১৯২৮ সালে বর্ধমান হাউসে (বর্তমান বাংলা একাডেমি) তোলা আলোকচিত্রে ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজের লেখক ও কর্মীদের মাঝে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

পূর্বকথাঃ ১৯২৬ সাল, কবি নজরুল তখন কৃষ্ণনগরবাসী। ঢাকাস্থ জনাব আনোয়ার হোসেনকে এক চিঠিতে লিখছেন-

অবসর বা বিশ্রাম পাচ্ছিনে জীবনে কিছুতেই। এই শরীর নিয়েই আবার বেরুব ৬ই মার্চ দিনাজপুরে। সেখানে ডিস্ট্রিক্ট কনফারেন্স, সেখান থেকে মাদারিপুর Fishermen’s Conference attend করতে যাব। ওখান থেকে খুব সম্ভব ঢাকা যাব। যদি যাই দেখা হবে।”

“ বন্ধু হেমন্তকুমার সরকারকে সঙ্গে নিয়ে নজরুল জুন মাসের শেষে ঢাকা এলেন, উঠলেন ঢাকা কাছারির কাছে মোহিনীবাবুর বাড়িতে। ২৭শে জুন, ১৯২৬ এ সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ এর চতুর্থ বৈঠকে ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার”, “আমরা ছাত্রদল” প্রভৃতি গান গেয়ে ঢাকাবাসীকে মাতিয়ে তুললেন।

                                                                সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ১৯২৬

এই ছিল তাঁর প্রথম ঢাকা সফর। এরপর আরো বারোবার তিনি ঢাকায় এসেছেন। কখনো কোনো বৈঠকে কিংবা গানের আসরে আমন্ত্রিত হয়ে, আবার কখনো এসেছেন স্বেচ্ছায় কিংবা ঝোকের বশে। পূর্ববংগ কেন্দ্রীয় আইন সভার সদস্যপদে নির্বাচনও করেছিলেন এই ঢাকা থেকেই; সে বার উঠেছিলেন ৫২নং বেচারাম দেউড়ীর মসজিদ সংলগ্ন একতলা এক দালানে।

১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ এর ২য় বার্ষিক সম্মেলনের উদবোধন করেন কবি নজরুল। এবার এবং এরপর আরো কয়েকবার তিনি থেকেছেন বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনের আতিথেয়তায় বর্ধমান হাউসে। বর্ধমান হাউসের পুকুরে সাঁতার কাটা, পাশের বটগাছের ছায়ায় বসে সাহিত্যচর্চা করা এসবই তাঁর প্রিয় অনুষঙ্গতে পরিণত হয়। ঢাকায় থেকে যান প্রায় আড়াই মাস।

                                                                                                                        বর্ধমান হাউসে সেই বটগাছ বর্তমান ছবি

ঐ বছরেরই জুন মাসের শেষে নজরুল আবার এলেন ঢাকায়। এবার কোনো আমন্ত্রণরক্ষা নয়। নিতান্তই ঝোকে! খেলা দেখতে গিয়েছিলেন গড়ের মাঠে। ইস্ট বেঙ্গল-মোহনবাগান এর খেলা। খেলা শেষে তুমুল তর্ক। অন্যদিন খেলাশেষে ঢুঁ মারতেন ধর্মতলা পেরিয়ে কলকাতা নিউমার্কেটের পেছনের নিজাম রেস্তোরায়, ওখানের কাঠি কাবাবটা সেসময় নজরুলের দারুন প্রিয়। কিন্তু আজ সবাই বেজায় উত্তেজিত। উল্টোপথে হেঁটে কখন যে শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে গেছেন খেয়ালই করেননি। দেখলেন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা মেল (১৯৪৪ সালে এর নাম বদলে হয় ইস্ট বেঙ্গল মেল)।

‘ঢাকা’ লেখাটা দেখেই মনটা কেমন করে উঠলো। বন্ধু নৃপেন্দ্রকৃষ্ণকে নিয়ে ট্রেনে চেপে বসলেন। সে বারের ঢাকা সফরে উয়ারি বনগ্রাম লেনের রানু সোম (পরবর্তীকালের প্রখ্যাত লেখিকা প্রতিভা বসু) আর ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্র মৈত্রর মেয়ে উমা মৈত্রকে গান শিখিয়েছিলেন নজরুল। অবশ্য এই গান শিখানোর ‘অপরাধে’ নজরুলের উপর সন্ত্রাসীদের হামলাও হয়েছিল ঠাটারি বাজার মোড়ে। নজরুল সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে লাঠি ছিনিয়ে নিয়ে উল্টা বেদম মার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বন্ধু মোতাহার হোসেন দীর্ঘদিন সেই লাঠি সযত্নে সংরক্ষণও করেছিলেন।

সহায়ক গ্রন্থঃ
১. নজরুল ইন্সটিটিউট পত্রিকা বিশেষ সংখ্যা, সম্পাদনাঃ মুহম্মদ নূরুল হুদা।
২. জীবনের জলছবি, প্রতিভা বসু, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৩
৩. নজরুল রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড), সম্পাদনাঃ আব্দুল কাদির, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৪।