আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী” – এ গান লেখার ত্রিশ বছর পরে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুঁজে পান তাঁর সেই চেনা, শারদপ্রাতে কিংবা কোনো মায়াময়ী মাধবী রাতে দেখা বিদেশিনীকে, নাম তার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের সূচনা, অনুপ্রেরণা ‘বিজয়া’ অর্থাৎ ভিক্টোরিয়া।
বিজয়া বা ভিক্টোরিয়া- যা-ই বলি না কেন, রবীন্দ্রনাথের সাথে ছিল তার এক গভীর প্লেটোনিক প্রেমের সম্পর্ক।

                                   ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো

কে ছিলেন এই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো?

তাঁর জন্ম হয়েছির বুয়েন্স এয়ার্সে এবং তৎকালীন অভিজাত পরিবারের রীতি অনুযায়ী তার শিক্ষালাভ হয়েছিল স্বগৃহে একজন অভিজ্ঞ পরিচারিকার কাছে। প্রথমেই তিনি ফরাসি ভাষা শিক্ষা করেছিলেন। কার্যতঃ কোনরূপ প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী তার হয় নি। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর অফ লিটেরেচার উপাধি প্রদান করে। এছাড়া হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টর অফ লিটেরেচার উপাধি প্রদান করে। তিনি ছিলেন আর্জেন্টিনা একাডেমী অফ লেটারস-এর প্রথম নারী সদস্য। ১৯৭৯ সালে ৮৮ বৎসর বয়সে সান ইসিদ্রোয় অবস্থিত তার আবাসগৃহ “ভিলা ওকাম্পো”-তে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার সম্পত্তি দেশের শিক্ষার উন্নয়নের জন্য দান করে যান।

                                  বিখ্যাত ভিলা-ওকাম্পোর সামনে

তিনি ছিলেন একজন আর্জেন্টাইন নারীবাদী লেখিকা, একজন পুরোদস্তুর সাহিত্যিক। তিনি ‘সুর’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের সাথে তার পরিচয় হয় সাহিত্যের হাত ধরেই। তবে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে চেনার আগে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের সাথে পরিচয় ঘটে ভিক্টোরিয়ার। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হতে থাকে ‘গীতাঞ্জলী’। ভিক্টোরিয়ার হাতে এসে পড়ে গীতাঞ্জলীর ইংরেজি, স্প্যানিশ ও ফরাসি অনুবাদ। এর মধ্যে আঁদ্রে জিদের ফরাসি ভাষায় করা গীতাঞ্জলীর অনুবাদ ছিল তার প্রিয়। গীতাঞ্জলী পড়ে রবীন্দ্রনাথের একজন ভক্ত হয়ে ওঠেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের লেখা তাকে এতটাই ছুঁয়ে গিয়েছিল যে, তিনি সেসময়ে ‘রবীন্দ্রনাথ পড়ার আনন্দ’ নামে একটি লেখাও লিখে ফেলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৪ সালে পেরুর স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে যোগ দিতে পেরুর উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন, কিন্তু মাঝপথে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁকে আর্জেন্টিনায় অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সবে আর্জেন্টিনা পৌঁছেছেন, তারপর আ্যান্ডেস পর্বতমালা অতিক্রম করে সুদূর লিমা নগরীতে যেতে হবে। অসুস্থ শরীর নিয়ে সেই যাত্রা নিরাপদ নয়, এই বিব্রত অবস্থায় কবির এক অনুরাগিনী, আর্জেন্টিনার অভিজাত বিত্তশালী মহিলা, কবিকে নিমন্ত্রণ করলেন। আর্জেন্টিনার বুয়েন্স এয়ার্সে – সান ইসিদ্রো নামক একটি ছোট শহর।সেখানেই রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়ার আমন্ত্রণে অতিথি রূপে প্রায় দুই মাস ছিলেন, এই ভাবে দৈবাৎ, নিতান্ত ঘটনাচক্রে রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়ার পরিচয় ঘটেছিল।

                                 ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথ

আদরের উপবাস বইয়ে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, চৌত্রিশ বছর বয়স্ক ভিক্টোরিয়া তেষট্টি বছরের রবীন্দ্রনাথকে দেখে মুগ্ধতা নিয়ে লিখেছিলেন।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এলেন; নীরব, সুদূর, তুলনাহীন বিনীত। ঘরে এসে দাঁড়ালেন, আবার এও সত্যি যে ঘরে যেন তিনি নেই। তেষট্টি বছর, প্রায় আমার বাবার বয়সী, অথচ কপালে একটি রেখাও নেই, যেন কোন দায়িত্বভারই নষ্ট করতে পারে না তাঁর সোনালী শরীরের স্নিগ্ধতা। সুগোল সমর্থ গ্রীবা পর্যন্ত নেমে এসেছে উছলে-ওঠা ঢেউতোলা সাদা চুলের রাশি। শ্মশ্রুমণ্ডলে মুখের নিচের দিকটা আড়াল, আর তারই ফলে উপরের অংশ হয়ে উঠেছে আরো দীপ্যমান। মসৃণ ত্বকের অন্তরালে তার সমগ্র মুখায়ববের গড়ন এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য রচনা করেছে, তেমনি সুন্দর তাঁর কালো চোখ, নিখুঁত টানা ভারী পল্লব। শুভ্র কেশদাম আর স্নিগ্ধ শ্মশ্রু, এর বৈপরীত্যে জ্বলে উঠছে তাঁর চোখের সজীবতা। …

কবির বাসগৃহ ছিল সান ইসিদ্রো শহরে ওকাম্পো পরিবারের বাসস্থানের কাছে ‘মিরালরিও’ নামে একটা বাড়িতে। এই বাড়ি রিও দে প্লাতা নদীর ধারে, তাই বাড়ির নাম ‘নদী-দর্শন’। প্রথমে ভাবা হয়েছিল কবি সপ্তাহখানেক আর্জেন্টিনায় থাকবেন তাঁর স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য। কিন্তু সেই এক সপ্তাহ ডাক্তারদের নির্দেশে ক্রমে দুই মাস হয়ে দাঁড়ায়। রিও প্লাতার তীরে বাসগৃহের বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে কবি খুব আনন্দে ছিলেন এবং এই সময়ে তিনি অনেকগুলি কবিতা রচনা করেন।

                            ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথ

সান ইসিদ্রোর সেই বাড়ি মিলারিওর বারান্দায় বসে বসে রবীন্দ্রনাথ এবং ভিক্টোরিয়া একসাথে নদী দেখতেন। কখনো বা বাড়ি সংলগ্ন তিপা গাছের নিচে বসে অবিশ্রান্ত আড্ডা দিতেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন বিজয়াকে, বিজয়াও শোনাতেন শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা। সে সময়টাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপভোগ করেছেন প্রাণভরে। সুদূর সান ইসিদ্রোর সেই বাড়ির স্মৃতি রোমন্থন করেছেন শান্তিনিকেতনে বসেও।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে । তিনি কেবল দুটো শব্দ লিখেছিলেন- ‘বিজয়ার করকমলে’। এই বিজয়া যে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোই তা বলা বাহুল্য!

২৯ অক্টোবর ১৯২৫, রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে একটি চিঠি লিখেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে—

‘’আমার বাংলা কবিতার একটি বই তোমাকে পাঠালাম, নিজে তোমার হাতে দিতে পারলে ভাল হত। এই বইটি তোমাকেই উৎসর্গ করেছি, যদিও তুমি কোনও দিন জানবে না কি আছে এতে! অনেক কবিতা এই বইতে আছে যেগুলি যখন সান ইসিদ্রো ছিলাম তখন লেখা। আমার পাঠকেরা কোনও দিন জানবে না কে বিজয়া, কবিতাগুলির সঙ্গে তার সম্পর্কই বা কি? আমার আশা এই বইটির লেখক যতটুকু তোমার সঙ্গ পেয়েছিল, তার চাইতেও বইটি তোমার সঙ্গে অনেকদিন থাকবে’’।

            ডিয়ার গুরুদেব

চিঠিটি তিনি ইংরেজীতে লিখেছিলেন। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো চিঠির উত্তরে লিখেছিলেন, “বইটাতে কী আছে তা জানার জন্য আমি পাগল হয়ে আছি।” প্রেমের প্রকাশে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন! রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি পুরো একটি বই-ই লিখে ফেললেন । ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বই ‘Tagore en las barrancas de San Isidro’, বাংলায় বলা যায় ‘সান ইসিদ্রোর উপত্যকায় ঠাকুর’ বা ‘সান ইসিদ্রোর উপত্যকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বায়োপিক ‘থিঙ্কিং অব হিম’ সিনেমায় উঠে এসেছে বিজয়ার সাথে তার এই প্রেমের গল্প।

                           কবিগুরু কে নিয়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো লেখা বই।

কেবল কবিতা রচনা নয়, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মে আর এক নতুন উদ্যম এনেছিল এই সান ইসিদ্রো অবসর, সেটা হচ্ছে অনুপ্রেরণা। কবি তাঁর পাণ্ডুলিপিতে নানা রেখা দিয়ে সংশোধন ও সংযোজনকে চিহ্নিত করতেন, ভিক্টোরিয়া চিত্রকর রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করেন ওই সব পাণ্ডুলিপি দেখে। পাণ্ডুলিপিতে অসমাপ্ত চিত্র বা আঁকিবুকি দেখার পর ভিক্টোরিয়া রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন সেগুলিকে আরও বড় আকারে ক্যানভাসে চিত্রিত করতে।

                                                    রবীন্দ্রনাথ অঙ্কিত বহু নারীমুখের প্রতিকৃতিতে ভিক্টোরিয়ার মুখের আদল খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা।

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয় মাত্র দু’বার। ১৯২৪ সালে আর্জেন্টিনায় দেখা হওয়ার পর আবার দেখা হয় প্যারিসে, ১৯৩০ সালে। এর পর রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রবাহ শুরু হয়। ছয় বছর পর রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনী হয় প্যারিসের বিখ্যাত পিগাল গ্যালারিতে, তাঁর আঁকা ছবিগুলোর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে দেন ভিক্টোরিয়া। এটি ছিল ইউরোপে তাঁর প্রথম প্রদর্শনী।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্র-গবেষক কেতকী কুশারী ডাইসন-এর অভিমত। তারই অনুসরণে অভিজিৎ রায় রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবিগুলির মধ্যে একাধিক ছবি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রতিকৃতি বলে সাব্যস্ত করেছেন। এর মধ্যে ডার্টিংটন হল এবং রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত দু’টি ছবি অভিজিৎ এই বইতে দিয়েছেন, সাদৃশ্য সত্যিই আছে।
বিজয়া কেবল কবিতায় নয়, চিত্রকলাতেও ছিল।

           ভিলা ওকাম্পোর দেয়ালে ঝোলানো ওকাম্পোর একটি পোর্ট্রেইট

যদিও বা আমরা মেনে নিই যে, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার বিকাশ বা নারী-ভাবনার প্রগতিতে ওকাম্পোর প্রভাব দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে সেই সিদ্ধান্ত কতটা গুরুত্ব পাবে এই দুই ব্যক্তির মধ্যে সম্বন্ধের ইতিকথায়? রবীন্দ্রনাথের মনোজগতে তাঁর বিজয়ার উপস্থিতির প্রভাব হিসেবের বাইরে, কার্যকারণের অনুমানের অতীত, অন্তরের অন্তঃস্থলে। সে বিষয়ে অনেক সময়ে কবির নীরবতা লক্ষণীয় এবং এই নীরবতাকে সম্মান করা আবশ্য কর্তব্য।

ভিক্টোরিয়ার লেখা টাগোরে এন লাস্ বারানকাস দে সান ইসিদ্রো (ফনডাসিওন সুর, বুয়েনোস আইরেস, ১৯৬১)।
আর্জেন্টিনার ভারতীয় দূতাবাস এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পেনীয় ভাষা বিভাগ,একটি ইংরেজি বই প্রকাশ করেছিল: ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: অ্যান একসারসাইজ ইন ইন্দো-আর্জেন্টাইন রিলেশনশিপ (১৯৯২)। এই বইতে ওকাম্পোর কয়েক দশকের সচিব ও সহকারী ডঃ মারিয়া রেনে কুরা লিখেছিলেন অতি মূল্যবান নিবন্ধ রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া সম্পর্কে।

কী বলা যায় এ প্রেমকে? নিষ্কাম প্লেটোনিক প্রেম? যা-ই বলা হোক না কেন, দূরত্ব আর বয়সের বাঁধা ছাপিয়ে এ প্রেম ছিল বাধাহীন, ছিল স্মৃতীময়, আর ছিল পৃথিবীর এক ঐতিহাসিক সম্পর্কের সাক্ষী।

  তথ্যসূত্র
 ভিক্টোরিয়া_ওকাম্পো_এক_রবি_বিদেশীনির_খোঁজে
 লেখক_অভিজিৎ_রায়
 আনন্দবাজার_পত্রিকা
 roar বাংলা
Photograph অভিজিৎ রায় and net