প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসের অসংখ্য দিক নিয়ে নানাবিধ আলোচনা হলেও তাদের জীবন ও পরজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান নিয়ে খুব কমই আলোচনা হতে দেখা যায়। এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হলো মিশরীয়দের খাবার, যা তাদের সমাজ ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলো। মিশরীয় শিল্প, পুরাতত্ত্ব ও দেয়ালচিত্রগুলোতে দেখা যায়, প্রাচীন মিশরীয়রা কি ধরনের খাবার খেতো, কিভাবে খেতো বা কিভাবে রান্না করতো।
বিভিন্ন মন্দিরের দেয়ালে দেবতাদের জন্য নিবেদিত খাবারগুলোর নমুনা দেখা যায়। সমাধির দেয়ালগুলোতে ছিলো খাদ্যে ভরপুর পাত্রে সজ্জিত টেবিলের ছবি।
আমরা শুধু তুতেনখামুনের সমাধিতে পাওয়া স্বর্ণের প্রাচুর্যের কথাই শুনেছি। কিন্তু তুতেনখামুনের সমাধিতে যে প্রচুর পরিমাণ খাবারের নমুনা পাওয়া গিয়েছে, সেগুলোর কথা অতো একটা জানা যায় না। ইমার গম, রসুন, ছোলার ডাল, মুগ ডাল, হলুদ তরমুজ, মেথি, ধনিয়া, ডুমুর, খেজুর, ডালিম, জুনিপার বেরি, কাজুবাদাম ইত্যাদি অসংখ্য খাবারের নমুনা তুতেনখামুনের সমাধিতে মিলেছে।
রুটি ছিলো মিশরীয়দের প্রধান খাদ্য এবং অত্যন্ত পছন্দনীয়ও বটে। তারা বিভিন্ন আকৃতির রুটি তৈরি করতো। কোন স্মৃতিস্তম্ভের আকৃতি, কিংবা রাজহাঁস, গবাদি পশু, হরিণ ইত্যাদি প্রাণীর আকৃতি; এছাড়াও ফুল, ফুলদানি, ফল এবং জ্যামিতিক আকৃতির রুটিও প্রাচীন মিশরীয়রা তৈরি করতো।
বিয়ার ছিলো মিশরীয়দের দ্বিতীয় প্রধান পানীয় জাতীয় খাবার। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে বিয়ার খেতো। তবে শিক্ষকরা শিশুদেরকে বিয়ার পান না করতে সতর্ক করতেন। উচ্চপদস্থ মিশরীয়রা বিয়ারের পরিবর্তে ওয়াইন খেতো। ওয়াইন বিয়ার অপেক্ষা দামি ছিলো। বাগদাদে পাওয়া দশ শতকের একটি বইতে মিশরীয় ওয়াইনের প্রস্তুত প্রণালী পাওয়া যায়।
প্রোটিনের উৎস হিসেবে প্রাচীন মিশরীয়রা গবাদি পশুর মাংস খেতো। আর উচ্চবিত্তরা খেতো গরুর মাংস। সাধারণ মানুষ উৎসব বা ছুটির দিনে গরুর মাংস খেতো। দেবতাকে উৎসর্গ করা গরুর মাংস গরীবদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হতো। মাংসকে প্রায় ৩০ টুকরো করা হতো। গরুর সামনের পায়ের মাংস ছিলো সবচেয়ে দামি, যা সাধারণত সমাধিতে শায়িত সম্মানিত ব্যক্তিকে উৎসর্গ করা হতো। সাধারণত গবাদি পশুগুলোকে উৎসর্গ করার আগে খাইয়ে-দাইয়ে মোটাতাজা করা হতো। গবাদি পশুর মাংস গুলোকে ভাপে সিদ্ধ করে পাতলা করে কেটে তৎক্ষণাৎ বাতাসে শুকিয়ে লবণ দিয়ে খাওয়া হতো।
মিশরীয়রা ভেড়া এবং ছাগলও খেতো। এছাড়াও শুকর, হরিণ, হায়েনা ও ইঁদুরের মাংসও তারা খেতো।
বিভিন্ন পাখির ডিমও প্রাচীন মিশরীয়দের পছন্দ ছিলো। নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগে তারা মুরগিকে তেমনভাবে চিনতো না। অন্যান্য পাখির মধ্যে সারস, টিয়া, রাজহাঁস, বেগুনি ডাহুক, ইউরোপীয় জলচর পাখি কুট, কবুতর, শকুন ইত্যাদিই তারা খেয়ে থাকতো। প্রথমে পাখির ঘাড় মুড়িয়ে হত্যা করে শরীর থেকে মাংস ছাড়ানো হতো এবং লবণযুক্ত পাত্রে কিংবা কয়লার আগুনে সিদ্ধ করে মাংসগুলোকে সংরক্ষণ করা হতো। গবাদি পশুর মতো পাখিদেরকেও জীবিত থাকা অবস্থাতে বেশি করে কেক খাইয়ে মোটাতাজা বানানো হতো।
তবে এগুলোর বাইরেও প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে সহজলভ্য প্রোটিনের উৎস ছিলো নীলনদ ও এর খালগুলো থেকে প্রাপ্ত মাছ। তারা বাতাসে শুকিয়ে বা লবণাক্ত করে মাছকে সংরক্ষণ করতো। তবে তাদের সবচেয়ে পছন্দ ছিলো বুটার্গো, যা মূলত মাছের ডিম্বাশয়ের চাপ।
ডেইরি পণ্যের মধ্যে তারা গরুর দুধ, ছাগলের দুধ এবং গাধার দুধ পান করতো। গাধার দুধকে সাধারণত তারা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করতো। মিশরীয় সমাধিগুলোতে পনিরের অবশেষও মিলেছে, যা থেকে বোঝা যায় তাদের খাদ্য তালিকায় পনিরও বিদ্যমান ছিলো।
বিভিন্ন খাবারে সুইটনার বা মিষ্টকরণ উপকরণ হিসেবে তারা মধু ব্যবহার করতো। এছাড়াও তারা সবজি, ফল ও বীজ খেতো। কিন্তু এগুলো তারা কিভাবে খেতো তা জানা যায় নি, সম্ভবত কাঁচাই খেতো।
প্রাচীন মিশরীয়দের মধ্যে পুরুষ-নারী সবাই রান্না কিংবা খাবার প্রস্তুতির সাথে জড়িত ছিলো। পুরুষরা সাধারণত মন্দিরগুলোতে কিংবা বাইরে অর্থের বিনিময়ে রান্না করতো, আর নারীরা ঘরে পরিবারের জন্য রান্না করতো। মিশরীয় মোটিফগুলোতেও দেখা যায়, সুস্বাদু খাবারে ভরপুর টেবিলের সামনে চেয়ারে বসা দম্পতির সাধারণ চিত্র। এছাড়াও মাঠে বা জলাভূমিতে বসে খাদ্য গ্রহণরত কৃষকের চিত্রও দেখা যায়, যার খাবার ছিলো খুবই সাধারণ- একগুচ্ছ পেঁয়াজ, একটি রুটি এবং ভাজা মুরগি। রুটি আজও মিশরীয়দের অত্যন্ত প্রিয় খাদ্য, কেননা রুটিকে তারা আক্ষরিক অর্থে ‘জীবন’ বলেই মানে।