সারি সারি ঘরবাড়ি, অতলস্পর্শী পাতকুয়ো, মন্দির, পাথুরে পথ সবই আছে; নেই শুধু থাকবার কেউ। প্রায় ২০০ বছর ধরে এভাবেই পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে রাজস্থানের কুলধারা গ্রাম।সোনার কেল্লার শহর জয়সলমীর থেকে ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে। প্রচলিত বিশ্বাস হল‚ এই গ্রাম ভৌতিক। তার নাকি জলজ্যান্ত প্রমাণও মিলেছে।থর মরুভূমির কোলে এই গ্রামের পত্তন হয়েছিল ১২৯১ সালে। যোধপুরের পালি সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণরা এখানে বসত গড়েছিলেন। তাঁরা কৃষি এবং ব্যবসা দুটোতেই সমান দক্ষ ছিলেন। তাঁরা নাকি মরুভূমিতেও গমের ফলন করতে পারতেন। সোনালি বালির মাঝে মরুদ্যানের মতোই মাথা তুলে একটা সময়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে ছিল কুলধারা।

অভিশপ্ত নগরী কুলধারা; Image Source: Travel Tales from India

৮৪টি ছোট ছোট সম্প্রদায়ভিত্তিক গ্রাম মিলিয়েই গড়ে উঠে ছিল এই নগরী। সেই সময় প্রায় পনেরশ’ মানুষের বেশ সমৃদ্ধ এক জনপদ ছিল কুলধারা। রাজস্থানের চারপাশ মরু অঞ্চল হওয়া স্বত্ত্বেও কুলধারায় কিন্তু সেই সমস্যা ছিল না।আবহাওয়া ও প্রকৃতি একটু ব্যতিক্রমই ছিল বলা যায়। এই অঞ্চলে শস্যের কোনো কমতি ছিল না। পালি ব্রাহ্মণরা মূলত কৃষি কাজে দক্ষ ছিল। ফলে এলাকাটি কৃষি এবং ব্যবসার জন্য বেশ বিখ্যাত ছিল সেসময়।প্রাচীন মন্দির থেকে শুরু করে, নিখুঁত নকশায় বানানো বিভিন্ন বাড়ি এখনও অক্ষত দেখা যায়। 

কুলধারা নগরীতে প্রবেশের পথ;Image Source: Haunted India

১৮২৫ সালের দিকে মাত্র এক রাতের মধ্যেই ৮৪ টি গ্রামের অধিবাসীরা স্রেফ গায়েব হয়ে যায়।টানা সাত শতক ধরে এই গ্রামে বসবাস করার পর কেন ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা হঠাৎ করেই এই নগরী ছেড়ে চলে গিয়েছিল তা আজও সকলের কাছে অজানা। শোনা যায়, প্রায় ২০০ বছর আগে জয়সলমীরে এক অত্যাচারী দেওয়ান ছিলেন।তার নাম সেলিম সিং। কর আদায়ের জন্য হেন দুর্নীতি ছিল না, যার আশ্রয় তিনি নেননি। এই সেলিম সিংয়ের একদিন নজর পড়ল কুলধারার গ্রামপ্রধানের সুন্দরী কন্যার দিকে।সে ওই মেয়েকে জোর করে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু ব্রাহ্মণদের প্রতিবাদের মুখে তা সম্ভব হয় না। সেলিম সিং ওই মেয়েটির জন্য খুবই বেপোরোয়া হয়ে উঠে। নিজে গ্রামে এসে যায়, ওই মেয়েটিকে তার চাই-ই চাই! নইলে, অস্বাভাবিক করের বোঝা মাথায় নিয়ে বাঁচতে হবে কুলধারার ৮৪ টি গ্রামকে।

এখনো অটুট থাকা কুলধারার বিখ্যাত মন্দির;Image Source: news.com.au

সেই রাতেই ঘটে যায় এক অদ্ভুত ঘটনা।রাতারাতি ৮৪ টি গ্রামের লোক যেন মিলিয়ে যায় বাতাসে! কেউ বলেন, গ্রামবাসীরা দেওয়ানের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এক বস্ত্রে। আবার কারো মতে, কুলধারার অধিবাসীরা পরবর্তী সময়ে পশ্চিম রাজস্থানের যোধপুর শহরের কাছাকাছি কোনো একটি স্থানে বসতি গেড়েছিল।কিন্তু এই বক্তব্যের মধ্যে তেমন সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না। ৮৪ টি গ্রামের লোক না-হয় রাতের আঁধারে গ্রাম ছাড়তেই পারে!কিন্তু এত বড় দল কোথাও যদি চলে বা পালিয়ে যায়, তবে কোথাও না কোথাও তো পথের মধ্যে তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে।

অথচ কেউই তাঁদের দেখলো না – তা কী করে সম্ভব! আর তারা যদি অন্যত্র গিয়ে বসতি গড়তো তাহলে তাদের বর্তমান প্রজন্মও থাকার কথা।কিন্তু, পুরো ভারতে কুলধারা গ্রামের পালি সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণদের কোথাও দেখা পাওয়া যায়নি। সেরকম তথ্যও কারো কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।তাহলে কি অলৌকিক কোনো বিদ্যার আশ্রয় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন গ্রামবাসীরা? আত্মহত্যা করলেও তো দেহ পড়ে থাকত! কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি। দেওয়ান এসে দেখেছিলেন, গ্রামের পর গ্রাম ফাঁকা পড়ে আছে। সব কিছুই রয়েছে যথাস্থানে।শুধু মানুষ নেই! রোগ নেই, শোক নেই, কিংবা কোন মহামারীও নেই। স্রেফ উধাও!সেই ঘটনার পর কত বছর কেটে গেল। তারপরও নতুন করে জনবসতি গড়ে উঠেনি কুলধারায়। জয়সলমীরের কুলধারায় এখন অবধি কেউ পা রাখতে সাহস করেন না।

পরিত্যক্ত কুয়ো;Image Source: news.com.au

অন্তত রাতের বেলায় তো নয়ই! কুলধারায় যারা রাত কাটিয়েছেন, কোনো না কোনো বিপদের মুখে পড়েছেন। কুলধারায় রাত কাটিয়ে পাড়ি দিতে হয়েছে মৃত্যুর দিকে, এমন উদাহরণও কম নেই!এই নগরটি নিয়ে কিছু গবেষক নানারকম গবেষণাও চালিয়েছিলেন। সেসব গবেষণায় এমন কিছু বিষয় উঠে আসে যার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ২০১৩ সালে দিল্লির প্যারানর্ম্যাল সোসাইটির বেশ কিছু সদস্য রাত কাটাতে গিয়েছিল কুলধারায়।অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাচ্ছে তাদের চারপাশের আবহাওয়া।

কুলধারার বর্তমান অবস্থা;Image Source: lakshmisharath.com

এই কনকনে ঠাণ্ডা, তো এই অসহ্য গরম! আর তাপমাত্রার ওই দুই অবস্থাতেই স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয় কয়েকজন সদস্যকে ধাক্কা দেয় কেউ! পিছনে ফিরে দেখা যায়- ধারেকাছে কেউ নেই! রাত বাড়লে শোনা গিয়েছিল কান্নার আওয়াজ। সকাল বেলায় উঠে তারা দেখতে পান, গাড়ির কাঁচে কোলের শিশুর হাতের ছাপ!

পরিত্যক্ত হওয়ার পরও কুলধারার কিছু বাড়ি এখনো অটুট থাকার জলন্ত ছবি;Image Source: news.com.au

মোট ৫০০টি স্থানে পরীক্ষা চালিয়ে এরকম বেশ কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন গবেষকরা। তাহলে কি এখনও ৩০০ বছর আগের ওই গ্রামবাসীরা অদৃশ্য হয়ে, অশরীরি রূপে থেকে গিয়েছেন গ্রামেই? বর্তমানে ভারত সরকার একে হেরিটেজ নগরী হিসেবে ঘোষণা করেছেন – এর বাদে আর কিই বা করার আছে!
(লেখা তথ্যসূত্র থেকে নেওয়া)

লেখকঃ Partha Bhowmick

তথ্য সুত্রঃ oli-goli/kuldhara-rajasthan-history/

thrillermaster/kuldhara-rajsthan/

bengali.oneindia/amphtml/travel/some-interesting-places-rajasthan-with-mysterious-stories

roar.media/bangla/main/travel/kuldhara-a-cursed-village-of-india/