১৯৭৯ সালে লন্ডনের সাউথ কেনসিগটন শহরে ক্রিস্টিয়ে নিলাম সংস্থায়, ইসলামিক ও ভারতীয় চিত্রিত পাণ্ডুলিপির এক নিলাম অনুষ্ঠান থেকে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের জনৈক চিত্র সংগ্রাহক একটি পাখির ছবি (১৩ x ২১.৫ সে.মি.) সংগ্রহ করেন এবং ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছবিটি তাঁর কাছেই ছিল। ওই ছবিটির কথা প্রথম যে দুজন মানুষ উল্লেখ করেছিলেন তাঁরা হলেন ইসলামিক ও ভারতীয় শিল্প বিশেষজ্ঞ অলিভার ফোর্জ এবং ব্রেন্ডন লিঞ্চ। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে নিউ ইয়র্ক শহরে পার্সিয়ান ও ভারতীয় চিত্রকলার এক প্রদর্শনী সভায় প্রথম ওই ছবিটি জনসমক্ষে প্রদর্শিত হয়।
১৬৬০ সাল থেকে ১৬৮০ সালের মধ্যে গোলকুন্ডা রাজ্যে থাকাকালীন শিল্পী রহিম খান দক্ষিণী (মুসাব্বির) ওই ছবিটি এঁকেছিলেন। রঙিন ওই ছবিটি কোনো শৈল্পিক কল্পনার পাখি ছিল-না, সেটি ছিল একটি হিমালয়ান মোনাল, যা ইম্পেয়ান মোনাল (lophophorus impejanus) নামে পরিচিত। ১৭৯০ সালে তৎকালীন ঔপনিবেশিক ভারতের প্রথম, প্রধান বিচারপতি এলিজাহ ইম্পের (১৭৭৭-৮২) স্ত্রী, লেডি মেরি ইম্পের স্মরণে ইংরেজ পক্ষীবিদ জন ল্যাথাম ওই নামকরণ করেছিলেন। ১৭৭৫ সালের ৫ই আগস্ট ওই এলিজাহ ইম্পের আদেশেই কলকাতায় মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসি দেওয়া হয়, ব্রিটিশ আমলে মহারাজ নন্দকুমারই ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি ফাঁসির সাজা পেয়েছিলেন।
নবাব আলীবর্দী খানের শেষসময় অর্থাৎ ১৭৫০ সাল থেকে ১৭৬০ সালের প্রথমসময় পর্যন্ত বাংলার নবাবরা চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। বলা যায় রাজধানী মুর্শিদাবাদ ও পাটনা (নাম ছিল, আজিমাবাদ) শহরকে কেন্দ্র করে দিল্লি কলমের প্রভাবে আঞ্চলিকভাবে মুর্শিদাবাদ কলমের পথ চলা শুরু হয়েছিল। যদিও, ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে নবাব মীর কাসিমের পতন, ওই কলমের পথ চলা রুদ্ধ হয় এবং পাটনা থেকে বহু শিল্পী কাজের সন্ধানে কলকাতায় চলে আসেন।
লেডি মেরি ইম্পে ও তাঁর স্বামী স্যার এলিজাহ ইম্পে চিত্রকলার সমঝদার ছিলেন। মুর্শিদাবাদ কলমে শিল্পী পূৰ্ণনাথ বা দ্বিতীয় হুনহারের আঁকা রাগ-রাগিণীর ছবি ও রামায়ণের চিত্রিত অনুলিপি ছাড়াও স্যার এলিজাহ ইম্পে ও তাঁর পত্নী লেডি মেরি ইম্পের সংগ্রহে মহাভারতের ফারসি অনুবাদ রজমনামা’র চিত্রিত প্রতিলিপিও (১৭৬১ সালে উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদে তৈরী হয়েছিল) স্থান পেয়েছিল। আবার ভারতীয় উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের বৈচিত্রে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিচারপতি স্যার এলিজাহ ইম্পে ও তাঁর পত্নী লেডি মেরি ইম্পে এবং ভারতের প্রাকৃতিক ইতিহাসের একটি সচিত্র অ্যালবাম তৈরীতে উৎসাহী হন।
লেডি মেরি ইম্পে সত্যি অর্থেই ছিলেন পক্ষী প্রেমিক, কলকাতা শহরে তাঁর ত্রিতল বাংলোতে (সম্ভবত পাঁচ নম্বর মিডলটন রো, বর্তমানে ওই রাস্তার নাম হয়েছে উইলিয়াম জোন্স সরণি, কলকাতা ) তিনি একটি ছোটোখাটো পক্ষীরালয় গড়ে তুলেছিলেন। লেডি মেরি ইম্পে’র ওই অ্যালবামে নিখুঁত মাপ সহ পূর্ণ আকারে পাখির ছবি যেমন আঁকা হয়েছিল তেমনই যে গাছে পাখিটি বসে আছে সেই গাছ ও পাখির বৈজ্ঞানিক নামও লেখা হয়েছিল এবং ফারসি ও ইংরেজি ভাষায় শিল্পীর নাম ও সমীক্ষার দিন-তারিখও উল্লেখ করা হয়।
প্রাক্তন মুর্শিদাবাদ ও পাটনা কলমের শিল্পী শেখ জৈনউদ্দিন ছাড়াও আরও দুজন শিল্পী, ভবানী দাস এবং রাম দাস তাঁর চিত্রশালায় যুক্ত ছিলেন এবং তাঁদের আঁকা তিনশো ছাব্বিশটি ছবি ওই অ্যালবামে স্থান পেয়েছিল। তিনশো ছাব্বিশটি ছবি’র মধ্যে একশো সাতানব্বইটি পাখি, ছিয়াত্তরটি মাছ, আটাশটি সরীসৃপ, সতেরোটি বিভিন্ন জীব-জানোয়ার এবং আটটি উদ্ভিদ নিয়ে ওই অ্যালবামে বিশদে চর্চা করা হয়।
১৭৮৩ সালে লেডি মেরি ইম্পে ভারত ছেড়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ভারতের প্রাকৃতিক ইতিহাসের ওই সচিত্র অ্যালবামে তাঁর বৈজ্ঞানিক উপলব্ধি ও শৈল্পিক গুণাবলী ইংল্যান্ড সহ বিশ্বের পক্ষি বিজ্ঞানীদের মুগ্ধ করে। সম্রাট জাহাঙ্গীর একজন আগ্রহী ও অপেশাদার প্রকৃতিবিদ ছিলেন এবং তাঁর আমলে আঁকা (শিল্পী মনসুরের) পাখি, প্রাণী ও ফুলের ছবি মুঘল কলমকে করে তুলেছিল সমৃদ্ধ। কিন্তু মুর্শিদাবাদ কলমের শিল্পীরা, লেডি মেরি ইম্পে’র প্রাকৃতিক জীবনাবলীর ওই সচিত্র অ্যালবামের মাধ্যমে বিশ্বকে দিয়েছিল এক নতুন অভিধান।