কৃষ্ণদৈপায়ন ব্যাসের রচিত মহাভারত এক অত্যাশ্চর্য এবং প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের সর্ব বৃহৎ গ্রন্থ। শাস্ত্র বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কালসীমা খ্রী. পূ. ৩০০০ অব্দের আশপাশে (যদিও মতান্তর আছে)। তার কিছুকাল পর মহাভারত রচিত হয়। মহাভারত গল্প যেকোনো আধুনিক গল্পের প্লটকে হার মানায়। সকল চরিত্র নিজগুণে সমৃদ্ধ। দেবতাকুল ও নরকুলের স্বচ্ছন্দ সংযোগ স্থাপন, রাজা মহারাজার রাজ্য, বৈধ্য ও অবৈধ পারিবারিক বিস্তৃতি, কামনা – বাসনা, অস্ত্র পরিচালনার রীতি নীতি কোনোকিছুই সহজ বোধগম্য নয়।
মহাভারতে অনেক নারী চরিত্রই সেই সময়ের তুলনায় অনেক আধুনিকা ছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম সত্যবতী। সত্যবতী চেদীরাজ উপরিচর বসু এবং অদ্রিকার (মৎস্যরুপিনী অপ্সরা) কন্যা। সত্যবতীর গায়ে বিকট মাছের গন্ধ থাকায়, তিনি ‘মৎসগন্ধা’ নামেও পরিচিত। একসময় দাশ নামক এক জেলের জালে অদ্রিকা ধরা পরেন এবং তার গর্ভ থেকে তিনি দুটি সন্তান পায়। এক ছেলে( মৎস্যরাজ, মৎস্যরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা), ও এক মেয়ে সত্যবতী। পরবর্তীকালে সত্যবতী যমুনার বুকে নৌ বহন ও জেলেনীর কাজ করতে থাকেন।
একদিন ঋষি পরাশর সত্যবতীর নৌকায় উঠে তাঁর অমোঘ সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে মিলন প্রার্থনা করেন। সেযুগে নারী পুরুষ উভয়েই নিজেদের বাসনা নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করতেন। কুমারী এবং লজ্জিত সত্যবতী বলেন তাঁর কৌমার্য নষ্ট হলে সমাজ তাঁকে ত্যাগ করবে। তিনি দিনের আলোয় নদীবক্ষে মিলনেও অরাজী হন। উপরন্তু তাঁর দেহে মৎসের দুর্গন্ধ। সত্যবতী আদতেই বুদ্ধিমতী এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। পরাশর তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেন তাঁর পূত্রলাভ তাঁকে কুমারিত্ব ফিরিয়ে দেবে। তিনি চারিদিকে কুয়াশার সৃষ্টি করেন, সত্যবতীর শরীরে মৃগনাভির সৌরভ প্রদান করে মিলন অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেন। তিনি এই কারণে ‘যোজন গন্ধা (এক যোজন দুর থেকে তার গন্ধ পাওয়া যেত)’ নামে পরিচিত। পরাশর মুনীর ঔরসে ব্যাসদেবের জন্ম হয়। তাঁকে দ্বৈপায়ন (দ্বীপে জন্ম) বলেও জানা যেত। সত্যবতীর কানীন অর্থাৎ কুমারীর গর্ভজাত পুত্র।
হস্তিনাপুরের কুরুরাজ শান্তনু যমুনা তীরে মৃগয়া করতে গেলে মৃহনাভির গন্ধে বিভোর হন। তিনি দাশ রাজের কাছে সত্যবতীর বিবাহ প্রস্তাব দেন। দাশ রাজা শর্ত হিসেবে কন্যার গর্ভজাত পুত্রদের রাজা হিসেবে দেখতে চান। শান্তনু ততোধিক বিমর্ষ হয়ে ফিরে এলেন রাজ্যে যেহেতু পূর্বেই তিনি তাঁর ও গঙ্গার পুত্র দেবব্রতকে যুবরাজ হিসেবে অভিষেক করেছিলেন। দেবব্রত তাঁর পিতার যন্ত্রণার কথা শুনে দাশরাজার কাছে যান এবং আজীবন ব্রহ্মচর্য পালনের প্রতিজ্ঞা করেন। তাঁর ভীষণ প্রতিজ্ঞার জন্য তাঁকে ভীষ্ম (পিতামহ ভীষ্ম) বলা হয়। শান্তনু খুশি হয়ে ভীষ্মকে ইচ্ছামৃত্যু বর প্রদান করেন। সত্যবতী ও রাজা শান্তনুর দুই পুত্রের জন্ম হয়। চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। শান্তনুর মৃত্যুর পর চিত্রাঙ্গদ সিংহাসনে বসেন, তবে অল্পকালেই গন্ধর্বের সাথে যুদ্ধে নিহত হন। এরপর বিচিত্রবীর্যের রাজ্যভিশেক হয় এবং ভীষ্ম কাশীরাজের তিন কন্যাকে সয়ম্বর সভা থেকে অপহরন করেন। দুই কন্যা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে বিচিত্রবীর্যের সাথে বিবাহ দেন। বিচিত্রবীর্য দুই বধূর সঙ্গেই অমিত যৌনাচারের ফলে দুর্বল হওযায় যক্ষ্মা রোগে মৃত্যু ঘটে। তিনিও উত্তরাধিকার না রেখেই মারা যান। সত্যবতী উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন, সিংহাসন এদিকে খালি পড়ে আছে। তিনি যখন তাঁর কানীন পুত্রের কথা ভীষ্ম কে জানান, ভীষ্ম বলেন ‘ যে লোক কাজ করার পূর্বে ধর্ম, অর্থ, কাম এই ৩টির কথা ভাবেন তিনি বুদ্ধিমান। আপনি আপনার পুত্রকে স্মরণ করুন।’ এমতবস্থায় তিনি তাঁর প্রথম পুত্র, ব্যাসদেবকে সকলের সামনে আনেন। সত্যবতীর আদেশে ব্যাস তাঁর ভাত্রীবধুদের গর্ভে ক্ষেত্রজ পুত্র স্থাপন করেন। ব্যাসদেব ছিলেন অত্যন্ত কদাকার,অম্বিকা অম্বলিকা ত্রস্ত হয়ে অত্যন্ত বিতৃষ্ণায় ব্যাসের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। অম্বিকা চোখ বুজে মিলিত হন এবং অম্বালীকা ভয়ে পান্ডু(ফ্যাকাশে) হন। জন্ম হয় জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের(অম্বিকা) ও পান্ডুবর্ণ পুত্র পান্ডুর(অম্বালিকা)। সত্যবতী বয়েস কালে বনে তপস্যা করে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। সত্যবতীর অসীম সাহসিকতা, রাজ্য রক্ষায় তাৎক্ষণিক বিবেচনা মহাভারতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আর বেদব্যাস আমাদের উপহার দিয়েছেন এই মহাকাব্য।