১৮৬১খ্রিঃ ৭ মার্চ এই সাপ্তাহিকটি যাত্রা শুরু করে টিকে ছিলো একশত বছরেরও বেশী সময়। শুরুতে পত্রিকাটি ছিলো ঢাকার বহুল আলোড়ন সৃষ্টিকারী ব্রাক্ষ্ম সমাজের মুখপাত্র। কিন্তু পরে অনেকবার হাত বদল হোতে হোতে তা আর থাকেনি। ঢাকা প্রকাশ শুরুতে প্রচার সংখ্যা ছিলো ২৫০ এবং শেষ দিকে ৫০০০ এরও বেশী। ঢাকা প্রকাশ পত্রিকাটি ছাপাখানার নাম ছিলো বাঙ্গালা যন্ত্র। ১৮৪৮ সাল থেকে ১৮৫৭ সালের মধ্যে দুটি ছাপাখানা ছিলো। এই বাঙ্গলা যন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যাদের অবদান ছিলো তারাই ছিলেন সে সময়কার ঢাকার সম্রান্ত সুশীল সমাজের মানুষ, এলিট শ্রেণি। সাভারের ব্রজসুন্দর মিত্র, ধামরাইয়ের দীনবন্ধু মৌলিক, মুন্সিগঞ্জের রাঢ়িখালের ভগবানচন্দ্র বসু বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর পিতা, মালাখানগরের রামকুমার বসু এনারা চারজনই ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট আর ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বসু, বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর কাকা। ভগবানচন্দ্র বসু শুরুতে ছিলেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সে সময় তার মেয়ে স্বর্ণপ্রভা বসুর বিয়ে হয় ইংল্যান্ডের ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিষয়ক সর্বোচ্চ পরীক্ষায় তিনটি বিষয়ে প্রথম শ্রেণি অর্থাৎ সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে র্যাং লার RANGLAR উপাধি পাওয়া ময়মনসিংহের হাওরের ছেলে আনন্দমোহন বসুর সাথে, ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজটি সগৌরবে এই আনন্দমোহনেরই নাম ঘোষণা করে যুগ যুগ ধরে। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু বিয়ে করেছিলেন মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুরের বিখ্যাত দাস পরিবারের দূর্গামোহনদাসের মেয়ে অবলা দাসকে। ঢাকার মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুরের দাসবাড়ীর দাসদের শেকড়, যে এতটাই শিখরে পৌছে গিয়েছিলো তা কুলিন শ্রেনিকেও লজ্জায় ফেলে দিয়েছিলো। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ীর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মুন্সিগঞ্জের দাসবাড়ীর লেডি অবলাদাসকে যে ভাষায় ও শব্দ চয়নে চিঠি লিখেছেন তা আজ ইতিহাসের স্বাক্ষী। সেই চিঠিতেই জানা যায় রবীন্দ্রনাথ অবলার মধ্যে নাকি কাদম্বরীর ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন।

ঢাকাপ্রকাশ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন স্বনামধন্য কিংবদন্তী কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার। যে জন দিবসে মনের হরষে, জ্বালায় মোমের বাতি, আশুগৃহে তার দেখিবে না আর, নিশীথে প্রদীপ ভাতি’ কিংবা ‘চির সুখীজন ভ্রমে কি কখন, ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে; অথবা কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে’- আমাদের শৈশবের কৈশোরের এসব কবিতা এখনো আমাদের মুখস্ত। এ তিনটি কবিতা যিনি রচনা করে আমাদের স্মৃতিতে আজও অমর হোয়ে আছেন তিনিই কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার। কৃষ্ণচন্দ্রের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সদ্ভাবশতক’ প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালে ঢাকায়। কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা করেছেন ১৯ বছর। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটীতে সেই কবির জন্মস্থানের স্মৃতিচিহ্নগুলো দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। ১৮৬৫ সালের এপ্রিল মাসে পত্রিকাটির দ্বিতীয় সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন স্কুল ইন্সপেক্টর দীননাথ সেন। পরে জগন্নাথ অগ্নিহোত্রী, গোবিন্দপ্রসাদ রায়, অনাথবন্ধু মল্লিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ডাকমাশুলসহ পত্রিকার বার্ষিক মূল্য ছিল ৫ টাকা। কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের পর ‘ঢাকা প্রকাশ’-এর সম্পাদক হয়েছিলেন দীননাথ সেন। দীননাথ সেন ছিলেন একজন বাঙালি সমাজ সংস্কারক এবং ঢাকার পত্রিকা জগতের প্রথম সাংবাদিক। তিনি ঊনবিংশ শতকে ঢাকার শিক্ষা-সংস্কৃতিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশের ঢাকা শহরের প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ঢাকাপ্রকাশের তিনি দ্বিতীয় সম্পাদক ছিলেন। দীননাথ সেন ১৮৩৯ অথবা ১৮৪০ সালে মানিকগঞ্জের দশরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার কর্মস্থল কুমিল্লায় হওয়ায় প্রথমজীবনে কুমিল্লা জিলা স্কুলে লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা কলেজে শিক্ষালাভ করেন। দীননাথ ১৮৬১ সাল থেকে ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত পোগোজ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি এ বিদ্যালয়ের প্রথম বাঙালি প্রধান শিক্ষক। ১৮৬৬ সালে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলেও শিক্ষকতা করেন। পূর্ববঙ্গের স্কুলগুলোর ডেপুটি ইন্সপেক্টর হিসেবেও কিছুকাল সরকারি দায়িত্ব পালন করেন।

১৮৫৮ সালে ঢাকার তৎকালীন ব্রাহ্ম স্কুল প্রতিষ্ঠার পর (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) মেয়েদের জন্য পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইডেন স্কুল প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন অন্যতম একজন। তিনিই প্রথম ঢাকার গেন্ডারিয়াতে জমি ক্রয় করে বাড়ি নির্মাণ করেন যার ফলে গেন্ডারিয়া আবাসিক এলাকা প্রতিষ্ঠিত হয়। তার নাম অনুসারে গেন্ডারিয়ার একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘দীননাথ সেন রোড”। দীননাথ সেনের আর একটি ছোট্ট পরিচয় হলো বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী নায়িকা পাবনা শহরের মেয়ে সুচিত্রা সেন তার নাতবৌ। অর্থাৎ পুত্র আদিনাথ সেন এবং আদিনাথের পুত্র দিবানাথ সেনই মহানায়িকা অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের স্বামী এবং মুনমুন সেনের বাবা, রাইমা সেন ও রিয়া সেনের দাদু। ঢাকার প্রথম সবাক সিনেমা মাটির পাহাড়ের নায়িকা ডাঃ রওশন আরার বাড়ীও পাবনা এবং তিনি ছিলেন সুচিত্রা সেন বান্ধবী ও স্কুল জীবনের সহপাঠী। কবি বন্দে আলী মিয়ার শ্যালিকা ডাঃ রওশন আরা নায়ক রহমানের সাথে নতুন সূর, খান আতাউর রহমানের সাথে যে নদী মরুপথে, আনোয়ার হোসেনে সাথে সূর্যস্নান, মেঘের অনেক রং এবং নদী ও নারী এসব সিনেমায় অভিনয় করেন। ঢাকার নতুন নতুন প্রজন্মের মানুষরা ডিজিটাল পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে ফেলে আসা ইতিহাস থেকে অনুধাবন করতে পারবেন আপনার অহংকারের জায়গাটি খুব ছোট না, আদি ও ঐতিহ্যময়। রেজাউল করিম মুকুল, ৬ অক্টোবর, ২০২১খ্রিঃ।