পূর্ব আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডা এক ভয়াবহ গণহত্যার স্বীকার হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। সে বছরের জুলাই মাসে শুরু হওয়া হত্যাকাণ্ড টানা ১০০ দিন বিরতি ছাড়াই চলতে থাকে। এই ১০০ দিনের ব্যবধানে প্রাণ হারায় প্রায় ৮ লাখ মানুষ। পরিহাসের বিষয় এই যে, খোদ রুয়ান্ডার সরকার এবং সরকার সমর্থকরা নিজেদের নাগরিকদের উপর কায়েম করে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড। ইতিহাসের বীভৎস সেই সময়ে রুয়ান্ডা জড়িয়ে পড়েছিল ভ্রাতৃঘাতী পুরোদস্তুর সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে যার জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল সংখ্যালঘু তুতসি সম্প্রদায়ের ৮ লাখ জনগণকে।
গণহত্যার প্লট যেভাবে তৈরি হয়
রুয়ান্ডার এই গণহত্যার পেছনে এক দীর্ঘ জাতিগত বিদ্বেষ অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। আফ্রিকার এই দেশটিতে দুই সম্প্রদায়ের বাস ছিল। সংখ্যাগুরু হুতু সম্প্রদায়ের দৈহিক গড়ন ছিল সংখ্যালঘু তুতসি সম্প্রদায়ের দৈহিক গড়ন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তুতসিরা অপেক্ষাকৃত লম্বা ও রোগাকৃতির হওয়ায় সহজেই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য ধরতে পারা যেত। এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়েছিল মূলত বেলজিয়ানরা। ১৯১৬ সালে বেলজিয়াম রুয়ান্ডা দখল করে সেখানে উপনিবেশ কায়েম করে। বেলজিয়াম শাসনেই মূলত হুতু ও তুতসি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদের রেখা টেনে দেয়া হয়। তৈরি করা হয় হুতু ও তুতসিদের জন্য আলাদা পরিচয়পত্র। রুয়ান্ডার জনসংখ্যার শতকরা ৮৫ ভাগ হুতু সম্প্রদায়ের দখলে থাকলেও বেলজিয়ানরা হুতুদের তেমন একটা পছন্দ করত না৷ তুতসিদের বেলায় বেলজিয়াম কর্তৃপক্ষ ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি সদয়। যার কারণে সরকারি খাতে তুতসিদের প্রাধান্য ছিল বেশি৷ সুযোগ সুবিধা ভোগ করার বেলায় তুতসিরা ছিল এগিয়ে বিপরীতে সংখ্যায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও হুতুরা তেমন সুবিধা ভোগ করার খুব একটা সুযোগ পেত না। এই নিয়ে হুতুদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হতে থাকে।
এই ক্ষোভ ধীরে ধীরে তুতসিদের প্রতি ঘৃণা উগরে দেয়। ফলে হুতুরা সুযোগ খুঁজতে থাকে। বিদ্বেষ এমন পর্যায়ে পৌছে যে তুতসিদের রুয়ান্ডার নাগরিক হিসেবেই গণ্য করতে চাইত সংখ্যাগুরু হুতুরা। ক্ষিপ্ত হুতু সম্প্রদায়ের বিদ্রোহীরা ১৯৫৯ সালে যখন তুতসি রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে তখন বেলজিয়ামের ঔপনিবেশিক শক্তি নড়বড়ে হয়ে পড়ে। তার তিন বছর পর ১৯৬২ সালে বেলজিয়াম সেনাবাহিনী রুয়ান্ডা ত্যাগ করলে পুরোদস্তুর স্বাধীন দেশ হয়ে পড়ে আফ্রিকার সবুজ এই দেশটি। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে হুতুরা। ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট বনে যান হুতু চরমপন্থী নেতা জুভেনাল হাবিয়ারিমানা। রুয়ান্ডার দ্বিতীয় এই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কারচুপি করে ক্ষমতায় বসেন এবং ধীরে ধীরে একনায়কে পরিণত হন।স্বাভাবিকভাবেই ভীত তুতসিরা পালিয়ে যায় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে। তুতসিদের এক বিরাট অংশ ঘাটি গাড়ে উগান্ডায় এবং সেখানেই তারা গঠন করে সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপ রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট বা RPF. এই বিদ্রোহী গ্রুপের নেতৃত্বে তখন ছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট পল কাগামে। ওদিকে হুতুদের প্রেসিডেন্ট তার চরমপন্থী গোষ্ঠী নিয়ে অবশিষ্ট থাকা তুতসিদের নির্যাতনের ছক কষছেন। একনায়ক হাবিয়ারিমানার শাসনে রুয়ান্ডার অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তা সত্বেও তিনি বারবার ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় বসেন। নিজ মাতৃভূমিতে ফেরার লড়াইয়ে তুতসি বিদ্রোহী গ্রুপ তখন বেশ শক্ত অবস্থানে পৌছে যায়। ১৯৯০ সালের দিকে তারা সরাসরি রুয়ান্ডায় অভিযান শুরু করে দেয় এবং ১৯৯৩ সালে তারা রুয়ান্ডার সরকারের সাথে একটা শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হয়। তুতসিরা ফিরে আসে দেশে। শান্তিচুক্তির পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৪ সালের ৮ এপ্রিল তারিখে রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানা এবং বুরুন্ডির হুতু সম্প্রদায়ের প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমানকে অকস্মাৎ গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। এই আক্রমণে দুজনই মারা যান। হুতুরা দাবি করে RPF এর সন্ত্রাসীরাই এই আক্রমণে অংশ নিয়েছে। RKF এই দাবি নাকচ করে হুতুদের উপরই দায় চাপায়। এপ্রিলের এই ঘটনাটি তুতসিদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। রুয়ান্ডা অপেক্ষা করতে থাকে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার।
গণহত্যা শুরু
আগে থেকে থাকা বিদ্বেষের আগুনে এবার যেন জল ঢেলে দেওয়া হল। ক্ষেপে উঠল হুতুরা। সরকারের হাতে পৌছাল তুতসি সম্প্রদায়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের চেকলিস্ট। গড়ে তুলা হল খুনি মিলিশিয়া দল। পুরনো শত্রুতা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তুতসিদের এবার দেখে নেবে তারা। আক্রমণ প্রথমেই শুরু হয় তুতসি সরকারি কর্মকর্তাদের সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে। সে সময়ের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তাদের একটি নিজস্ব যুব মিলিশিয়া সেল গঠন করে হত্যাকাণ্ড সংঘটনের জন্য প্রস্তুত করে। সাধারণ মানুষদের অর্থ ও সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে গণহত্যায় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা হয়৷ পথে পথে ব্যারিকেড বসিয়ে বেছে বেছে তুতসিদের হত্যা করা হয়। স্থানীয় বিভিন্ন চরমপন্থী গ্রুপকে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয় তুতসিদের হত্যার জন্য।
বেশিরভাগ সময়ই ধারালো চাকু দিয়ে হত্যা কার্যক্রম চালানো হত৷ হুতুদের উদ্দেশ্য ছিল কোন তুতসিদের বাস রুয়ান্ডায় হবেনা। আর সেজন্য তারা শিশুদেরও হত্যা করে। বিশালসংখ্যক নারী পরিণত হয় হুতুদের যৌনদাসী হিসেবে। গণহত্যা চালানোর জন্য সরকার আরটিএলএম নামক একটি রেডিও স্থাপন করে। সেই রেডিওতে প্রকাশ্যে তুতসিদের ‘তেলাপোকা মারো’ বলে হত্যার ইংগিত দেয়া হত৷ সাধারণ হুতুদের বলা হল, তোমরা যদি তুতসিদের হত্যা করতে পারো তবে তাদের সম্পত্তি ভোগ করার সুযোগ পাবে৷ এই লোভে গণহত্যায় বিপুল সংখ্যক সাধারণ নাগরিকরাও সোল্লাসে মেতে থাকল। বাদ যায়নি গির্জার পুরোহিরতাও, ধর্মযাজক গণও হয়ে পড়ে খুনি। পথে প্রান্তরে পড়ে থাকতে লাগল নিরাপরাধ তুতসিদের লাশ। হুতুদের বাড়ির দেয়ালগুলোতে আলাদা করে লিখে দেয়া হল এই বাড়ির বাসিন্দারা হুতু। বাদবাকি বাড়িতে চলল হত্যাযজ্ঞ। বিশাল অংশ পালিয়ে যায় প্রতিবেশী কঙ্গো, উগান্ডা, বুরুন্ডিতে। ১০০ দিনের ব্যবধানে প্রাণ হারায় ৮ লাখ তুতসি রুয়ান্ডান। অবশেষে উগান্ডার সহায়তা নিয়ে ১৯৯৪ সালের ৪ জুলাই RPF এর সৈন্যরা রুয়ান্ডার দখল নেয়। হুতুরা পালিয়ে আশ্রয় নেয় গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে।
এই গণহত্যা নিয়ে অভিযোগ আছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংঘাত থামানোর চেষ্টা করেনি। জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়েও রয়েছে বিস্তর সমালোচনা। তৎকালীন RPF এর প্রধান ফ্রান্সকেও দায়ী করেছেন। ফ্রান্স এই দায় অস্বীকার করেছে।
এখন কেমন আছে রুয়ান্ডা?
গণহত্যার বীভৎস অভিজ্ঞতা পেরিয়ে রুয়ান্ডা এখন ধীরে ধীরে সমৃদ্ধির দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাদের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সেই RPF এর প্রধান কাগামে এখন সেখানে ব্যাপক জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট। তৃতীয়বারের মত ক্ষমতায় বসে এক নতুন রুয়ান্ডার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তিনি। তবে এখনো রুয়ান্ডাকে তাড়া করে বেড়ায় সেই দুঃস্বপ্ন। সাম্প্রদায়িক বিভেদকে বিদেয় করা এখনো সম্ভব হয়নি। সরকারের তরফ থেকে সম্প্রদায় নিয়ে অযথা কানাঘুঁষা করা বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। আশা করা যায় রুয়ান্ডায় আর কখনো সাম্প্রদায়িকতা হানাহানির উপজীব্য হবেনা।