সাহিত্যিকরা তাদের উপন্যাসে, সমাজে নারীদের অবস্থানকে কি ভাবে উপস্থাপন করেছেন?

যদিও বাংলা সাহিত্যে নারী চরিত্র বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমানে আছে তবুও মুসলিম নারী চরিত্রকেন্দ্রিক সাহিত্য খুব বেশি রচনা করা হয়নি। শাহ মুহম্মদ সগীর পনেরো শতাব্দীর শেষ দিকে প্রাচীনতম বাংলা কাব্য ‘ইউসুফ জুলেখা’ লিখেছিলেন। তাদের প্রেমকাহিনী প্রাচীন। বাস্তব নারী চরিত্র জুলেখাকে নিয়ে তখনকার বাংলা সাহিত্যে কাব্য রচনা শুরু হয়।

ক্ষুদ্রাকার মুঘল চিত্রকলাটিতে ইউসুফ – জুলেখার কাহিনী চিত্রিত হয়েছে।

‘ইউসুফ জুলেখা’ পুঁথিটি। পুঁথি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি শাহ গরীবুল্লাহর লেখা। ছোটখাট ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও রোমান্টিক কাহিনী হিসেবে এই পুঁথিটি শাহ গরীবুল্লাহর কবি প্রতিভার শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে কবি আলাওল ‘সয়ফুল মুলুক-বদিউজ্জামাল’ একটি অনুবাদ কাব্য। ফারসি সাহিত্য থেকে অনুবাদ করা। অন্যান্য কাব্যের সাথে তিনি এই কাব্যটি অনুবাদ করেন। এ কাব্যটিও রোমান্টিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত। একসময় এই কাব্যখানি খুব জনপ্রিয় ছিল। 

সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেন

মীর মোশাররফ হোসেনের কালজয়ী সৃষ্টি ‘বিষাদ সিন্ধু’। এই বইয়ের প্রধান নারী চরিত্র জয়নাব। জয়নাবের প্রতি ইয়াজিদের রূপের যে আকাঙ্খা ছিলো সেটাকেই তিনি কারবালা যুদ্ধের মূল কারন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সাহিত্য রস পরিবেশনার জন্যই জয়নাবের সৃষ্টি। তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস উদাসীন পথিকের মনের কথায় বর্ণনা করেছেন সাহসী নারী জমিদার প্যারীসুন্দরীর কথা। কর সাহেব কেনীর ভয়ে যখন নারী–পুরুষ নির্বিশেষে তটস্থ, তখন প্যারীসুন্দরী আবির্ভূত হলেন উদ্ধারকর্তা হিসেবে। ফসলের জমিতে নীলচাষের অত্যাচারে জর্জরিত প্রজার দুঃখে কাতর প্যারীসুন্দরীর সাহসী এবং বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপে নারীর শক্তিই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সময় কেনীর স্বীকারোক্তিই এর প্রমাণ করে- ‘প্যারীসুন্দরীর টাকা অনেক, জমিদারিও আমার অপেক্ষা অনেক বেশি, বুদ্ধিও বেশি, সাহসও বেশি। জমিদারের মেয়ে জমিদার তাহার কথাই স্বতন্ত্র।’

নারীর জীবন নিয়ে মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিবি কুলসুম’ একটি শ্রেষ্ঠ বই। এই বইয়ে তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কুলসুমের সঙ্গে মধুর দাম্পত্য জীবনের বর্ণনা আছে। তিনি আরো লিখেছেন ‘বিবি খোদেজার বিবাহ’ (কাব্য)। নারী চরিত্র নওয়াব ফয়জুন্নেসার আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘রূপ জালাল’। এ উপন্যাসে তার ব্যক্তিগত ব্যর্থ জীবনের দীর্ঘ নিঃশ্বাস পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়।

মুসলিম নারী চরিত্র নিয়ে কায়কোবাদ লিখেছেন ‘জোবেদা মহল’ কাব্য (কাহিনী কাব্য, ৪ খন্ড)। ঊনিশ শতকের শেষদিকে এলেন ইসমাইল হোসেন শিরাজী। নিপীড়িত মুসলমান জ্ঞানে, কর্মে, শিল্প-সংস্কৃতিতে সমুন্নত হোক এই ছিল শিরাজীর জীবনের ব্রত। এই মানসিকতা সামনে রেখে ১৯২৭ সালে তিনি লিখেছেন ‘ফিরোজা বেগম’ উপন্যাস। ‘তুর্কী নারী জীবন’ মুসলমান নারী চরিত্র নিয়ে তার লেখা একটি প্রবন্ধের বই।

কায়কোবাদ

কবি শাহাদত হোসেন লিখেছেন জেবুন্নেসা (কবিতা), নূরজাহান (কবিতা), জাহানারা (কবিতা), ‘দরদী আম্মা (কবিতা)’, বেগম নূরজাহানের জীবন কাহিনী, গুলবদনের জীবন কাহিনী, জাহানারার জীবন কাহিনী, জেবুন্নেসার জীবন কাহিনী, উপন্যাস চাঁদ সুলতানা, সামাজিক-পারিবারিক উপন্যাস ‘মালেকা রহিমা’ উপন্যাস মরুর কুসুম। সৈয়দ এমদাদ আলীর লেখা ‘তাপসী রাবেয়া’, ‘হযরত বিবি খাদিজা’, ‘হযরত বিবি ফাতেমা জোহরা’। ‘পরী বিবি’ নামে কবিতাও তিনি রচনা করেন। তিনি ‘তাপসী রাবেয়া’তে তার জন্ম-মৃত্যু ও বাইরের জীবনের ইতিহাস অল্প কিছু লিখে তিনি তার সাধনাকাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন।

নারী চরিত্র নিয়ে এস ওয়াজেদ আলীর লেখা প্রবন্ধ ‘মুসলিম নারী’। বেগম রোকেয়া, পরী বিবি। মুন্সী মুহম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ-হযরত ফাতেমা জোহরার জীবন চরিত, জুলেখা। মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী রচনা করেছেন-‘মোসলেম বীরাঙ্গণা’। নীলিমা ইব্রাহিম ১৯৭৬ সালে বেগম রোকেয়ার জীবনী লিখেছেন। মোজাম্মেল হকের লেখা ‘জোহরা’ উপন্যাসে মুসলমান সমাজের এক করুন চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন।

শেখ আবদুল জববার লিখেছেন আদর্শ রমণী, নূরজাহান বেগম, দেবী রাবেয়া। ১৯২৬ সালে খান বাহাদুর তসলিমুদ্দীন আহমদ লিখেছেন ‘সাহাবিয়া’। সাহাবিয়া বইয়ে তিনি হযরতের সহধর্মিনী, তার কন্যা এবং আত্মীয়দের জীবন কাহিনী লিখেছেন। বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদের লেখা ‘পুণ্যময়ী’। এই বইটি রাবেয়া, ফাতেমা, আয়েশাসহ মোট আটজন মুসলিম নারীর জীবন কাহিনী। ১৯৩৭ সালে শামসুন্নাহারের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘রোকেয়া জীবনী’ প্রকাশিত হলে জীবনীকার ও প্রাবন্ধিক হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তার পরবর্তী রচনা ‘বেগম মহল’ মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের আটজন প্রখ্যাত পাঠান ও মুগল রমণীর জীবনকাহিনী।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যে সামাজিক পরিবর্তনের ছোঁয়ায় কিভাবে নারী ও নারী জাতির প্রতি পুরুষের মানষিক পরিবর্তন হয়, তার প্রভাব পড়েছে। দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসের আয়েশা সেবা করতে গিয়ে ভালোবেসে ফেলে শত্রুপক্ষের বিধর্মী জগৎসিংহকে, এবং নিজের বাগদান ভেঙ্গে দেন।সেই সময়ে এটা ছিলো খুব কঠিন ব্যাপার। আবার বিষবৃক্ষ’র অনাথ ও বিধবা কুন্দনন্দিনী তখনকার হিন্দু সমাজের চাপানো নিয়ম না মেনে হয়েছিলেন বিদ্রোহী।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেকগুলো শক্তিশালী নারী চরিত্রের চিত্র এঁকেছেন তার উপন্যাসে। ছোটগল্প ‘দেনা পাওনা’য় নিরুপমা তখনকার সমাজের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি ‘পণপ্রথা’র বিরুদ্ধে যান। আবার ‘নষ্টনীড়’ গল্পে চারুলতা সুখী হওয়ার হওয়ার জন্য অসামাজিক সম্পর্কের বাঁধনে নিজেকে জড়িয়েছেন। আবার চোখের বালি উপন্যাসে বিনোদিনী চিরাচরিত অবলা নারীর চরিত্রকে রীতিমতো অস্বীকার করেছেন।আধুনিক নারী চরিত্রের জন্ম দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ চোখ বন্ধ করে শুধু পশ্চিমা ধরনের নারী চরিত্রেরই চিত্র আঁকেননি, সেইসব চরিত্রদেরকে অনন্যসাধারন ভাবে উপস্থাপন করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় শেষের কবিতার লাবণ্য বা গোরার সুচরিতা।

তথ্যসূত্র

প্রথম আলো

দৈনিক সংগ্রাম