কৃষক আন্দোলন ভারতের ইতিহাসে নতুন বিষয় নয়। বিশেষত ব্রিটিশ রাজের শাসনকালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এ দেশের কৃষকদের ক্ষোভ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। রংপুর বিদ্রোহ, পাগলপন্থীদের বিদ্রোহ, সাঁঁওতাল বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, দক্ষিণের মহাজন বিরোধী বিদ্রোহ সহ অগুণতি বিদ্রোহের সাক্ষী থেকেছে ভারতবর্ষ। পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এই সকল বিদ্রোহগুলি ছিল যেমন ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে; তেমনই জমিদার, জোতদার, মহাজনদের অত্যাচারের বিরুদ্ধেও।
ভারতবর্ষে কৃষক আন্দোলনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয় কৃষক সভার নেতৃত্বে। ‘সারা ভারত কৃষক সভা’ প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৩৬ সালে। লাল পতাকা কাঁধে নিয়ে, বৈপ্লবিক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শ্রেণি সংগ্রামের পথে গড়ে উঠছে থাকে কৃষক আন্দোলনের যাত্রাপথ। তেভাগা আন্দোলন ছিল বর্গাদার বা ভাগচাষীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। আমাদের মনে রাখা জরুরী, ৪৬-এর দাঙ্গায় বিপর্যস্ত বাংলায় পটভূমি। এও আমরা স্মরণে রাখব, তেভাগার লড়াইতে শাসককূলের বিপরীতে একযোগে লড়াই করেছেন হিন্দু মুসলমান চাষীরা। ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্ট (১৯৪০) থেকে জানা যায়, ৭৫ লক্ষ কৃষিজীবী পরিবারের মধ্যে ৩০ লক্ষ পরিবারের জমিতে প্রজাস্বত্বের অধিকার ছিল না৷ তাঁরা ছিলেন ভাগচাষী বা ক্ষেতমজুর। তেভাগা আন্দোলনের মূল দাবি ছিল, ভাগচাষীরা ফসলের আধাভাগের বদলে তিনভাগের দুইভাগ নেবে। বেআইনি কোনো আদায় জোতদার বা মহাজনকে দেওয়া হবে না। আওয়াজ উঠল – “জান দিব তবু ধান দিব না।”
আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল উত্তরবঙ্গ, বিশেষ করে দিনাজপুর, রংপুর, জলপাইগুড়ি, যশোহর, পাবনা, ময়মনসিংহ জেলায়, চব্বিশ পরগণা, মেদিনীপুর, মালদা প্রভৃতি জেলাতে তেভাগার লড়াই তীব্র হয়ে উঠেছিল। ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে সমিতির সংগঠিত এলাকাগুলিতে ধান উঠতে শুরু করল বর্গাদারদের নিজ খামারে বা ভাগাভাগি করে দশের খামারে। প্রাথমিক লড়াই জয়ের পরেও সামনে ছিল শাসকের রক্তচক্ষু। সুবিশাল এলাকায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার ফলে তা আর কৃষক সভা, সমিতির নিয়ন্ত্রণে রইল না। হিন্দু মুসলিম জোতদাররা মিলে গড়ে তুলল জোতদার সমিতি। আইনসভায় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ বর্গাদার বিলের বিরোধিতা করল। শুরু হল প্রচণ্ড দমন-পীড়ন। দিনাজপুর জেলায় বন্দুকের গুলিতে প্রাণ হারান ৩৩ জন কৃষক, জলপাইগুড়িতে ১৪ জন, ময়মনসিংহে ২ জন। শত অত্যাচার, শোষণের বিপরীতে সেদিন শহীদের রক্তে ভেজা বাংলায় মাটি সাক্ষী থাকল ক্ষেত মজুর, ভাগচাষিদের মরণপণ সংগ্রাম। দাঙ্গার বিভীষিকাময় ইতিহাস ভুলে হিন্দু-মুসলমানের এক যোগে শ্রেণী সংগ্রামের পথে যাত্রা অন্য এক ইতিহাসের জন্ম দিল, বা ঘটল ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।

জোতদার জমিদারদের শোষণে অসহায়ের আর্তচিৎকার; Image source: The naxalite

তেভাগা আন্দোলনের আরেকটি বড় সাফল্য – নিরক্ষর, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন অনগ্রসর কৃষক সমাজকে এক মানবিক ও গণতান্ত্রিক চেতনায় সঞ্জীবিত করে তোলে। মুসলিম, রাজবংশী, নমঃশূদ্র, উপজাতির কৃষকদের মধ্যে যে বিস্তর সামাজিক ব্যবধান ছিল, তা তেভাগা আন্দোলনের জোয়ারে ভেঙে যায়। ইতিহাসে আরও একবার প্রমাণিত হয়, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে শোষিত মানুষের মুক্তি ঘটে শ্রেণী সংগ্রামের পথে, রক্তবর্ণ পতাকার তলদেশে।
এছাড়া তেভাগার লড়াইতে নারী সমাজের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলনের সাথে জড়িত নারী নেত্রী ইলা মিত্রের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার এই নারী নেত্রীকে তেভাগা আন্দোলনের জন্য সহ্য করতে হয়েছে অকথ্য নির্যাতন। তেভাগা আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকার কারণে পুলিশ তাঁকে আটক করে এবং স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী নেওয়ার জন্য তাঁকে বিবস্ত্র করা থেকে শুরু করে পুলিশ হেফাজতে ধর্ষণ পর্যন্ত করা হয় এমনকি তাঁর পায়ের মধ্যে পেরেক ঢুকানো হয়। তেভাগা আন্দোলনের সাথে জড়িত নারীরা লাঠি হাতে ফসল পাহারা দিয়েছেন, পুলিশের সাথে লড়াই করেছেন, অনেক সময় শাঁখ, কাঁসি বাজিয়ে পুলিশ আসার বিষয়ে সতর্ক করেছেন পুরুষ যোদ্ধাদের।
বাংলার সাহিত্যে শিল্পকলায় থেকে গেছে তেভাগার স্মৃতি, সংকল্প। ১৯৪৬ সালে খুলনার মৌভোগে অনুষ্ঠিত কৃষক সম্মেলনে কবি বিষ্ণু দে রচনা করেন ‘মৌভোগ কবিতা’। চন্দনপিঁড়ির ‘অহল্যাে মা’ বিখ্যাত হয়ে অনেক গানে। তেভাগা আন্দোলন নিয়ে গণসংগীতশিল্পী বিনয় রায় করেন, “আর কতকাল, বল কতকাল, সইব এ মৃত্যু আসান” গানটি। তেভাগার শহীদরা অনুপ্রেরণা দিয়েছেন বিখ্যাত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে। শিলচর জেলে বন্দি কৃষক মাধবীনাথের মৃত্যু হয়, তাঁর স্মরণে ভাটিয়ালির একটি বিশেষ ঢঙে হেমাঙ্গ বিশ্বাস রচনা করেন – “আমরা তো ভুলি নাই শহীদ একথা ভুলবো না/ তোমার কলিজার খুনে রাঙাইলো কে আন্ধার জেলখানা।” ১৯৪৮-এ বড়া কমলাপুরে কৃষক-পুলিশ যুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’ বাংলা সাহিত্যে সুপরিচিত। ১৯৫০-এর দশকেই রচিত হয় সাবিত্রী রায়ের উপন্যাস ‘পাকা ধানের গান’। ভারতীয় চলচ্চিত্রে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে ১৯৫৩ সালে নির্মিত পরিচালক বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’। এ ছবির নৈপুণ্য, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।

বিমলা মাঝির নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে তেভাগা আন্দোলনে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ; Image source: Aaj abhi

এভাবেই বাংলা তথা এদেশের ইতিহাসে কৃষক আন্দোলনগুলি একদিকে মুছে দিয়েছে ধর্মীয় হানাহানি, সাম্প্রদায়িক শক্তির উস্কানি। অন্যদিকে গড়ে তুলতে চেয়েছে ও অনেকাংশ সক্ষম হয়েছে শাসক-শোষক বিরোধী সবহারানো জনগণের জান-কবুল লড়াই।
লেখা – রাতুল গুহ

অভিশপ্ত রাজকুমারীর কবর: লি জিংসুন ও চীনের রহস্যময় সমাধি

অনেক অনেক বছর আগে, চীনের এক অভিশপ্ত রাজকুমারীর সমাধি ঘিরে জন্ম নেয় অজস্র কাহিনি। মানুষ বিশ্বাস করত—মৃত্যু মানেই সবকিছুর শেষ নয়। এক নতুন জীবন শুরু হয় আরেক জগতে। তাই মৃতদের সমাধিতে রেখে দেওয়া হতো দামী জিনিসপত্র, যেন পরকালেও রাজকীয়ভাবে বেঁচে থাকতে পারেন তাঁরা। কিন্তু এই...

কপিলাবস্তুর সন্ধান: গৌতম বুদ্ধের হারানো ইতিহাস যেভাবে উদ্ধার করেন বাবু পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব শুধু ভারতবর্ষেই নন, সমগ্র বিশ্বের ধর্মীয় ইতিহাসকে তিনি বদলে দিয়েছিলেন। তিনি বদলে দিয়েছিলেন মানুষের চিন্তাধারা, ভাবনা ও দর্শনকে। শাক্য রাজপরিবারের রাজপুত্র তিনি। কিন্তু রাজপ্রাসাদে তাঁর মন টিকল না। একদিন রাজত্ব ও কপিলাবস্তুর নগর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন মানুষের...

শিউলি ফুলের বিষণ্ণতার গল্প

শরতের রাতের সৌন্দর্য বলতে যে ফুলকে বোঝানো হয়, তা হলো শিউলি ফুল। তবে এ সৌন্দর্য আনন্দের নয়, বেদনার প্রতীক। শিউলি ফুলের নাকি সব সময়ই মন খারাপ থাকে। সূর্যের ওপর তার এক রাশ অভিমান। তাই তো রাতের আঁধারেই নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পছন্দ করে সে এবং সূর্য ওঠার আগেই লুকিয়ে ঝরে পড়ে।...

মিশরীয় সিন্ডারেলা

মিশরে তখন ১৬ তম রাজবংশের যুগ। পার্সিয়ান আক্রমনের সম্ভাবনায় দিন গুণছে মিশর। সে সময় মিশরীয় সৈন্যদের তুলনায় গ্রীক সৈন্যদের কদর ছিলো অনেক বেশি। কারণ গ্রীক সৈন্যদের দক্ষতার গল্প প্রচলিত ছিলো বিশ্ব জুড়ে। এমন সময় ফারাও এপ্রিয়েজকে হত্যা করে মিশরের নতুন ফারাও হলেন রাজবংশের...

প্রাচীন সভ্যতায় ঈশ্বরের ধারণার উৎপত্তি ও সংখ্যাগত অবনমন

যে কোন সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলেই আমরা বহু ঈশ্বর বা গডের অস্তিত্বের কথা জানতে পারি। তবে আজকের প্রেক্ষাপটে ঈশ্বর সম্পর্কে এ ধারণা অনেকটাই পাল্টেছে। কেননা বর্তমান বিশ্বে বহু ধর্মমত এখনও বিদ্যমান থাকলেও ঈশ্বরের সংখ্যার বিষয়টি কমে এসেছে। একেশ্বরবাদ কিংবা বহুঈশ্বরবাদী...

মেহেদী হাসান খান

মেহেদী হাসান খান ১৮ বছর বয়সের মেহেদী হাসান খান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হলেন,কিন্তু পড়াশোনায় তার মন নাই! কিন্তু কেন? তিনি নাওয়া- খাওয়া, পড়াশোনা বাদ দিয়ে একটা ছোট্ট কম্পিউটার সম্বল করে বাংলা ভাষায় লেখার জন্য লড়াই শুরু করলেন। একটাই জেদ, বাংলা...

ঢাকার হারিয়ে যাওয়া সংগ্রহশালা- বলধা জাদুঘর

১৯২৫ সালের ঢাকা; ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে রেললাইন ধরে নারায়ণগঞ্জের দিকে কিছুদূর এগুলে উয়ারি। উয়ারির শেষ সীমানায় এক সরু রাস্তা চলে দিয়েছে নারিন্দার দিকে। সরু সেই রাস্তার একপাশে বহু পুরাতন খ্রিস্টান কবরখানা আর তার বিপরীতে উঁচু পাচিলঘেরা কম্পাউন্ডের ভেতর দোতলা...

সুন্দরবন ধ্বংসের ইতিবৃত্ত

ব্রাজিলের চিরসবুজ বিস্তৃত এমাজন (Amazon Rainforest) গহীন বনাঞ্চলকে বলা হয় বিশ্বের ফুসফুস, তেমনি সুন্দরবনও বাংলাদেশের শ্বাস-প্রশ্বাসের এক অঙ্গ। এই ঘন বনাঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও এক প্রতিরোধ। সুন্দরবনকে ঘিরে আশেপাশের জনপদে ছড়িয়ে আছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী। এমনি...

ঢাকার এক বিস্মৃত চিকিৎসক

দিনটি ছিল ১৫ই নভেম্বর ১৮৬৪ সাল, মঙ্গলবার। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই। নারিন্দার খ্রিস্টান কবরস্থানের দীর্ঘ ঘাসের ঝোপে অবশ্য তখনই অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা হলে এই এলাকায় সহজে কেউ পা বাড়ায় না। কিন্তু সেদিন পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য- আছে ইংরেজ, আরমেনিয়, দেশী সব...

ঢাকার ঐতিহাসিক তারা মসজিদ

পূর্বকথাঃ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আরমানিটোলার মহল্লা আলে আবু সাঈদে তখন এক প্রভাবশালী জমিদারের বাস, নাম- মীর্জা গোলাম পীর। দাদা মীর আবু সাঈদ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা যুগে তুরস্ক থেকে এসে ঢাকায় থিতু হয়েছিলেন। মীর্জা গোলাম পীরের আরেক নাম মীর্জা আহমেদ জান। তবে...