২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক সকাল; পুরান ঢাকার যানজট ঠেলে চিত্রকর গেভর্গ এনজা এবং ফাদার সেভাক যখন আর্মেনি গীর্জার সামনে এসে দাঁড়ালেন তখন ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছুঁইছুই করছে। এ শহর গেভর্গের জন্য নতুন। ঢাকায় পৌঁছেই দেখেছেন শহরের মানুষ মেতে আছে বসন্ত উৎসবে। শহর জুড়ে যেন রঙের মেলা। আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় খানিকক্ষন ঘুরে বেড়িয়েছেন। আঁকার জন্য মানুষের মুখ তাঁর বড় প্রিয় বিষয়। ঝটপট কয়টা ড্রয়িংও সেরে নিয়েছেন, সুযোগ পেলে সেগুলোয় রঙ চাপাবেন। তবে এ শহরে তিনি ছবি আঁকবার উদ্দেশ্যে আসেননি। তিনি এবং ফাদার সেভাক এসেছেন আর্মেনিয়ান চার্চ সোসাইটির আমন্ত্রণে, উদ্দেশ্য দু’টি পুরাতন চিত্রকর্ম মেরামত। গীর্জার ওয়ার্ডেন আরমেন আর্সলানিয়ান আগেই চিত্রকর্ম দু’টির জীর্ণ দশার কথা জানিয়েছিলেন। আরমেনের ধারণা ছিল একটি যদিও বা কষ্টেসৃষ্টে ঠিক করা যাবে কিন্তু আরেকটি একেবারেই মেরামতের অযোগ্য। গেভর্গ এবং সেভাকের সামনে চিত্রকর্ম দু’টি মেলে ধরলেন গীর্জার লোকেরা। ‘ক্রুসিফিকেশন’ নামের ছবিটির অবস্থা বেশ ভালো, মেরামতে বেগ পেতে হবে না। কিন্তু অপর চিত্রকর্মটির অবস্থা করুণ। জলভেজা আবহাওয়া তো ছিলই, শত বছর ধরে জ্বালানো সব মোমবাতির ধোঁয়া এ ছবির উপরে এমন পুরু আস্তর ফেলেছে যে আঁকা মুখগুলো চেনাই কঠিন হয়ে পড়েছে। এখানে ওখানে রঙ উঠে গেছে। ফ্রেমটা আলতো করে তুলতেই মনে হলো ক্যানভাসটা গুড়ো গুড়ো হয়ে ভেঙে পড়বে। এটাই আশংকা করেছিলেন ওয়ার্ডেন জনাব আরমেন। গেভর্গ এবং সেভাক- দু’জনের কপালে চিন্তার রেখা গভীর হয়ে উঠল। দু’টি চিত্রকর্ম একই শিল্পীর আঁকা; তাঁর নাম চার্লস পোট। উনিশ শতকের আলোচিত এই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান চিত্রকর জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন ঢাকায়। পোগজ স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন তিন বছর। আশ্চর্য হলেও সত্যি, খুব কম সংখ্যক চিত্রকর্মেই শেষ করবার পর নিজ স্বাক্ষর রেখেছিলেন পোট। প্রমাণসিদ্ধ অল্প যে ক’টি চিত্রকর্মের নাম জানা যায় সেসবের মধ্যে আর্মেনি গীর্জার দ্বিতীয় এই চিত্রকর্মটি সবচেয়ে আলোচিত, নাম- ‘দ্য লাস্ট সাপার’। অনবদ্য এই চিত্রকর্মের মেরামত যে তাঁদের করতেই হবে! গভীর মনোযোগে ছবিটার উপর ঝুঁকে পড়লেন গেভর্গ।
চার্লস পোটের বাবা এডোয়ার্ড এফ্রাইম পোট ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট। বিলেতের কিংস কলেজে অধ্যয়ন শেষে এডোয়ার্ড বাংলায় এসেছিলেন ১৭৭৩ সালে এবং এরপর রংপুর, পাটনা সহ বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করেছেন। তিনি একাধিক বিয়ে করেছিলেন। এডোয়ার্ডের আট সন্তানের ব্যাপ্টিজমের রেকর্ড পাওয়া যায়। এর মাঝে চার্লস পোট এবং তাঁর ভাই ফিলিপ পোটের ব্যাপ্টিজম হয়েছিল বিরহামপুরে, ১৭৯৪ সালের জুন মাসে। ১৮০০ সালের মার্চে অসুস্থতার কারণে এডোয়ার্ড কোম্পানির পদ থেকে ইস্তফা দেন।
চার্লস পোট বেড়ে উঠেন কলকাতায়। তিনি ছিলেন ডেভিড ড্রুমন্ডের ধর্মতলা একাডেমির ছাত্র। একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিলেন কবি, শিক্ষাবিদ হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিয়ো, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখ। স্কটিশ ডেভিড ড্রুমন্ডের মুক্তচিন্তার চর্চা তাঁর ছাত্রদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। বয়সে কয়েক বছরের ছোট হলেও ডিরোজিয়োর সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে পোটের। সমমনা একদল বিভিন্ন বয়সী কিশোর তখন কলকাতায় বেড়ে উঠছে ড্রুমন্ডের শেখানো আদর্শে। পোট এবং ডিরোজিয়োর আরো যে বন্ধুদের নাম জানা যায় তাঁরা হলেন ডিসুজা, ডিকস্টা, ম্যাকলয়েড, গ্যালওয়ে, কির্কপ্যাট্রিক প্রমুখ। তাঁরা কখনো দল বেঁধে চলে যাচ্ছেন ময়দান, মেতে উঠছেন ক্রিকেট খেলায়, কখনো স্কুলে নাটক নামাচ্ছেন, আর সাথে স্বপ্ন দেখছেন শিক্ষার প্রসারে সমাজ পরিবর্তনের।
পোট যে সমাজে বড় হয়েছেন সেখানে মিশ্র রক্তের কারণে তাঁর পরিচয় ছিল ইউরেশিয়ান। ১৯১১ সালের আদমশুমারির আগে পর্যন্ত অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের পরিচয় কাগজেপত্রে এভাবেই লেখা হতো। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনকালে বর্ণশংকর এই জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত নানা বৈষম্যের শিকার হতো। প্রায় প্রতিটি পেশাতেই প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের নিজ জায়গা করে নিতে প্রচুর বেগ পেতে হয়। একই সাথে ইংরেজ কায়দায় ইংরেজি বলার দক্ষতা এবং দেশি ভাষা বোঝার সক্ষমতার কারণে প্রথম থেকে দু’টি পেশায় তাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়- একটি হলো মিশনারির কাজ, অপরটি শিক্ষকতা। তবে বঞ্চনার হিসাব এখানেও লক্ষণীয়। ভাষার দক্ষতা এবং কর্তব্যপরায়নতার চমৎকার রেকর্ড সত্ত্বেও ১৮১৪ থেকে ১৮৩১ সালের ভেতরে লন্ডন মিশনারি সোসাইটি যে ৭৭জন মিশনারি নিয়োগ দিয়েছিল তাদের মধ্যে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছি্লেন মাত্র ৭জন। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার স্কুলগুলোতে সহকারী শিক্ষক পদে বেশ কিছু অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কাজ করেছেন। সেসময়ে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তাদের বেতন ছিল ৫০টাকা থেকে শুরু করে ১৫০টাকা পর্যন্ত। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি না থাকায় এসকল শিক্ষকের পদোন্নতির কোনো সুযোগ ছিল না। অ্যাংলো সমাজের অধিকাংশের জন্য এতো টাকা খরচ করে বিলেত থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে আসা তখন অকল্পনীয় বিষয়। কিছু ব্যতিক্রম ছিল, যেমন প্যারেন্টাল একাডেমি নামের স্কুলে প্রতিষ্ঠার পরপর দু’চারজন অ্যাংলো ব্যক্তিকে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে অন্য স্কুলের মতন এ স্কুলেও বিলেত থেকে আসা ইংরেজকেই উচ্চ বেতনে নিয়োগ দেয়া হতো। সেই ইংরেজ যদি নবাগত হয় তবু চাকরি ক্ষেত্রে তারই প্রাধান্য থাকত এবং একজন অ্যাংলোর চেয়ে বহুগুণ বেশি বেতনে তাকে নিয়োগ করা হতো। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে এবং অ্যাংলো সমাজের অধিকারের দাবীতে ডিরোজিয়োর কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মেলান পোট। দুই বন্ধু ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়ান পিটিশন কমিটির সক্রিয় সদস্য।
বিলেত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে ধর্মতলা স্ট্রিটে নিজের মিনিয়েচার চিত্রকর্মের স্টুডিও খুলে বসেন পোট। এসময়ে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ডিরোজিয়ো হিন্দু কলেজের ইংরেজির শিক্ষক পদে যোগ দেন। হিন্দু কলেজ সূত্রে সমাজ সংস্কারক, শিক্ষা উদ্যোক্তা ডেভিড হেয়ারের সাথে দুই বন্ধুর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে। বাংলায় তখন নবজাগরণের যুগ। ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা তখন মুক্তবুদ্ধির চর্চায় সমাজের সকল প্রচলিত প্রথাকে বদলে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাদের পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠলেন হেয়ার। হেয়ার স্কটল্যান্ড থেকে কলকাতা এসেছিলেন ঘড়ির ব্যবসার উদ্দেশ্যে। কিন্তু শেষমেশ হয়ে উঠলেন মানব হিতৈষী এক সমাজ সংস্কারক।
এ সময়ে ছবি আঁকবার ধরনেও খানিকটা পরিবর্তন আনলেন পোট। তিনি প্রতিকৃতি আঁকায় ঝুঁকলেন। তাঁর ইজেলের সামনে স্থির হয়ে বসলেন ডেভিড হেয়ার, সাথে হেয়ারের দুই ছাত্র – রসিক কৃষ্ণ মল্লিক এবং তারকনাথ ঘোষ। জন্ম নিল হেয়ারের সেই বিখ্যাত প্রতিকৃতি যা আজও সংরক্ষিত আছে কলকাতার হেয়ার স্কুলে। প্রতিকৃতি আঁকায় তখন ব্যস্ত সময় কাটছে পোটের। একের পর এক এঁকে চলেছেন লর্ড ম্যাটকাফে, জে ডব্লিউ রিকেটস প্রমুখ বিখ্যাত লোকের প্রতিকৃতি। লন্ডনে থাকতে এনগ্রেভিং এর কাজ শিখেছিলেন। প্রখ্যাত চিত্রকর জর্জ চিনারির ঢাকা অবস্থানকালে আঁকা মিলিটারি অফিসার জর্জ ক্রুটেন্ডেনের একটি ছবির চমৎকার এনগ্রেভিং করলেন তিনি। দিন একরকম চলে যাচ্ছিল, কিন্তু বন্ধু ডিরোজিয়োর আকস্মিক মৃত্যুতে সবকিছু যেন উলটপালট হয়ে গেল। ১৮৩১ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে পরলোকে পারি জমালেন ডিরোজিয়ো। প্রচলিত ধর্ম বিষয়ে ভিন্নমত পোষণের কারণে পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করতে বাঁধা দেয়া হলো। তাঁর সমাধি হলো গোরস্থানের ঠিক বাইরে। দীর্ঘদিনের বন্ধু ডিরোজিয়োকে হারিয়ে বিষণ্ণ পোট ছুটে গেলেন ডেভিড হেয়ারের কাছে, হেয়ারের সঙ্গ তাঁকে খানিকটা হলেও শান্ত করল। কিন্তু সে শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হলো না। ১৮৪২ সালের জুন মাসে ডিরোজিওর মতন ডেভিড হেয়ারও কলেরায় আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন। খ্রিস্টান মিশনারিরা যেহেতু মনে করত হেয়ার ঈশ্বর-বিশ্বাসী নন, সেজন্যে তাদের কোনো কবরস্থানে হেয়ারের মরদেহ সমাহিত করতে দিল না। হেয়ারের সমাধি হলো তাঁরই দান করা জায়গা, হেয়ার স্কুল-প্রেসিডেন্সি কলেজের চত্বরে।
মনোজগতের বিষণ্ণতার পাশাপাশি পেশা জীবনেও নানা অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরল পোটকে। বিলেত থেকে অনেক পেশাদার ইংরেজ চিত্রকর তখন জীবিকার সন্ধানে কলকাতাসহ গোটা ভারতবর্ষের প্রধান শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছেন। ভারতে অবস্থানরত ইউরোপীয়দের পাশাপাশি স্থানীয় জমিদার ও ধনী ব্যক্তিদের কাছে ইংরেজ শিল্পীর আঁকা প্রতিকৃতির তখন দারুণ চাহিদা। দেয়াল ভরা, ইউরোপীয় কায়দায় আঁকা বড় বড় চিত্রকর্ম তখন বিত্তবৈভব এবং উচ্চরুচি প্রকাশের একটি সহজ উপায়। তাই ছবির বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়লেন পোট। অর্থের প্রয়োজনে এ সময়ে তিনি হাওড়া কাস্টম হাউজে কাজ নিলেন; সুপারিনটেন্ডেন্ট পদে। তবে এ কাজের বিষয়ে এর বেশি কিছু জানা যায় না। পোটের এই বিপদের সময় তাঁর সাথে পরিচয় হলো ঢাকার আর্মেনি জমিদার নিকোলাস পোগজের।
তখন ১৮৪৯ সাল। পোট, পোগজের অনুরোধে তিনটি ছবি আঁকবার কাজ শেষ করলেন- একটি নিকোলাস পোগজের প্রতিকৃতি, অপর দু’টি ‘ক্রুসিফিকেশান’ এবং ‘দ্য লাস্ট সাপার’। আর্মেনি গবেষক ভস্টিকান গালস্ট্যানের মতে তিনটি ছবিই প্রথমে রাখা ছিল পোগজের আর্মানিটোলার বাড়িতে, যেখানে ঠিক আগের বছর চালু হয়েছিল ‘পোগজ অ্যাংলো ভার্নাকুলার স্কুল’। তবে শেষোক্ত ছবি দু’টি পরবর্তীকালে আর্মেনি গীর্জায় হস্তান্তর করা হয়।
পোগজের সাথে পোটের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল। পোগজের মাঝে তিনি যেন ডেভিড হেয়ারের ছায়া দেখতে পেলেন। এ দেশের গরীব, সুবিধাবঞ্চিত ছেলেদের আধুনিক জ্ঞানে শিক্ষিত করবার উদ্যোগে হেয়ারের সাথে তাঁর অনেক মিল। ফিস পরিশোধ করতে না পারায় ঢাকা কলেজ থেকে বের করে দেয়া কিছু ছাত্রকে নিয়ে সিভিল সার্জন ওয়াইজের চালু করা ইউনিয়ন স্কুল টাকার অভাবে যখন বন্ধ হবার উপক্রম তখন সে স্কুলের ভার নেন নিকোলাস পোগজ। শুরুতে পোগজ অ্যাংলো ভার্নাকুলার স্কুল নাম হলেও লোকে একে নিকি সাহেবের স্কুল নামেই চিনত। নিকোলাস পোগজ শুধু প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন পোগজ স্কুলের প্রথম প্রধানশিক্ষক। স্কুল পরিচালনার সকল ব্যয়, ছাত্রবৃত্তি, কোম্পানি সরকারের অনুদান এসবকিছুর ব্যবস্থা করেন পোগজ। পূর্ব বাংলায় এমন শিক্ষানুরাগী মানুষ তখন বিরল।
কলকাতার প্রভাবশালী পত্রিকা দৈনিক ‘সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়’ ১৮৫২ সালের এক প্রতিবেদনে পোগজ বিষয়ে লিখল- “ ইনি কলিকাতা নিবাসী স্বর্গবাসী ডেবিড হিয়ার সাহেবের অনুপস্থানে অত্র স্থানে তাঁহার স্থানীয় স্বরূপ হইয়া উক্ত মহাত্মার ত্যাক্তাসনে উপবেশন করিয়াছেন। এই সাহেবকে বিদ্যোৎসাহি পর্যায় ডেবিড সাহেবাপেক্ষায়ও অগ্রগণ্য বলিতে হয়, কেননা ইনি স্বীয় অপ্রাপ্তবয়স্ক সময় পৈত্রিক বিত্ত হইতে আত্মভরণ পোষণার্থে যে কিঞ্চিৎ অর্থপ্রাপ্ত হইতেন তাহা হইতে কর্ত্তন করিয়া কিছু কিছু বিতরণ দ্বারা এ পর্যন্ত এই পাঠশালায় ব্যয় নির্ব্বাহ করিয়া আসিয়াছেন।“
পোগজের পর তাঁর জমিদারির ম্যানেজার কালীকিশোর চট্টোপাধ্যায় স্কুলটির প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন। ১৮৫৬ সালে পোগজের অনুরোধে স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করলেন চার্লস পোট। কলকাতার পাঠ চুকিয়ে অকৃতদার পোট এসে পৌঁছুলেন ঢাকায়। বেঙ্গল এলমানাক ১৮৫৬ এ ঢাকাবাসী বিশিষ্ট রেসিডেন্টদের যে তালিকা পাওয়া যায় সেখানে চার্লস পোটকে পেইন্টার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ তালিকায় আরো যেসব নাম দেখতে পাওয়া যায় তার মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাম ঢাকাস্থ আর্মেনিয় জনগোষ্ঠীর। মূলত এদের সাথেই পোটের সখ্যতা গড়ে উঠল। এ সময়ে ঢাকার কমিশনার ছিলেন সি টি ডেভিডসন। বেশকিছু ইংরেজ তখন ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করতেন যাদের মধ্যে ছিলেন অধ্যক্ষ উইলিয়াম ব্রেনান্ড, উইলিয়াম স্কট, এফ টিড, উইলিয়াম গান, এস রবিনসন প্রমুখ। ১৮৫০ পরবর্তী সময়কালে ঢাকার নগরজীবন দ্রুত পাল্টাতে থাকে। ঢাকা কলেজ, কলেজিয়েট স্কুল এবং পোগজ স্কুলের কারণে এ শহরে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বিকাশ ঘটে। পোটের ঢাকায় অবস্থানকালে প্রকাশিত হয় এ শহরের প্রথম সংবাদপত্র ‘ঢাকা নিউজ’। একই বছর ঢাকার রাস্তায় প্রথম ঘোড়ার গাড়ি নামে। ১৮৫৭ সালের নভেম্বরে নগরবাসী সাক্ষী হয় সিপাহী বিপ্লবের। কিন্তু এতসব ঘটনা পোটকে কতটা আন্দোলিত করেছিল তার কিছুই জানা যায় না।
পোটের ঢাকা জীবন নিয়ে তথ্য নিতান্ত অপ্রতুল। সর্বশেষ যা জানা যায় তা হলো পোটের অসুস্থতা এবং মৃত্যু বিষয়ে আংশিক তথ্য। ১৮৫৯ সালের নভেম্বরে পোট অসুস্থ হয়ে পড়লে পোগজ স্কুলের সহকর্মীরা তাঁকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করেন। অসুখের বিস্তারিত জানা না গেলেও, বছরের ঐ সময়ে কলেরার প্রকোপ থেকে ধারণা করা যায় তিনিও খুব সম্ভব বন্ধু ডিরোজিয়ো এবং হেয়ারের মতন কলেরায় আক্রান্ত হন। এসময়ে সার্জন আলেকজান্ডার সিম্পসন তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। ক’দিন রোগভোগ শেষে পরিবার পরিজনহীন পোট পারি জমান না ফেরার দেশে।
ফিরে আসা যাক পোটের ছবির মেরামত প্রসঙ্গে। প্রতিটি ছবির পেছনে দুই স্তরের ক্যানভাস সেঁটে দিয়ে দক্ষ হাতে চলল মেরামতের কাজ। প্রায় মাস খানেক চেষ্টার পর চার্লস পোটের চিত্রকর্ম দু’টির ক্ষত ঠিক সারিয়ে তুললেন গেভর্গ এনজা এবং ফাদার সেভাক। পোটের তুলি ছোঁয়ানোর ১৬৯ বছর পর আদি রূপ ফিরে পেল ‘ক্রুসিফিকেশান’ এবং ‘দ্য লাস্ট সাপার’। এখানে উল্লেখ করা যায় যে ডিরোজিয়ো এবং ডেভিড হেয়ারের মরদেহ খ্রিস্টীয় গোরস্থানে স্থান না পেলেও অনুসারীরা তাঁদের সমাধি চিহ্নিত করতে ভোলেননি। কিন্তু চার্লস পোটের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। আর্মেনি গীর্জা প্রাঙ্গনে তাঁর সমাধি হয়নি। তবে এর বাইরে ঠিক কোথায় তিনি সমাধিস্থ হন তাও কোথাও লেখা হয়নি। শুধু জানা যায়, তাঁর শেষকৃত্য ছিল আড়ম্বরহীন এবং খ্রিস্টীয় আচারমুক্ত। ঢাকার কোনো এক নামফলকহীন সমাধিতে চিরতরে হারিয়ে যান অ্যাংলো ইন্ডিয়ান চিত্রকর চার্লস পোট।
সহায়ক সূত্র-
১. Poor Relations: The Making of a Eurasian Community in British India, 1773-1833 by Christopher J. Hawes, Routledge, 1996.
২. Bengal Past & Present, Journal of the Calcutta Historical Society, vol 5,1910.
প্রথম প্রকাশঃ The Business Standard