উর্দু ভাষার জন্ম হয়েছিল দিল্লিতে, কিন্তু এই ভাষায় কবিতা লেখার সূত্রপাত হয়েছিল দাক্ষিণাত্যে। উর্দু ভাষার কবিতা সংকলন দিওআন, শায়েরী (কবিতা) লেখা শুরু হয়েছিল দাক্ষিণাত্যে।
অযোধ্যার প্রথম নবাব, বুরহান-উল-মূলক বাহাদুর, সাদত আলী খানের সঙ্গে যাঁরা লখনউ এসেছিলেন তাঁদের সঙ্গেই দিল্লি শহর থেকে পুরোনো লখনউ শহরে প্রবেশ করেছিল উর্দু ভাষা।
অযোধ্যায় উর্দু কবিতার শৈশবকালে উল্লেখযোগ্য ছিলেন খান আরশুর, তিনিই উর্দু শায়েরীর প্রথম ওস্তাদ ছিলেন। ১৭৫২ সালে লখনউ শহরে তাঁর মৃত্যু হয়। উর্দু শায়েরীকে লখনউ আনার কৃতিত্ব তাঁরই।
পরবর্তী পর্যায়ে লখনউয়ে উর্দু কবিতার শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মির্জা রফি, মীর তকী, সৈয়দ মুহম্মদ মীর প্রমুখ। সকলেই দিল্লি ত্যাগ করে লখনউ এসেছিলেন এবং সেখানেই দেহরক্ষা করেন।
আসগর আলী খাঁ ফুগা ছিলেন সুজাউদ্দৌল্লার সভাকবি। উর্দু শায়েরীর এই পর্যায়ে যাঁরা দিল্লির কবি-সভা থেকে লখনউ শহরে এসেছিলেন তাঁদের এমন কদর হয়েছিল যা হিন্দুস্তানের ইতিহাসে ইতিপূর্বে ঘটেনি। এঁদের মধ্যে মির্জা জাফর আলী, মীর হায়দর আলী, খোজা হাসান, মীর হাসান দেহলভী ছিলেন প্রমুখ।
লখনউয়ের উর্দু শায়েরী প্রসঙ্গে আর এক ধরনের উর্দু কবি-প্রতিভার কথা না বললে লখনউ শহরে বেড়ে ওঠা উর্দু-প্রীতির ইতিহাস অসমাপ্ত থেকে যায়। তাঁরা হলেন সৈয়দ ইনশা, মুসহফী, কতিল প্রমুখ। এঁরা ছিলেন সঠিক অর্থে মীর-এ-মজলিশ .. কবি সম্মেলনের সভানায়ক। এঁরা লখনউয়ে থেকেছেন, লখনউয়ে বিকশিত হয়েছেন আবার লখনউয়েই মৃত্যুবরণ করেছেন।
উর্দু কবিতার ভাষা ছিল পুরুষ ভাষা, শাইরা বা মহিলা কবি যখন স্বগতোক্তি করেছেন তখন পুরুষ হয়েই করেছেন, পুরুষের ভাষাই প্রয়োগ করেছেন। ফারসি কবিতার যৌবন এসেছিল মসনবীর মাধ্যমে। মসনবী একটি কাব্যরূপ, যাতে কোনো কাহিনি বা উপদেশ একটি বৃত্তেই বিধৃত হয়। প্রতি শেরের পঙ্ক্তিদ্বয় সানুপ্রাস। কিন্তু পরবর্তী শেরের অন্ত:ধ্বনির সঙ্গে অনাত্মীয়। মৌলানা রাম, খুশির, জামী, হাতিফী প্রমুখ কবি বিখ্যাত হয়েছিলেন এই কাব্যরূপের মাধ্যমে। লখনউ প্রবাসকালে মীর তকী মীর উর্দুতে ছোটো ছোটো অনেক মসনবী লিখেছিলেন।
মীর তকী মীরকে উর্দু কবিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ট আসনে বসিয়েছিলেন গালিব। তাঁর একটি মুকতহ-তে তিনি লিখেছিলেন,
‘রেখতে কে তুম হি উস্তাদ নহী হো গালিব
কহতে হ্যায় অগলে জমানে মে কোই মীর ভি থা’।
মুহম্মদ তকীর তখল্লুস বা ছদ্মনাম ছিল শুধু মীর। অন্যতম সুপরিচিত কবি মীর দর্দ (দিল্লি ত্যাগ করেননি) থেকে পৃথক করার জন্য মুহম্মদ তকীকে উল্লেখ করা হত মীর তকী মীর নামে। ফারসি গদ্যে রচনা করেছিলেন তাঁর স্মৃতিচারণা, জিক্র-ই-মীর। মীরের জন্মস্থান এবং বাল্য ও কৈশোরের স্থান ছিল আগরা, জন্মগ্রহণ করেছিলেন সম্ভবত ১৭২২ অথবা ১৭২৩-এ। শেষ বয়েসে আশ্রয় নিয়েছিলেন লখনউয়ে। ১৭৮২ সালে তিনি লখনউ এসে পৌঁছেছিলেন।
১৭৩৯ সালে নাদির শাহের দিল্লি লুন্ঠন এবং ১৭৫৭ সালে আহমদ শাহ আবদালীর দিল্লী ধর্ষণ এবং মুঘল পরিবারের অপদার্থ উত্তরাধিকারীদের ঘিরে ওমরাহদের ষড়যন্ত্র, আত্মকলহ, বিশ্বাসঘাতকতা কবি মনেও প্রভাব ফেলেছিল। মুঘলদের রাজধানীর উজ্জ্বল জীবন ও বিদগ্ধ সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলেছিল তৎকালীন দিল্লি শহর। অপসৃত মুঘল বৈভবের সঙ্গে মানুষের জীবনের রঙ-রস-মাধুর্য্য সব লুপ্ত হয়েছিল। হৃতগৌরব দিল্লিতে তখন গুণীজনকে পোষণ করার মতো মানুষ আর অবশিষ্ট ছিল না।লখনউয়ের নবাবেরা গুণীজনদের আশ্রয়দাতা বলে বিখ্যাত হলে, দিল্লি থেকে সব গুণীজন লখনউয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
উর্দু কবি সওদাকেও লখনউয়ের নবাবেরা মাসোহারা দিতেন, সসম্মানে মাথায় করে রেখেছিলেন তাঁরা। ১৭৮১ সালে সওদার মৃত্যু হয়।
মীর লখনউ এসে পৌঁছোলে, খবর গেল নবাব আসাফুদ্দৌল্লার কানে। তিনি নিজে এসে তাঁকে স্বাগত জানালেন এবং তাঁর বসবাসেরও সব রকম প্রয়োজন মেটানোর সুবন্দোবস্ত করে দিলেন। মাসিক তিনশো টাকা মাসোহারারও ব্যবস্থা করে দিলেন নবাব।
লখনউ দরবারে উর্দু কবি সওদার যতখানি প্রতিপত্তি ছিল ততখানি মীর পাননি হয়তো, কিন্তু যত দিন নবাব আসাফুদ্দৌল্লা বেঁচেছিলেন তত দিন তাঁর আর্থিক সাচ্ছল্য যথেষ্টই ছিল।
দীর্ঘ ২৮ বছর তিনি লখনউয়ে বাস করেছিলেন। দিল্লি যতই হতশ্রী হচ্ছিল, লখনউর ততই শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছিল। মীর কিন্তু সব সময়ই বিশ্বাস করতেন দিল্লির জামা মসজিদের সিঁড়িতে যে উর্দু শোনা যায় তা লখনউর দরবারে পাওয়া যায় না।
তিনি লখনউয়ে থাকাকালীন প্রথম দিন থেকেই নিজেকে স্বতন্ত্র রেখেছিলেন। তাঁর কাছে লখনউয়ের সংস্কৃতি ভুঁইফোঁড় সংস্কৃতির সমান ছিল। তিনি ছিলেন পুরোনো কেতার মুঘলাই ঘরানার মানুষ।
তিনি প্রতিভাবান বলেই নবাব আসাফুদৌল্লার দরবারে স্থান পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন স্পর্শকাতর ও অভিমানী। নবাব আসাফুদ্দৌল্লার একটি সুন্দর গ্রন্থাগার ছিল। একদিন মীর সেই গ্রন্থাগারে বসে একটি বই পড়ছিলেন, এমন সময় নবাব আসাফুদৌল্লা এসে মীরকে অনুরোধ করলেন, তাঁর (মীরের) কাছে যে বইটি আছে সেটা একটু এগিয়ে দেওয়ার জন্য। বদমেজাজি, অসহিষ্ণু ও স্বীয় অহংকারে সচেতন মীর, নবাবের দিকে দৃষ্টিপাত না করে ভৃত্যকে ডেকে বললেন, “ওহে, তোমার প্রভু কী চাইছেন শোনো”। নবাব আসাফুদৌল্লা নিজে এসে বইটি নিয়ে অন্য টেবিলে চলে গেলেন।
মীর শুধু দরবারে নয়, শিকারেও নবাব আসাফুদ্দৌল্লার সহগামী হতেন। তিনি সব আমোদ-উৎসবেই নবাবকে সঙ্গ দিতেন। যদিও শেষ দিকে তাঁর সঙ্গে নবাব আসাফুদ্দৌল্লার ব্যক্তিগত সম্পর্ক চিড় খেয়েছিল। ১৭৯৭ সালে মৃত্যু হয় নবাব আসাফুদ্দৌল্লার। তাঁর মৃত্যুর পরও নবাব সাদত আলী খানের কাছ থেকে বছর তিনেক মীর মাসোহারা পেয়েছিলেন। তার পর তিনি বিস্মৃত হয়ে যান লখনউ দরবার থেকে।
একদিন নবাব সাদত আলী খান সদল ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন লখনউ শহরে। একটি মসজিদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সবাই উঁঠে দাঁড়াল। কিন্তু মসজিদচত্বরে বসে থাকা এক বৃদ্ধ শুধু উঁঠে দাঁড়াননি। নবাব খোঁজ নিয়ে জানলেন সেই অহংকারী বৃদ্ধ ভিখারি আর কেউ নন, স্বয়ং মীর তকী মীর। বৃদ্ধের দারিদ্রজীর্ণ অবস্থা দেখে নবাব তাঁর কাছে হাজার টাকা ও নতুন পোশাক পাঠালেন। জানা যায়, জরাগ্রস্ত অনাহারক্লিষ্ট বৃদ্ধ নবাবের উপঢৌকন ফেরত দিয়ে বলেছিলেন, “আমার দরকার নেই, আমি তত গরিব এখনও হইনি”। অবশেষে তৎকালীন লখনউর তরুণ শায়র সৈয়দ ইনশার দৌত্যে তিনি নবাবের উপঢৌকন গ্রহণ করেছিলেন।
আত্মাভিমানী কবি বলেছিলেন, “সাদত আলী খান তাঁর রাজ্যের রাজা হতে পারেন, আমিও তো আমার রাজ্যের রাজা”। তিনি বিশ্বাস করতেন তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কাব্যে। তাই তিনি বলতেন, “আমি যে ক’টা দিন শ্বাস নিচ্ছি, সে ক’টা দিনই আমি তোমাদের মজলিসের শোভা’। ১৮১০ সালে এ হেন কবির মৃত্যু হয়।
‘হ্যাঁ, মীরও ভিখারী, কিন্তু একত্রে ইহলোক ও পরলোক –
এই একটিমাত্র ভিক্ষা তার’।