মধ্যযুগের ইউরোপে যখন সামন্ত প্রথা কেবলমাত্র বিকশিত হতে শুরু করেছে তখন এ সংস্কৃতির ভেতর দিয়েই গড়ে উঠে  শিভ্যালরী নামের এক অভিজাত প্রথা। এ প্রথার আওতায় সামন্ত প্রভুদের শিষ্টাচার, আচার-আচরণ ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এক ধরণের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উদ্বোধন হয়। শিভ্যালরী মূলত ছিল মধ্যযুগের সামন্ততন্ত্রের সমর্থনে এক ধরণের সামরিক প্রতিষ্ঠান। প্রকৃত অর্থে সামন্ত প্রভুদের নিরাপত্তা বিধানের কাজই ছিল এ প্রথার মূল উদ্দেশ্য। আর এই প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের বলা হত নাইট (Knight)। মধ্যযুগের ইউরোপে এ বাহিনীর বীরত্ব আর শ্রেষ্ঠত্ব কিংবদন্তির মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
নাইট যোদ্ধাদের একটি ছবি
কারা এই নাইট?

শিভ্যালরী প্রথার প্রত্যেক সামরিক সদস্যদের নাইট বলা হলেও অনেকসময় অশ্বারোহী জমিদাররাও নাইট নামে পরিচিত হতেন। সামন্ত প্রভুরা নিজেদের নিরাপত্তার পাশাপাশি ব্যক্তিগত ক্ষমতার বড়াই প্রদর্শন করার জন্য নিজেদের আশেপাশে অনুচর নিয়ে ঘুরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। সশস্ত্র এসব অনুচররাই একসময় হয়ে উঠেন একেকজন নাইট যোদ্ধা। নাইটরা হত উচ্চ বংশীয়। তাই রক্ষী হিসেবে নাইট নিয়োগ করে এক ধরণের বিশেষ গৌরব ও আভিজাত্য অনুভব করতেন সামন্ত প্রভুরা। সামন্ত প্রভুর পুত্ররাই সাধারণত নাইট হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতেন। তবে যোগ্যতা অনুসারে অনেকসময় অন্য শ্রেণী হতে এমনকি ভূমিদাসের সন্তানও নাইট হতে পারত৷ এখানে একটি ব্যাপার উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মধ্যযুগের ইউরোপে এমন একটি অস্বাভাবিক প্রথার প্রচলন ছিল যেখানে শুধুমাত্র জমিদার কিংবা রাজার বড় ছেলেই পিতার সমস্ত সম্পত্তির মালিক হতে পারত। ফলে অন্য ছেলে সম্পত্তির অধিকার না পেয়ে গির্জার পুরোহিত কিংবা নাইট পদে নিযুক্ত হত। নাইটরা পুরো শরীর বর্ম দিয়ে ঢেকে তলোয়ার, বল্লম ইত্যাদি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বেড়াতেন এবং সামন্ত প্রভুর নিরাপত্তা বিধান করতেন। সময়ের পটপরিক্রমায় নাইটরা জনপ্রিয় হয়ে যায় এবং এ পেশা একটি আকর্ষণীয় ও লোভনীয় পদে পরিণত হয়৷ শিভ্যালরী প্রথার বিকাশের সাথে নাইটরাও পরিণত হয় এক বিশেষ যোদ্ধাশ্রেণীতে। শুধুমাত্র  উচ্চবংশের সন্তানরা নাইট পদের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হত। এজন্য নাইট যোদ্ধায় পরিণত হওয়ার আগ থেকেই এসব তরুণরা নিজেদের গুণাবলি বিকাশের জন্য তৎপর থাকত। অশ্বারোহণ, যুদ্ধবিদ্যা ও শিকারে ব্যাপকভাবে পারদর্শী এসব নাইট যোদ্ধাগণ সামন্তপ্রভুর নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি গির্জা ও পাদ্রীদেরকে রক্ষা করা, দুর্বল অসহায় ও বিপদে পতিতদের সাহায্য করার শপথ নিত। লর্ড বা সামন্ত প্রভুর প্রয়োজনে এবং তার নির্দেশে নাইটরা যুদ্ধে লিপ্ত হত৷ চার্চের নিরাপত্তা রক্ষার্থেও নাইটদের যুদ্ধ করার অনুমতি ছিল। এছাড়া মহিলাদের সুরক্ষা দেয়াও নাইটদের অন্যতম কর্তব্য ছিল।

নাইটদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা

নাইটদের প্রশিক্ষণ পর্ব তিনটি ধাপে সম্পাদন করা হত। প্রথম পর্যায়ের প্রশিক্ষণ শুরু হত সাত বছর বয়সে৷ এ সময়ে প্রশিক্ষণার্থীদের বলা হত পেজ page বা ভ্যালেট valet. বড় জমিদার এবং তার অধীনস্থ নাইটগণ পেজ বা ভ্যালেটদের যুদ্ধবিদ্যা ও পুরুষ সুলভ বলিষ্ঠ আচরণ শিক্ষা দিত৷ অন্যদিকে জমিদার পত্নী এবং প্রাসাদের অভিজাত মহিলাগণ মহিলাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, সামন্তপ্রভুদের প্রতি অনুগত ও বিশ্বাস এবং মানবিক গুণাবলি হওয়ার শিক্ষা। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রশিক্ষণ শুরু হত চৌদ্দ বছর বয়সে। এ পর্যায়ে প্রশিক্ষণার্থীদের নাম দেয়া হত স্কয়ার বা এস্কোয়ার। এ পর্যায়ে স্কয়াররা তাদের প্রশিক্ষক নাইটদের সাথে যুদ্ধ ক্ষেত্রে গমন করতেন এবং যুদ্ধবিদ্যা বিষয়ক প্রশিক্ষণের অনুশীলন করতেন। এ পর্যায়ে একজন প্রশিক্ষণার্থীর জন্য একজন নাইট দায়িত্ব পালন করতেন। প্রশিক্ষক নাইটের তত্ত্বাবধানে তারা ঘোড়ায় চড়ে ঢাল তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করার কৌশল আয়ত্ত করত এবং যুদ্ধে অংশ নিয়ে নিজেদের যোগ্যতা যাচাই করত। নাইট প্রশিক্ষণের চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রশিক্ষণার্থী একজন পরিপূর্ণ নাইটে রূপান্তরিত হত। এসময় প্রশিক্ষণার্থী নাইটের বয়স হত একুশ বছর। এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সামন্তপ্রভুরা একজন শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ নাইট হিসেবে ঘোষণা করতেন। এ অনুষ্ঠানে নাইটদের ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে একটি দীর্ঘ বক্তৃতা শুনানো হত৷ অতপর নাইটরা হাটু ভাঁজ করে তাদের সামন্তপ্রভুর সামনে নতজানু হয়ে প্রতিজ্ঞা করতেন যে, সারা জীবন তারা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন। আনুগত্য প্রদর্শনের এ অভিষেক অনুষ্ঠানের পর আনুষ্ঠানিকভাবে নাইটদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হত।

নাইট দের ঘোড়া

নাইটদের টুর্নামেন্ট

সামন্তপ্রভুদের আয়োজনে নাইটদের মধ্যে এক ধরণের প্রতীকী যুদ্ধের আয়োজন ছিল মধ্যযুগের ইউরোপের অন্যতম আকর্ষণ। দেশ বিদেশ থেকে বিভিন্ন অঞ্চলের যোদ্ধারা এ টুর্নামেন্টে অংশ নিত। ভূস্বামী সামন্তপ্রভু সহ জনসাধারণের বিনোদনের একটি বড় অনুষ্ঠান ছিল এ আয়োজন। যোদ্ধা নাইটগণ এককভাবে বা কোনসময় দলীয়ভাবে ভোঁতা তলোয়ার ও বল্লম নিয়ে একে অপরের সাথে প্রতীকী যুদ্ধে অংশ নিতেন। বিজয়ী নাইটরা অভিজাত মহল থেকে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হতেন এবং পুরস্কার হিসেবে ফুলের তোড়া, শিকারি কুকুর ইত্যাদি লাভ করতেন।

নাইটদের গৌরবময় অধ্যায়ের সমাপ্তি

শিভ্যালরী প্রথার আবেদন যখন কমতে থাকে তখন সামন্ত সংস্কৃতিও বদলে যেতে শুরু করে। আর এর সাথে পাল্লা দিয়ে নাইটদের চারিত্রিক অবনতি তরান্বিত হয়। মহিলাদের সম্ভ্রম রক্ষার নামে শেষদিকে এসে নাইট যোদ্ধাগণ তাদের অসম্মান করতে শুরু করেন৷ বিশেষ করে অভিজাত পরিবারের বাইরের মহিলারা নিগৃহীত হতেন বেশি। নাইটদের অনেকেই নিরীহ পথচারীদের আক্রমণ করতেন। সুযোগ পেলেই মারামারি এমনকি লুটতরাজে মেতে উঠত নাইট যোদ্ধাগণ। শিভ্যালরী প্রথার আদর্শ রক্ষার নামে প্রায়ই নাইটরা পরস্পরের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত হতেন৷ দেখা যেত এসব দ্বন্দ্বযুক্ত পরবর্তীতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপান্তরিত হত। অস্ত্রসস্ত্র সজ্জিত নাইটরা নিজেদের বীরত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে যেখানে সেখানে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়তেন। ফলাফল হিসেবে রক্তপাত খুবই স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এমন অবস্থার অবসানের জন্য শেষ পর্যন্ত পোপকে হস্তক্ষেপ কর‍তে হয়। আর এরই সাথে ম্লান হয়ে পড়ে মধ্যযুগের ইউরোপের ত্রাস সৃষ্টি করা নাইটদের গৌরবময় অধ্যায়।

তথ্যসূত্র

সভ্যতার ইতিহাস : প্রাচীন ও মধ্যযুগ

আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন ,  মোঃ আব্দুল কুদ্দুস সিকদার

knight: cavalryman

Knight – Wikipedia

শিউলি ফুলের বিষণ্ণতার গল্প

শরতের রাতের সৌন্দর্য বলতে যে ফুলকে বোঝানো হয়, তা হলো শিউলি ফুল। তবে এ সৌন্দর্য আনন্দের নয়, বেদনার প্রতীক। শিউলি ফুলের নাকি সব সময়ই মন খারাপ থাকে। সূর্যের ওপর তার এক রাশ অভিমান। তাই তো রাতের আঁধারেই নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পছন্দ করে সে এবং সূর্য ওঠার আগেই লুকিয়ে ঝরে পড়ে।...

মিশরীয় সিন্ডারেলা

মিশরে তখন ১৬ তম রাজবংশের যুগ। পার্সিয়ান আক্রমনের সম্ভাবনায় দিন গুণছে মিশর। সে সময় মিশরীয় সৈন্যদের তুলনায় গ্রীক সৈন্যদের কদর ছিলো অনেক বেশি। কারণ গ্রীক সৈন্যদের দক্ষতার গল্প প্রচলিত ছিলো বিশ্ব জুড়ে। এমন সময় ফারাও এপ্রিয়েজকে হত্যা করে মিশরের নতুন ফারাও হলেন রাজবংশের...

প্রাচীন সভ্যতায় ঈশ্বরের ধারণার উৎপত্তি ও সংখ্যাগত অবনমন

যে কোন সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলেই আমরা বহু ঈশ্বর বা গডের অস্তিত্বের কথা জানতে পারি। তবে আজকের প্রেক্ষাপটে ঈশ্বর সম্পর্কে এ ধারণা অনেকটাই পাল্টেছে। কেননা বর্তমান বিশ্বে বহু ধর্মমত এখনও বিদ্যমান থাকলেও ঈশ্বরের সংখ্যার বিষয়টি কমে এসেছে। একেশ্বরবাদ কিংবা বহুঈশ্বরবাদী...

হিন্দু দেব-দেবীর ধারণা প্রাচীন মধ্য এশীয় বিশ্বাসেরই প্রতিরূপ নয় তো?

সিংহবাহনের ওপর এক হাতে চাঁদ ও এক হাতে সূর্য নিয়ে চার হাতবিশিষ্ট এক দেবী যুদ্ধবাজ ভঙ্গিমায় আসীন নিজের সন্তানদের প্রতিরক্ষার জন্য। খুব পরিচিত লাগছে তাই না? নিশ্চয়ই দেবী দুর্গার সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু এ তো দুর্গা নয়, ব্যাক্ট্রিয়ান মাতৃদেবী ‘নানায়াহ’ বা ‘ননা’...

মহাবীর কর্ণের অন্তিম যাত্রা

সূর্যদেব অস্তে চলে যাচ্ছেন। গোধূলিবেলার লালচে আলোতে আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমার এই জন্মের শত্রুকে। তার গান্ডিব ধরা উদ্ধত হাতে চকচক করছে অঞ্জলিক বাণ, যা আমার মস্তক ছেদ করার জন্য একটু পরেই ছুটে আসবে।পান্ডব বীর অর্জুন, যে আমার চরম শত্রু আবার আমার সহদর কনিষ্ঠ ভ্রাতা।ওই...

মেহেদী হাসান খান

মেহেদী হাসান খান ১৮ বছর বয়সের মেহেদী হাসান খান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হলেন,কিন্তু পড়াশোনায় তার মন নাই! কিন্তু কেন? তিনি নাওয়া- খাওয়া, পড়াশোনা বাদ দিয়ে একটা ছোট্ট কম্পিউটার সম্বল করে বাংলা ভাষায় লেখার জন্য লড়াই শুরু করলেন। একটাই জেদ, বাংলা...

ঢাকার হারিয়ে যাওয়া সংগ্রহশালা- বলধা জাদুঘর

১৯২৫ সালের ঢাকা; ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে রেললাইন ধরে নারায়ণগঞ্জের দিকে কিছুদূর এগুলে উয়ারি। উয়ারির শেষ সীমানায় এক সরু রাস্তা চলে দিয়েছে নারিন্দার দিকে। সরু সেই রাস্তার একপাশে বহু পুরাতন খ্রিস্টান কবরখানা আর তার বিপরীতে উঁচু পাচিলঘেরা কম্পাউন্ডের ভেতর দোতলা...

সুন্দরবন ধ্বংসের ইতিবৃত্ত

ব্রাজিলের চিরসবুজ বিস্তৃত এমাজন (Amazon Rainforest) গহীন বনাঞ্চলকে বলা হয় বিশ্বের ফুসফুস, তেমনি সুন্দরবনও বাংলাদেশের শ্বাস-প্রশ্বাসের এক অঙ্গ। এই ঘন বনাঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও এক প্রতিরোধ। সুন্দরবনকে ঘিরে আশেপাশের জনপদে ছড়িয়ে আছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী। এমনি...

ঢাকার এক বিস্মৃত চিকিৎসক

দিনটি ছিল ১৫ই নভেম্বর ১৮৬৪ সাল, মঙ্গলবার। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই। নারিন্দার খ্রিস্টান কবরস্থানের দীর্ঘ ঘাসের ঝোপে অবশ্য তখনই অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা হলে এই এলাকায় সহজে কেউ পা বাড়ায় না। কিন্তু সেদিন পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য- আছে ইংরেজ, আরমেনিয়, দেশী সব...

ঢাকার ঐতিহাসিক তারা মসজিদ

পূর্বকথাঃ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আরমানিটোলার মহল্লা আলে আবু সাঈদে তখন এক প্রভাবশালী জমিদারের বাস, নাম- মীর্জা গোলাম পীর। দাদা মীর আবু সাঈদ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা যুগে তুরস্ক থেকে এসে ঢাকায় থিতু হয়েছিলেন। মীর্জা গোলাম পীরের আরেক নাম মীর্জা আহমেদ জান। তবে...