মুঘল রাজকন্যাদের মধ্যে জাহানারা এবং রোশনারার নাম প্রায়ই শোনা গেলেও অন্তরালে রয়ে গেছেন আরেকজন রাজকন্যা। ‘মাকফী’ ছদ্মনাম নিয়ে তিনি অনেকটাই নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। তিনি হলেন জেবুন্নিসা বেগম।
প্রিন্সেস জেবুন্নিসা ছিলেন অনন্যসাধারণ। তিনি নিজের নামকে বাস্তবিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত ও নিজের জীবনে প্রতিফলিত করেছিলেন। ‘জেবুন্নিসা’ শব্দের অর্থ ‘নারীজাতির অলংকার’। বাস্তবিক অর্থেই মুঘল সাম্রাজ্যের অলংকার ছিলেন তিনি। শিল্প ও সংস্কৃতির একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জেবুন্নিসা। পাশাপাশি ছিলেন একজন ক্যালিগ্রাফার, পাণ্ডুলিপি সংগ্রাহক ও তার সময়ের অন্যতম সেরা একজন কবি।
ভেতরে ও বাইরে সম্পূর্ণটাই তিনি ছিলেন সৌন্দর্যে মোড়া একজন ব্যক্তিত্ব। জেবুন্নিসা তার পরিবার থেকে সমস্ত ভাল গুণগুলো অর্জন করেছিলেন। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব ও পারস্যের রাজকুমারী দিলরাস বানুর সন্তান যে এমন গুণবতীই হবেন, তা আঁচ করে নেয়াও কঠিন কিছু নয়।
জেবুন্নিসা তার বাবার অনেক প্রিয় ছিলেন এবং তার জন্য আওরঙ্গজেবের মনে আলাদা জায়গা ছিলো। বাবার বুদ্ধিবৃত্তি ও সাহিত্যিক রুচিবোধের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন জেবুন্নিসা। মাত্র তিন বছর বয়সে তিনি পবিত্র কোরআন মুখস্থ করেন এবং মাত্র সাত বছর বয়সে পুরোপুরি হাফেজ হয়ে যান জেবুন্নিসা। আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন ধার্মিক ব্যক্তি। ধার্মিকতার জন্য তিনি পরিচিত ছিলেন ‘জিন্দা পীর’ নামে। তিনি অনর্থক খরচ করতে পছন্দ করতেন না। এমন ধার্মিক ও মিতব্যয়ী হওয়া সত্ত্বেও মেয়ের এমন দক্ষতায় খুশি হয়ে তিনি বেশ বড় ভোজ-উৎসব ও সাধারণ ছুটির ঘোষণা করেন। জেবুন্নিসা ও তার ওস্তাদকে ত্রিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা উপহার দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন সম্রাট।
জেবুন্নিসা শুধুমাত্র একজন হাফেজই ছিলেন না। তিনি সে সময় গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, এমনকি সাহিত্যেও পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি ফার্সি, আরবি ও উর্দু ভাষায় শিক্ষকতাও করেন। তিনি একজন উৎসুক পাঠক ছিলেন। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহের পাঠাগার সমকালীন যে কোনো ব্যক্তিগত সংগ্রহকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো।
জেবুন্নিসা রাজনীতিতেও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন। রাজকীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে স্বয়ং তার বাবা সম্রাট আওরঙ্গজেব তার কাছে পরামর্শ চাইতেন। আওরঙ্গজেবের যখন রাজ্যাভিষেক হয়, তখন জেবুন্নিসার বয়স ছিলো মাত্র একুশ বছর। তা সত্ত্বেও সম্রাট তার প্রজ্ঞার মূল্যায়ন করতেন এবং তার কাছ থেকে রাজনৈতিক পরামর্শ গ্রহণ করতেন।
জেবুন্নিসার অপরিমেয় জ্ঞানই শুধুমাত্র তাকে সবার চেয়ে আলাদা করে নি। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রভাবশালী সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের মতো তিনিও ছিলেন একজন ফ্যাশন-সচেতন নারী। তিনি ‘অঙ্গকুর্তি’ নামে মেয়েদের একটি ড্রেস তৈরী করেছিলেন। তুর্কিস্তানের মেয়েদের একটি ড্রেসের আদলে তৈরী কুর্তিটিকে ভারতীয় পরিবেশের উপযোগী করে বানিয়েছিলেন তিনি। যদিও তিনি নিজে তেমন জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরতেন না। শুধুমাত্র তার গলায় শোভা পেতো একটি মুক্তার মালা।
প্রসন্ন গোলাকার চেহারার অধিকারী জেবুন্নিসা ছিলেন একজন সুদর্শনা। বাম থুতনিতে দুইটি তিল তার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলো। লাহোর জাদুঘরে সংরক্ষিত জেবুন্নিসার একটি চিত্রে দেখা যায়; লম্বা, ছিমছাম, পাতলা ঠোঁট, ছোট ছোট দাঁত, মাথাভর্তি চুল ও ফর্সা চেহারার একজন কালো চোখের মেয়ে ছিলেন তিনি।
অন্য নারীদেরকে আত্মমর্যাদাশীল হবার ও নিজেদের আলাদা পরিচয় তৈরী করার গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন জেবুন্নিসা। কোনো রাজকুমারের ঘরণী হবার আশায় না থেকে তিনি পড়াশোনা ও লেখনীর মাধ্যমে নিজেকে উচ্চতার শিখরে নিয়ে গিয়েছিলেন।
তিনি ছিলেন মানবিক চরিত্রের অধিকারী। প্রায়ই বিধবা ও এতিমদেরকে সাহায্য করতে দেখা যেতো তাকে। প্রতি বছরই তিনি কিছু মানুষকে মক্কায় হজ্ব করতে পাঠাতেন।
সংগীতেও তার ব্যাপক আগ্রহ ছিলো। তিনি নিজেও ছিলেন একজন দারুণ সংগীতশিল্পী। ফুপু জাহানারা ও চাচা দারাশিকোহর মতো জেবুন্নিসার মধ্যেও কিছু সুফী ঘরানার বিকাশ ঘটেছিলো, যা তার কবিতাগুলোকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিলো।
প্রেম-ভালোবাসা তার জীবনেও এসেছিলো। এ নিয়ে নানা রকম গল্প প্রচলিত আছে, যার বেশিরভাগই মিথ্যা। আসলে তার সমকালীন গতানুগতিক রাজকুমারীদের থেকে তার চিন্তাধারায় বিস্তর পার্থক্য ছিলো। এ জন্য তার আর বিয়ে করা হয়ে ওঠে নি। তাকে বিয়ে করবার জন্য অনেক পাত্রই প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু তিনি জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের ব্যাপারে ভীষণ সতর্ক ছিলেন। তিনি পরীক্ষা করে দেখতেন, সঙ্গী হবার ক্ষেত্রে কে কতোটা যোগ্য। তিনি কখনোই এমন কাউকে তার জীবন সঙ্গী হিসেবে পেতে চান নি, যার সাথে তার নিজস্ব রুচিবোধের পার্থক্য হবে।
অনন্যসাধারণ এক রাজকুমারী হয়েও তার জীবন শেষ হয়েছিলো এক ট্র্যাজিক বাস্তবতায়। নিজের বাবার নির্দেশেই তার শেষ জীবন কেটেছিলো কারাগারে। তার কারারুদ্ধ হবার কারণ সম্পর্কে বেশ কিছু গোঁজামিলপূর্ণ ব্যাখ্যা রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। অনেকে মনে করেন, লাহোরের গভর্নর আকিল খানের সাথে তিনি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং আওরঙ্গজেব তা মেনে নিতে পারেন নি। আরেকটি সূত্র বলে থাকেন, ধর্মপ্রাণ মুসলিম আওরঙ্গজেব তার মেয়ের সংগীতপ্রীতি ও কবিতা চর্চা পছন্দ করেন নি বলেই তাকে কারারুদ্ধ করে রাখেন। যতোদূর মনে হয়, দুটি দাবিই অসত্য ও অন্যায্য। তাকে কারারুদ্ধ করার সম্ভাব্য কারণ এটি হতে পারে যে, তার ভাই শাহজাদা আকবরের বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা এবং প্রকাশ্যে বাবাকে ইসলামী আইন ভঙ্গে অভিযুক্ত করার ঘটনায় জেবুন্নিসা আকবরকে সমর্থন করলে আওরঙ্গজেব তাকে কারারুদ্ধ করেন।
অর্জনের দিক থেকে জেবুন্নিসা ছিলেন তার আমলের অন্যান্য রাজকুমারীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তবুও মানুষজন তার চরিত্রে কালিমা লেপনের জন্য সবসময় মুখিয়ে থাকতো। অনেক পুরুষ বন্ধু থাকলেও জেবুন্নিসা তার পুরোটা জীবন বিয়ে না করেই কাটিয়ে দেন। তার দাদা সম্রাট শাহজাহান চেয়েছিলেন জেবুন্নিসাকে দারা শিকোহর ছেলে সোলায়মান শিকোহর কাছে বিয়ে দিতে। দারা শিকোহ শাহজাহানের প্রিয় ছেলে ছিলেন বলেই এমন ইচ্ছা ছিলো তার। কিন্তু আওরঙ্গজেব তার বড় ভাই দারা শিকোহকে পছন্দ করতেন না। ফলে তার আপত্তির মুখে এই বিয়ে আর আলোর মুখ দেখে নি।
জেবুন্নিসার কুমারী থাকার সিদ্ধান্ত রাজপ্রাসাদে তাকে নিয়ে অস্বস্তিকর গুজবের জন্ম দেয়। এমনকি বাঙালি ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রও মোবারক খানের সাথে জড়িয়ে জেবুন্নিসাকে অভিযুক্ত করেন। এটি একটি দুঃখজনক বিষয় যে, এমন একজন সফল রাজকন্যার জীবন নিয়ে এমন কুৎসিত গুজব রটানো হয়। এসব রটনার পরিবর্তন এনে সত্য ইতিহাস রচনার সময় এখনই। আমাদের বোঝা উচিত যে, ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের চারিত্রিক তাৎপর্য খর্ব করে আসলে কোনো লাভ নেই। কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে অসত্য তথ্য উপস্থাপন করলে মানুষের মনে ঐ অসত্য তথ্যটিই জায়গা করে নেয়। মিশরের রাণী ক্লিওপেট্রা যদি ইতিহাসে এতোটা বাহবা পেতে পারেন, তবে জেবুন্নিসাকে কেনো আমরা একই মর্যাদা দিতে পারছি না?
এটি একটি অনুতাপের বিষয় যে, ইতিহাস লেখা হচ্ছে শুধুমাত্র একটি সমাজের উপর ভিত্তি করে। অথচ সমাজ একটি বিস্তৃত বিষয়, যা পুরো বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করে। কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের নির্দিষ্ট মতবাদ বা বিশ্বাসের ভেতর ইতিহাসকে আবদ্ধ রাখা উচিত নয়। বরং ইতিহাসকে এমনভাবে উপস্থাপন করা উচিত, যেনো কেউ ঐতিহাসিক বিষয়ে প্রশ্ন তুললে পর্যাপ্ত প্রায়োগিক তথ্য দিয়ে সেই প্রশ্নের পরিপূর্ণ জবাব দেয়া সম্ভব হয়।
আজকের দিনে সিনেমা ও বইয়ে সবচেয়ে বেশি ইতিহাস বিকৃতি হচ্ছে। এতে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার মিথ্যা বয়ান প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। ঐতিহাসিক চরিত্র ও ঘটনাকে বিকৃত করে উপস্থাপন শুধুমাত্র সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে দেয় না, বরং এটি সমাজ ও অঞ্চলের ভেতরে বিভেদের বৃক্ষ রোপণ করে, যা দিন শেষে বৈশ্বিক শান্তিকে বাধাগ্রস্ত করে তোলে। বলিউড মুভি ‘পদ্মাবত’ এমনই একটা সিনেমার উদাহরণ। এই বিকৃত ধারাকে বন্ধ করতে হবে, নয়তো জেবুন্নিসার মতো ব্যক্তিত্বকেও বিতর্ক আর চরিত্র হননের রাহুর গ্রাসেই আটকে যেতে হবে। জেবুন্নিসার মতো প্রতিভাবান, তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী, সাহসী রাজকন্যাকে অবশ্যই তার প্রাপ্য মূল্যায়ন করতে হবে। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার বেড়াজালে পড়ে ঐতিহাসিক চরিত্রের সত্যতার যেনো সলিল সমাধি না হয়, এটাই কামনা থাকবে।