিরোধ ব্যবস্থা মেরে ফেলে ঐ ছত্রাককে। অনেকটা কম্পিউটারের আন্টি-ভাইরাস সফটওয়ারের মতো। শুধু তাই নয়, ভূগর্ভে গাছের কোন সংক্রামক ব্যাধির হুমকি দেখা দিলে, আশেপাশের গাছগুলোকে সতর্ক করার জন্য এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিশেষ রাসায়নিক সংকেত পাঠায় গাছের শেকড়গুলো। আশেপাশের গাছগুলো তখন হয়ে যায় সতর্ক! কি দারুন সামাজিক বন্ধন এবং নিরাপত্তার দায়িত্ব! আবার কিছু-কিছু ছত্রাক বিশেষ গাছের সাথে গড়ে তোলে অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক। যেমন, পিসলিথাস ছত্রাক (Pisolithus microcarpus) গাম গাছের (Eucalyptus Grandis) শেকড়ের সাথে বংশাণু (gene) পর্যায়ে সম্পর্ক স্থাপন করে। এই বিশেষ সম্পর্ক সবার সাথে হয় না। কিন্তু যে গাছের সাথে এই পিসলিথাস ছত্রাকের গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে, এরা তখন বন্ধু গাম গাছের শেকড়ে ছেড়ে দেয় মূল্যবান microRNA। এটি এক ধরণের বংশাণু উপাদান, যা’ গাছের বিশেষ প্ৰটিন নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ বন্ধু ছত্রাকের এই দানের প্রতিদান হিসেবে গাছ ছত্রাকের মাটি থেকে সহজে পুষ্টি আরোহণে সাহায্য করে তার শেকড় দিয়ে। কি চমৎকার পারস্পারিক উপকারের ব্যবস্থা! হয়তো আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে আরো এমন অনেক বিস্ময়!
তথ্যসূত্র:
Gemma Conroy, “Trees and fungi are the ultimate friends with benefits,” Australian Broadcasting Corporation (ABC) Science, 22 August 2022.