অতীতে ইউরোপের অভিজাত বংশাবলী সারা ইউরোপে ছড়িয়ে ছিল। তাদের সম্বন্ধে লোক ঐতিহ্যে অতিমানবিক-অপ্রাকৃত বহু গল্প নানা শাখা প্রশাখায় সমগ্র ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । সেই সব গল্প কাহিনীর কিছু কিছু কালের প্রবাহে আজও বিলীন হয়ে যায়নি। প্রচলিত সেইসব গল্পকথা আজও এদিকে সেদিকে এখানে সেখানে কিছু কিছু শোনা যায়। গরমএন্ ষ্টনের সিনিষ্টার শীর্ষক পৌরাণিক কাহিনীটি তাদের মধ্যে হয়তো বিশিষ্টের দাবি রাখবে।
গরমেন্ষ্টনের কোন লর্ড যখনই মৃত্যুর সম্মুখীন হন আয়র্ল্যান্ডের কাউন্টি-মিথে দেখা যায় গরমেন্ষ্টন দুর্গটি তখনিই শত শত শেয়ালে পরিবেষ্টিত হয়ে উঠতো । স্থানীয় সকল লোকই এই পৌরাণিক কাহিনী সম্বন্ধে অবহিত ছিল। এই কাহিনীর সূত্রপাত হয়েছিল সম্ভবত ঃ সুদুর অতীতেই ।
১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে দ্বাদশ ভাইকাউন্টের মৃত্যুর দিন স্থানীয় একদল শিকারী শিকার শেষ করে ঘরে ফিরে আসে । সারাদিন শিকার অন্বেষণে ঘুরে ফিরে তারা কোথাও একটি শেয়ালের দেখা পায়নি । একজন শ্রমিক মত প্রকাশ করেন যে ,সব শেয়াল মহামতি লর্ডের মৃত্যু অবলোকন করতে চলে গেছে।
১৮৭৬ খৃষ্টাব্দে লেডী গরমেন্ষ্টন একদল শেয়ালকে দূর্গের প্রধান প্রবেশদ্বারের আশে পাশে ঘোরা ফেরা করতে দেখেন ।তাঁর স্বামী ত্রয়োদশ ভাইকাউন্ট সেই রাতেই মৃত্যুবরণ করেন। কয়েকদিন পরে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় একদল শেয়াল ভাইকাউন্টের শবাধার অনুসরণ করে সমাধিস্থল পর্যন্ত যায়।
১৯০৭ খৃষ্টাব্দে চতুর্দশ ভাইকাউন্টের যখন মৃত্যু হয় এবং তাকে যে স্থানে সমাধিস্থ করা হয় তার আশে পাশে একদল শেয়ালকে ঘোরা ফেরা করতে দেখা যায় ।
ওয়াইটশায়ারের অন্তর্গত ওয়ারডুবের আরুনডেল্রা নিজস্ব সিংবাদ দাতার মারফত মৃত্যুর সংবাদ পেতেন। পরিবারের কারোর মৃত্যুর আগের মুহূর্তে ওয়ারডুর দুর্গের প্রাচীর ছিদ্রে দুটি দর্শনীয় পেচকের আবির্ভাব ঘটত। হয়তো এই পেচক দুইটি আর কখন ফিরে আসবেনা-তার কারণ এই বংশের শেষ লর্ড আরুন্ডেলের মৃত্যু হয়েছে গত ১৯৪৪ খৃষ্টাব্দে ।তিনি কোন উত্তরাধিকারী রেখে যাননি ।তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার উপাধিটিও চিরতরে লুপ্ত হয়ে গেছে।
১৫৮৬ খৃষ্টাব্দে উইলিয়াম ক্যাম্পডেন নামে একজন ইংরেজ প্রাচীনদ্রব্য সংগ্রাহক চ্যাশায়ারের বারিন্টনদের সম্বন্ধে একটি প্রতিবেদন লিপিবদ্ধ করেন। তিনি বলেন আমি বহুদিন ধরে শুনে আসছিলাম যে বেরিনটনের কোন উত্তরাধিকারীর মৃত্যু সন্নিকটবর্তী হলে তাদের প্রাসাদ সন্নিহিত হ্রদে একটি বিরাট কাঠের গুঁড়ি ভেসে আসতে দেখা যায়।অনুসন্ধিৎসার ব্যাপার এই যে এই বেরিনটনদের কোন উত্তরাধিকারের মৃত্যুর আগেই এই গাছ ভেসে যেত।কখন ও কোন কর্তাব্যক্তির মৃত্যুকালে তা দেখা যেত না।
সেকালে ভৌতিক অশুভসূচক লক্ষণগুলোকে অতীতের মৃত পরিজনদের প্রেতাত্মা বলে সকলে বিশ্বাস করত। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে প্রুশিয়ার হোহেন জলার্নের শবেতবসনা সুন্দরীকে আরলামান্ডির কাউন্টেস এ্যাগনেসের প্রেতাত্মা বলে মনে করা হত। শিশু হত্যাকারী হিসাবে দেয়াল তুলে তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়।
অন্য একটি কিংবদন্তীতে বলা হয় তিনি ছিলেন রাজকুমারী বার্থাভন্ রোজেনবার্গ। তিনি যেই হোকনা কেন ,তার আবির্ভাব জানান দিয়ে যেত যে হোহেন জলার্নের কারুর মৃত্যু সন্নিকটবর্তী । প্রুশিয়ার চতুর্থ ফ্রেডারিক উইলিয়াম তার ছোট্ট জার্মান রাজ্যটিকে ইউরোপের বিরাট একটি রাজ্যে পরিণত করেন। ১৮৬১ খৃষ্টাব্দে ভীতিপ্রদ একটি দৃশ্য দেখে তিনি পাগল হয়ে যান।
মুণ্ডহীন শবাস্তরন বাহকঃ
দুর্গদ্বারের দ্বাররক্ষী একদিন দেখতে পেল সেই শ্বেতবাসনা সুন্দরীকে। চারজন মুণ্ডহীন শবাস্তরণবাহী একটি কফিন বয়ে নিয়ে চলেছে আর তাদের আগে আগে পথ দেখিয়ে এগিয়ে চলেছেন সেই শ্বেতবসনা সুন্দরী। তারা অতি ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে দুর্গের দিকে। দুর্গদ্বার দিয়ে ধীর পদক্ষেপে তারা ভেতরে ঢুকে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরে আবার তারা ফিরে এলো রাজপোশাক পরিহিত একটি মৃতদেহ বহন করে। মৃত দেহটি ছিল মস্তক বিহীন। আর আশ্চর্যের বিষয় এই, যে স্থানে মাথা থাকার কথা সেখানে বিরাজ করছে একটি রাজমুকুট ।রাজা এই বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখে সেই যে পাগল হয়েছিলেন তার থেকে তিনি আর ভাল হননি কোনদিন। রোগ তার ক্রমাগত খারাপের দিকেই এগিয়ে গেল। অবশেষে তার অবস্থার এমনই অবনতি ঘটলো যে পর বছর বর্ষশুরুতেই তার করুণ মৃত্যু হল। চতুর্থ উইলিয়ামের পিতা তৃতীয় উইলিয়ামের মৃত্যুর আগে এই সুন্দরীর আবির্ভাব জানান দিয়ে যায় যে তার মৃত্যু সন্নিকটবর্তী । বেইরুথের মারগ্রেভ নামে তাদের একজন পূর্বপুরুষ ১৬৭৮ খৃষ্টাব্দে নিজের মৃত্যুর আগ মুহূর্তে এই সুন্দরী মহিলাকে দেখতেপান।মারগ্রেভ তখন ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন। সুন্দরী তার দৃষ্টিগোচর হবার পরেই তার ঘোড়া তাকে পিঠ থেকে ফেলে দেয়। এই পতন তাকে মারাত্মক ভাবে আহত করে ও অল্পদিনের মধ্যে মৃত্যু এসে তাকে গ্রাস করে।
ব্যাভেরিয়ার রাজ পরিবার ও হেসের ডিউক পরিবার একত্রে একটি মৃত্যুর সাবধানবাণী অবহিত হন। এক রহস্যময় মহিলা কালো বস্ত্রে আচ্ছাদিত হয়ে এসে দেখা দিতেন। সুদুর অতীতে গ্রান্ড ডাচেস লেডী অব ডায়ামাষ্টাট্ একদা তার কালো পোশাক প্রীতির জন্য সুপরিচিতা ছিলেন। আর এই কালো পোশাক পরা রহস্যময়ীকে অতীতের সেই মৃত গ্র্যান্ড ডাচেসের ভূত বলেই মনে করা হত।
১৮৫০ খৃষ্টাব্দে আর্কাফেনবার্গে হেস ডারমাষ্টাটের গ্র্যান্ড ডিউক তার পিতা মাতার সঙ্গে চা পানে রত ছিলেন। অতর্কিতে ডিউক সেই কালো পোশাক পরিহিতা রমণীর ছায়া দেখতে পান। আর আশ্চর্য- কয়েক দিনের মধ্যেই কলেরায় তার মায়ের মৃত্যু হল।
এলবা নদীর তীরে ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দে পিলোনিজ দুর্গে স্যাকসনির রানী তাকে দেখতে পেলেন। তার দেহ কালো রঙের শোকের পোশাকে আবৃত ।তিনি একটি চেয়ারের আশে পাশে ঘোরা ফেরা করছিলেন।ঘরের সকলেই তার এই রহস্যময় আবির্ভাব অবলোকন করলো। রাণীর দঃখ ভরাক্রান্ত অনুচরেরা হৃদয়ঙ্গম করলো।এবার রাণীমার আর হয়তো রেহাই নেই, তার মৃত্যু অতি সন্নিকটবর্তী ! কিন্তু তাদের বুঝতে কিছুটা ভুল হয়েছিল। পরদিন তাদের কাছে অতর্কিতে সংবাদ এসে পৌছালো যে স্যাকসনির রাজা ড্রেসডেনে মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছেন।এ সংবাদের জন্য দুর্গের কেউই প্রস্তুত ছিলনা।
ভূতুরে বরজিয়াস:
রক্ত পিপাসু ব্র্জিয়াসদের বলা হত ভূতুরে পরিবার । এ বলা অবশ্যই অমূলক বা অন্যায় ছিল না। বহুল পরিচিত যে ঘটনাটির উল্লেখ এখানে করা হচ্ছে তা ঘটে ষষ্ঠ পোপ আলেকজান্ডারের উপর। তার নাম ছিল ‘নির্মম নিষ্ঠুর রড্রিগো বর্জিয়া’.১৫০৩ খৃষ্টাব্দে পোপের মন্ত্রীসভার একজন সভ্য একদিন পোপের কক্ষে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলেন পোপ মৃতদেহ বহন করবার শবযানে শুয়ে আছেন আর তার চারদিকে ভৌতিক আলো জ্বলছে। সেই দৃশ্য দেখে সেই সভ্য হতচকিত হয়ে পরলেন।ভীত চকিত হয়ে তিনি তাড়াতাড়ি বুকে ‘ক্রস’ চিহ আঁকলেন। তার পর লক্ষ্য করলেন দৃশ্যটি কেন যেন তার চোখের আড়ালে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। কিন্তু বিধাতার কি নির্মম পরিহাস! রাতের অন্ধকারের যে দৃশ্য তিনি দেখেছিলেন পরদিন মধ্য রাত্রির পূর্বেই তিনি বাস্তবেও সচক্ষে তা অবলোকন করেন।
পরদিন ঠিক মধ্যরাত্রির পূর্বেই পোপের মৃত্যু হয়। এবং পোপকে ঠিকই শাবধানে শায়িত করা অবস্থায় দেখতে পান।