১৭৮৮ সালের সেই সময়টাতে ফ্যাশন জগতে ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনাররা যখন বৈচিত্র্যপূর্ণ ও নতুনত্বে ভরপুর কোনো কিছু উপস্থাপন করতে পারছিলেন না, ঠিক তখনই ভারতীয় উপমহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মহীশূর থেকে কয়েকজন প্রতিনিধি প্যারিসে পৌঁছান। এই প্রতিনিধিদেরকে পাঠিয়েছিলেন স্বয়ং মহীশূরের টিপু সুলতান। কারণ তিনি বিদেশী শক্তিদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে নিজ দেশের স্বাধীনতা বজায় রাখতে সব সময় সচেষ্ট ছিলেন।
রাজা ষোড়শ লুইয়ের কাছে টিপু সুলতানের বার্তা বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন তার প্রেরিত প্রতিনিধিরা। ষোড়শ লুই এবং টিপু সুলতান উভয়েরই শত্রু ছিলো ব্রিটিশরা। টিপু সুলতান চাচ্ছিলেন, ফ্রান্সের সাথে যৌথভাবে একটি সামরিক শক্তি গঠন করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অগ্রসর হবেন। এই উদ্দেশ্য থেকেই তিনি দূত পাঠান সেখানে। ১৭৮৮ সালের ৯ জুন তার প্রতিনিধিরা টুলন বন্দরে পৌঁছান।
যদিও এই কূটনৈতিক সফর খুব একটা সফলতা পায়নি, তবে ভারতীয় উপমহাদেশের তিন জন উচ্চবর্গীয় প্রতিনিধির পোশাক-আশাক ফ্রান্সের ফ্যাশন জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলো। খুব আশ্চর্যের বিষয়, তাই না? তবে এটি সত্যি যে, টিপু সাহেব কোনোদিন ফ্রান্সে না গিয়েও ঐ সময় সেখানকার এক জনপ্রিয় সেলিব্রেটিতে পরিণত হয়েছিলেন।
টিপু সুলতানের পাঠানো সেই তিন জন রাষ্ট্রদূত হলেন মোঃ দরবেশ খান, মোঃ ওসমান খান এবং আকবর আলী। তাদের সাথে ছিলেন সুলতানের দুজন আত্মীয় এবং ত্রিশ জন সহকর্মী। তারা ষোড়শ লুইয়ের সাথে দেখা করবার উদ্দেশ্যে ফ্রান্সে গিয়েছিলেন, কিন্তু রাজার দেখা সাথে সাথেই মেলেনি। তাদেরকে কিছু দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। অখণ্ড অবসর ছিলো তাদের হাতে। তাই সময় কাটাতে তারা ঘুরে বেড়ালেন প্যারিসের থিয়েটার, পার্ক ও গীর্জাতে।
ভারতীয়দের জমকালো পোশাক-পরিচ্ছদ, তাদের চলাফেরা, অলঙ্কার -সমস্ত কিছুই ছিলো ফরাসিদের থেকে আলাদা। আর ফ্রান্সবাসীদের চোখে সেটাই ছিলো নতুনত্বে পূর্ণ। তাই খুব সহজেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষিত হচ্ছিলো তাদের ওপর।
এদিকে ভারতীয় অতিথিরা গেলেন অপেরা দেখতে। সেই সময়ের বিখ্যাত নারী চিত্রশিল্পী এলিজাবেথ লুইস ভিজে লি ব্রুনও ছিলেন ঐ অনুষ্ঠানে। সবাই যখন অনুষ্ঠান শুরুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তখন ভারতীয়দের জমকালো পোশাক-পরিচ্ছদে আকৃষ্ট তাদের প্রতিকৃতি তৈরি করবার ভীষণ ইচ্ছা প্রকাশ করলেন এলিজাবেথ। কিন্তু ইসলামে মানুষ এবং প্রাণীর ছবি আঁকা নিষেধ। তাই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে টিপুর প্রতিনিধিরা তার এই প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখান করে দেন। কিন্তু রাজা ষোড়স লুই যখন এ ব্যাপারে জানতে পারলেন, তখন তিনি তাদেরকে ভীষণভাবে অনুরোধ করতে শুরু করলেন। অতঃপর রাজার অনেক অনুরোধে এই তিন জন অতিথি রাজি হতে বাধ্য হলেন। শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের প্রতিকৃতি তৈরী করবার অনুমতি দিলেন।
এলিজাবেথের ভাষায়, “১৭৮৮ সালে সম্রাট টিপ্পু-সায়েব প্যারিসে রাষ্ট্রদূতদের পাঠিয়েছিলেন। আমি অপেরায় এই ভারতীয়দেরকে দেখেছি এবং আমার কাছে তাদেরকে এতো অসাধারণ ও মনোরম মনে হয়েছিলো যে, আমি তাদের প্রতিকৃতি আঁকতে চেয়েছিলাম। তাদের দোভাষীর কাছে আমার ইচ্ছার কথা জানিয়ে আমি জানতে পারলাম যে, রাজার কাছ থেকে অনুরোধ না এলে তারা কখনোই ছবি আঁকাতে সম্মত হবেন না। তাই আমি মহামহিম থেকে এই অনুগ্রহ পেয়েছি।”
এলিজাবেথ লুইস ভিজে লি ব্রুনের আঁকা মোঃ দরবেশ খানের প্রতিকৃতিটি ফ্রান্সে একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির সংগ্রহশালায় আজও রয়েছে। তবে ওসমান এবং আকবরের প্রতিকৃতি দুটোর আজ পর্যন্ত কোনো হদিস মেলে নি।
পৃথিবীর এক প্রান্তে অবস্থিত টিপু সুলতানেরর দরবার থেকে আসা তিন জন দরবারি সুদূর ফ্রান্সের ফ্যাশন-প্রেমীদের মনে বিস্ময় ও কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছিলেন ব্যাপকভাবে। তাদের পোশাকের ওপর নিখুঁত সোনার সুতার কাজ, ফুলতোলা মালা -সমস্ত কিছু সে সময়কার ফরাসি ফ্যাশন জগতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলো। ফরাসি ফ্যাশন ব্যবসায়ীরা তাদের পোশাক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ফরাসিবাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এ যেনো পুরোদস্তুর নাটকীয় ঘটনা! পরবর্তীতে টিপুর সাথে নেপোলিয়ানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও এই ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।
রেফারেন্সঃ
Tipu Sultan’s foreign diplomacy through the letters of Thomas Jefferson