শাহজাহান ও মমতাজ মহলের প্রেম ও ভালবাসার প্রতীক তাজমহল আমাদের অতিচেনা এক স্মৃতিস্তম্ভ। আমরা সবাই জানি, মমতাজ মহলের সমাধি দিল্লীর আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে, যা তাজমহল নামে বিখ্যাত। কিন্তু আমরা কমই জানি যে, তার মৃত্যু হয়েছিল আগ্রা থেকে ৯০০ কিলোমিটার দূরে মধ্য প্রদেশের বুরহানপুর শহরে।
সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে, বুরহানপুর ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। এটি খান্দেশ সুবার রাজধানী ছিল। এছাড়া শহরটি উত্তর ভারত ও দাক্ষিণাত্যের মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপনের কেন্দ্র ছিল। ১৬২৯ সালে বিদ্রোহী মুঘল সেনাপতি খান জাহান লোদি আহমদনগরের নিজাম শাহের সাথে মিলিত হয়ে সম্রাট শাহজাহানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহ দমনে সম্রাট শাহজাহান বুরহানপুরে যাত্রা করেন। সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহল তখন ১৪ তম সন্তানকে গর্ভে ধারন করেছেন। তার স্বাস্থ্যের অবস্থাও ভাল ছিল না। গর্ভাবস্থার জটিলতা নিয়েও তিনি তার স্বামীর স্বপ্ন পূরণের জন্য তার সঙ্গে বুরহানপুর যান। আসলে তিনি সবসময় শাহাজাহানের সাথে থাকতেন। শাহজাহানও তার পরামর্শ নিতেন। আমরা জানি মোঘল ও অটোমান সম্রাজ্য অনেক নারীরাই কিং মেকার ছিল।
যাইহোক এক্ষেত্রে মমতাজের শরীর যুদ্ধযাত্রার কষ্ট সহ্য করতে পারেনি। ১৬৩১ সালে সন্তান জন্মের সময় নানা জটিলতায় সন্তান বেচেঁ গেলেও তিনি মারা যান। তাঁর বয়স তখন মাত্র ৪০ বছর। এই অকাল প্রয়াণ হলেও ৪০০ বছর পরে আজও তিনি সারা পৃথিবীর কাছে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। শোকে কাতর শাহজাহান তার দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজাকে মায়ের দাফনের জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজে বের করার জন্য আদেশ করেন। প্রথমে জয়নাবাদ নামে এক বাগানে একটি প্যাভিলিয়ন তৈরী করে মমতাজ মহলকে অস্থায়ীভাবে কবর দেন। লাশ যাতে পচে না যায় সেজন্য মমি বানানোর মতো কিছু ভেসজ ঔষধ মেশানো হয়েছিল। কারণ শাহজাহান তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে এই বহু দূরের এক এলাকায় সমাধি করার চিন্তা করতে পারেন না।
বুরহানপুর মমতাজের চিরনিদ্রার জায়গা হতে পারে না বলেই এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। তার শরীরকে নানা রকম ভেসজ উপাদান দিয়ে সংরক্ষনের ব্যবস্থা নেয়া হয়। মিশরের মমি তৈরীর জন্য যেসমস্ত মশলা ব্যবহার করা হত, সেসব মশলা দিয়েই তার শরীরকে পচনের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। সমসাময়িক লেখকরা এই মৃত্যুর ও তার সমাধিস্ত করার বিশদ বিবরণ দেন। ১৪ ডিসেম্বর ১৬৩১ সালে মমতাজ মহলের মরদেহ বহনকারী এক শোকযাত্রা বুরহানপুর ছেড়ে যায়। এটির নেতৃত্বে ছিলেন ১৫ বছরের পুত্র শাহ সুজা এবং ডাক্তার উজির খান। কয়েক হাজার সৈন্য ব্যানার নিয়ে মিছিল করেছিল। মমতাজের দেহ সোনার কফিনে বহন করা হয়। বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ ও প্রজারা তাদের স¤্রাজ্ঞীকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য গ্রাম এবং শহর জুড়ে পথের দুধারে সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে চোখের অশ্রু মোছে এবং বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়। সেসময় পথের দরিদ্রদের দুহাতে সোনার মুদ্রা বিতরণ করা হয়েছিল। এমনই ভালবাসার ও শ্রদ্ধার সম্রাজ্ঞী ছিলেন মমতাজ, যার জন্য বাদশাহ শাহজাহান ৬ দিন কোনরকম খাওয়া-দাওয়া, রাজকার্য ও ঝড়োকা দর্শন কিছুই করেননি। মিছিলটি ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ অতিক্রান্ত করে আগ্রায় এসে পৌঁছায় ৫ জানুয়ারী, ১৬৩২ সালে। যমুনার পাড়ে আম্বরের রাজা জয় সিংয়ের একটি বাগান অধিগ্রহণ করে, মমতাজ মহলের দেহ দ্বিতীয়বার সাময়িকভাবে সেখানে সমাধিস্থ করা হয়। তার এই কবর দেয়া বিষয়ে দুটো মত চালু আছে। প্রথমত, অনেকে বলেন যে তাজমহল সমাপ্ত হওয়ার পরে তার দেহ সেখানে স্থানান্তরিত করা হয়। আর ঐতিহাসিকদের আরেক দল বলেন, তার অস্থায়ী কবরের উপরেই তাজমহল সমাধি তৈরি করা হয়।
সেসময় মমতাজ মহলের রেখে যাওয়া ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ছিল ১০ মিলিয়ন রুপি। যার অর্ধেক তার প্রিয়তমা কন্যা জাহানারাকে দেয়া হয়েছিল। বাকী সম্পদ অন্য সন্তানদের মধ্যে ভাগ করা দেয়া হয়েছিল। সেইকালে যদি নারী ধনীর তালিকা করা হত, তাহলে মমতাজ হতেন প্রথম। এত সম্পদের অধিকারী হয়েও তিনি নিজেকে জাঁকজমকের মধ্যে ভাসিয়ে দেননি বরং সর্বদা স্বামীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থেকেছেন। তাইতো শাহজাহানও তাঁর ভালবাসার শ্রেষ্ঠ উপহার তাজমহল তৈরি করতে কোনরকম ছাড় দেননি। দীর্ঘ ২২ বছর ধরে এক অপরুপ সৌন্দর্যের প্রেমের প্রতীক গড়েছেন। বলা হয় যে, শাহজাহান অবিরাম কাঁদতে কাঁদতে তার দৃষ্টিশক্তি দুর্বল করে ফেলেছিল এবং চশমা পরতে বাধ্য হয়। সম্রাট শাহজাহানের অমরকীর্তি প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ মহলের সমাধি তাজমহল, যা আজও জাজ্বল্যমান। এটি বিশ্বের সপ্তমাশ্বার্চযের একটি। এটি মোঘল আমলে নির্মিত ভারতের আগ্রার মুসলিম ঐতিহ্য। যা প্রত্যেকবারই নতুন আশ্বর্য ও বিস্বয় মনে হয়। এটির নির্মাণ শুরু হয় ১৬৩২ সালে এবং শেষ হয় ১৬৫৩ সালে। উস্তাদ আহমেদ লাহুরি এর নকশাকার এবং নির্মাণশৈলীতে পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় এবং ইসলামী স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য সন্মিলন ব্যবহার করেন। তাজমহল ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে বিদ্যমান। তাজমহল নির্মাণে বাংলার বহু অবদান রয়েছে। যখন শাহ সুজা বাংলার সুবাদার তখন তিনি তার পিতা শাহজাহানকে খুশি করতে এবং তাজমহল তৈরীর যোগান দিতে বহু ধন-সম্পদ রাজস্ব ও উপঢৌকন হিসেবে পাঠিয়েছেন। মুঘল ভারতের ১৭টি সুবার মধ্যে বাংলা একটি অন্যতম সুবা ছিল। সুবা বাংলা থেকে রাজস্ব বাবদ যে অর্থ দিল্লীর দরবারে যেত তা ছিল সমগ্র ভারতের ৫০ শতাংশ। দিল্লীর বড় বড় ইমারত নির্মাণে সেসব অর্থ ব্যায় করা হত। ভারত যদি নাদির শাহের কোহিনূরকে তাদের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে দাবি করতে পারে; সংগত কারণে আমরাও তাজমহলের দাবিদার।
১৬১২ সালে মমতাজের সাথে শাহজাহানের বিয়ে হয়। আরজুমান্দ বানু বেগম পরিবর্তন করে শাহজাহান তার নাম রাখেন মমতাজ মহল। তিনি ছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী। শহর আগ্রায় আনন্দের একটি সকাল ছিল। রাজবাড়ীর বাগানে বসেছিল বার্ষিক মীনা বাজার। যেখানে মোগল রাজকন্যারা এবং আভিজাত্য মহিলারা সকলেই মজার সাথে যোগ দিতেন । মুঘল রাজকুমারগণ বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখতেন, কেউবা কবুতর ও সবুজ তোতা বিক্রি করতেন। একটি স্টল ছিল রতœ এবং মুক্তো বিক্রির। যার কাউন্টারের পিছনে দাঁড়িয়ে একটি চঞ্চলা চপলা মেয়ে হাসছিল । ১৪ বছর বয়সী এবং খুব সুন্দরী মেয়েটি ছিলেন আরজুমান্দ বানু বেগম। সম্রাটের দরবারে প্রধান ওয়াকিল আসফ খানের মেয়ে। যুবরাজ খুররম ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের তৃতীয় পুত্র। তাকে ইতিমধ্যে সাম্রাজ্যের ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণা করা হয়েছে। প্রিন্স খুররম আরজুমান্দ বানুর স্টলে কাছে গিয়ে একটি বড় কাচের টুকরা দেখছিলেন। আরজুমান্দ কাচের টুকরোটিকে একটি অনন্য হীরা হিসাবে ঘোষণা করলেন। রাজকুমার বিশাল মূল্য প্রদান করে সেটি কিনেছিলেন। জানা যায় – সেইদিন বিকেলে, খুররম বাড়িতে গিয়ে তার বাবার কাছে বলেন যে, তিনি আসফ খানের মেয়েকে বিয়ে করতে চান। যুবরাজের আরজুমান্দ বানুকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত মুঘল দরবারের সাথে গিয়াস বেগের পরিবারের যোগসূত্র আরো অক্ষত করেছিল। মমতাজ জীবনের প্রথম বছরগুলিতে কলা এবং অন্যান্য বিদ্যা শিখেছিলেন। বলা হয়, মুঘল পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি করতে কেবল মহিলারা সক্রিয় খেলোয়াড়ই ছিলেন না, তারা রাজা-নির্মাতা হিসাবে বিবেচিত হত। মমতাজ মহলও আলাদা ছিলেন না। খুররাম যখন সম্রাট শাহজাহান হয়েছিলেন, তখন তিনি মমতাজকে তার সীলমোহর দিয়েছিলেন। যা রাজকীয় আদেশ জারি করার জন্য ব্যবহার করা হয়। মুঘল নারীদের অনেকের মতোই মমতাজ মহল একজন দক্ষ কবি এবং দক্ষ ধনুবিদ ছিলেন। তিনি স্বামীর সাথে হাতির লড়াই দেখতে উপভোগ করেছেন।
শাহজাহানকে তাঁর জীবনের শেষ ৮ বছর আগ্রার দুর্গে গৃহবন্দি হয়ে কাটাতে হয়। আওরঙ্গজেব তাঁর বাবাকে আগ্রার লাল দুর্গে বন্দী করেছিলেন। ১৬২৭ সালে জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর শাহজাহান শ্বশুর আসফ খানের কূটনৈতিক কৌশলের বদৌলতে সম্রাট জাহাঙ্গীরের উত্তরাধিকারী হিসেবে ১৬২৮ সালে ‘আবুল মুজাফ্ফর শিহাবুদ্দীন মুহম্মদ শাহজাহান’ উপাধি নিয়ে আগ্রার সিংহাসনে বসেন। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস, তাঁর রাজত্বকালের শেষের দিকে তাঁর সন্তানদের মাঝে উত্তরাধিকার যুদ্ধ একটি কলংকিত ইতিহাস। এ কারণে সম্রাট শাহজাহানের শেষ জীবন হয়ে উঠেছিল হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক। ফোর্ট থেকেই গৃহবন্দি সম্রাট শাহজাহান অপলক চোখে তাকিয়ে থাকতেন তাজমহলের দিকে। ১৬৬৬ সালে আগ্রা ফোর্টে শাহজাহানের মৃত্যু হয়। স্ত্রী মমতাজের পাশে তাজমহলেই তাকে সমাধিত করা হয়।