গৌতম বুদ্ধের জন্ম, জীবন, বাণী ও ধর্ম মত নিয়ে যত আলোচনা হয়, এই মহাত্মার মৃত্যু নিয়ে আলোচনা তেমন হয় না। আজ দেখবো মৃত্যুর দিনটি কেমন কেটেছিল তথাগতের। যখন বুদ্ধের আশি বছর বয়স তখন ও তিনি যথেষ্ট পরিশ্রমী, কর্মক্ষম ছিলেন। তিনি বৈশালী থেকে ভন্ডগ্রাম ও আরো কতগুলি গ্রাম অতিক্রম করে অবশেষে কুশীনগরের দিকে যাত্রা করেন। পথে পাবা নামক গ্রামে প্রান্তবর্তী আম্র বনে খানিকক্ষন বিশ্রাম করেন। এই ভূমিটি চুন্দ নামক জনৈক কর্মকার বৌদ্ধ সমাজে দান করেছিলেন। চুন্দ বুদ্ধদেব ও সঙ্গী ভিক্ষুকদের ভোজনের জন্য তণ্ডুল ও বরাহ মাংস প্রস্তুত করলেন। প্রবাদ এই যে, সেই মাংস ভোজন করেই বুদ্ধদেব পীড়িত হন এবং এই পীড়াতেই তার প্রাণ বিয়োগ হয়। তাই তার মৃত্যুর কারণ স্বরূপ অনেকেই এই বরাহ মাংসকে চিহ্নিত করেন।
সেই প্রাণবিয়োগ আরো কিছু পরের ঘটনা। তার আগে দুপুরে তিনি চুন্দের আতিথ্য গ্রহণ ও খাদ্য ভক্ষণ করে অপরাহ্নে পুনরায় কুশী নগরের পথে চলতে শুরু করেন।কিন্তু খানিক যাওয়ার পর শ্রান্তি বোধ হওয়ায় বসে পড়েন ও প্রিয় শিষ্য আনন্দকে বললেন –
আমার বড় তেষ্টা পেয়েছে, জল এনে দাও। জল পান করে তিনি স্নান করতে যান অল্প দূর দিয়েই বয়ে চলা ককুত্থা নদীতে।মৃত্যু আসন্ন এই উপলব্ধি করে এবং তার মৃত্যুর পর ,লোকে পাছে চুন্দের প্রতি দোষারোপ বা কটু বাক্য প্রয়োগ করে এই আশঙ্কায় আনন্দকে বললেন – আমার মৃত্যুর পর চুন্দকে বলো, সে বড়ই পুন্য ফল অর্জন করেছে, জন্মান্তরে নিশ্চয়ই তার কল্যাণ হবে। তার প্রদত্ত অন্নাহার করে আমি মৃত্যুরূপ আরোগ্য লাভ করলাম, নির্বাণ মুখে উপনীত হলাম।আমার বুদ্ধত্বের পূর্বে সুজাতার আতিথ্য সৎকার আর এই ক্ষনে এই চুন্দার পঞ্চান্ন উপহার – এ দুই আমার কাছে সমান আদরণীয়। এ বিষয়ে যদি কোন ব্যক্তি সন্দেহ প্রকাশ করে , বলো যে এ কথা আমার, নিজের মুখ থেকে তুমি শুনেছো।
এখানে বুদ্ধদেব এর সাথে যেন যীশুক্রিস্টের অপূর্ব মিল দেখতে পাচ্ছি। দুজনেই বিদায়ের পূর্বেই তাদের যারা ক্ষতি করেছিলেন তাদেরকে ক্ষমা তো করলেনই, উপরন্তু ভাবী কাল যেন তাদের দোষী সাব্যস্ত না করে সেই ব্যবস্থাও আগাম করে গেলেন। মহত্বের হয়তো চূড়ান্ত উদাহরণ।
যাহোক, বহু কষ্টে আস্তে আস্তে কুশী নগর সমীপস্থ হিরন্যবতী নদী তীরে পৌঁছে গৌতম সেখানে খানিক্ষন বিশ্রাম করলেন। এরপর মল্ল দের শাল বনে গিয়ে বৃক্ষতলে ডান কাতে শয়ান হয়ে মৃত্যুর পর নিজের অন্তেষ্টি ক্রিয়া সম্বন্ধে আনন্দের সাথে কথোপকথন করতে লাগলেন। সন্ধ্যার সময় আনন্দের বিলাপ ধ্বনি শুনে বললেন –
ভাই আনন্দ , আমার জন্য শোক করো না, আমি তোমাদের তো আগেই বলেছি, যার জন্ম, তারই মৃত্যু – যার বৃদ্ধি তারই ক্ষয় – এমন কি কোন জিনিস আছে যার বিনাশ নাই ? শীঘ্রই হোক আর বিলম্বেই হোক, একসময় প্রিয় জনদের ছেড়ে যেতেই হবে।কিন্তু আমার মৃত্যু হলে ভেবো না । আমার প্রচারিত সত্য সকল, আমার উপদেশ, অনুশাসন – এসবই আমি রেখে যাচ্ছি – সেগুলোই আমার প্রতিনিধি – তোমাদের পথ প্রদর্শক। আনন্দ তুমি অতি যত্নে আমার সেবা শুশ্রূষা করেছো, তোমার কল্যাণ হোক। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে ধর্ম পথে চলো,বিষয়াসী, অহমিকা, অবিদ্যা থেকে পরিত্রান পাবে।যতদিন আমার শিষ্যরা শুদ্ধাচারী হয়ে সত্য পথে চলবে, ততদিন আমার ধর্ম পৃথিবীতে প্রচলিত থাকবে। পাঁচ হাজার বছর পর যখন সত্য জ্যোতি সংশয় মেঘে আচ্ছন্ন হবে, তখন যোগ্যকালে অন্যতর বুদ্ধ উদিত হয়ে আমার উপদিষ্ট ধর্ম পুনরায় উদ্ধার করবেন।
শিষ্যরা জিজ্ঞাসা করলেন, সেই বুদ্ধের নাম কি ? বুদ্ধ উত্তর করলেন – মৈত্রেয়ী।
পরদিন সকালে তিনি সকলকে জিজ্ঞাসা করলেন বুদ্ধের প্রতি কারো কোন সংশয় আছে কিনা। তার উত্তরে আনন্দ বললেন – সত্যের প্রতি, বুদ্ধের প্রতি, ধর্মের প্রতি আমাদের সকলেরই বিশ্বাস অটল, কারো মনে তিলমাত্র সংশয় নেই। পরে বুদ্ধদেব ক্ষণকাল স্তব্ধ থেকে পুনর্বার বললেন “যার জন্ম, তার ক্ষয় ও মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী—সত্যই মৃত্যুঞ্জয় হইয়া চিরকাল বাস করবে। তোমরা যত্নপূর্বক সত্যধৰ্ম্ম পালন করে আপন মুক্তিসাধন কর। এই কথা গুলো বলে, তিনি ধ্যান মগ্ন হয়ে নির্বাণ রাজ্যে প্রয়ান করলেন। চারদিকে থেকে ধ্বনিত হলো – হায় – বুদ্ধদেব মর্ত্য থেকে অন্তর্হিত হলেন – পৃথিবীর আলো যেন নিভে গেল।