যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানের হাত ধরে ১৯৪৭ সালে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এক্ট অফ ১৯৪৭ এর অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্সি এজেন্সি। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে বিভিন্ন প্রকাশ্য ও গোপন অপারেশন করে আসছে। দেশে ও দেশের বাইরে অজস্র গোপন মিশন কখনো খুব সূক্ষ্মভাবে সম্পন্ন করতে পারলেও অনেক সময় বিভিন্ন অপারেশন ফাঁস হয়ে পড়ে। যা প্রতিষ্ঠানটিকে ও দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। সিআইএর এমনই কিছু চাঞ্চল্যকর মিশন নিয়েই সাজানো হয়েছে এই লেখাটি।
অপারেশন ফিনিক্স প্রোগ্রাম
সিআইএ এর চালানো অপারেশন গুলোর মধ্যে অপারেশন ফিনিক্স প্রোগ্রাম অন্যতম। স্নায়ুযুদ্ধ কালীন ডমিনো তত্ত্বে ( কোন রাষ্ট্র কমিউনিস্ট বলয়ে ঢুকে পড়লে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোও কমিউনিস্ট প্রভাবের আওতায় পড়ে যাবে) ভীত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট শাসনকে ঠেকিয়ে দেয়া। আদর্শবাদী এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনীর সব শক্তি নিয়োগ করে। বরাবরের মত এ যুদ্ধেও আমেরিকার তুরুপের তাস ছিল সিআইএ বা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্সি এজেন্সি। ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অব সাউথ ভিয়েতনাম বা ভিয়েত কং নামের কমিউনিস্ট গেরিলা বাহিনীকে ধ্বংস করতে এ সময় যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রজেক্ট হাতে নেয়। আর এই প্রজেক্টের দায়িত্ব দেয়া হয় সি আইএকে। ভিয়েত কং ছিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের সশস্ত্র গেরিলা বাহিনী। তবে তারা কাজ করতো উত্তর ভিয়েতনামের হয়ে। কমিউনিস্ট বিরোধী দক্ষিণ ভিয়েতনামে স্যাবোটেজ করা ছিল এই বাহিনীর উদ্দেশ্য। আর এদের রুখে দিতে সিআইএ শুরু করে এক গোপন প্রজেক্ট, ফিনিক্স প্রোগ্রাম। সি আই এর সাথে অস্ট্রেলিয়ান, আমেরিকান ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের সামরিক বাহিনীও অংশ নেয়।
এ অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল ভিয়েত কং এর
রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করা, তাদেরকে গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া কিংবা হত্যা করা। তাদের এই নীলনকশা অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু হয়। ভিয়েতনামের প্রধান বিপ্লবীদের কে টার্গেট করে করে গ্রেপ্তার বা গুম করা শুরু হয়। তারপর তাদের থেকে তথ্য সংগ্রহ ও বিপ্লব পরিকল্পনার বিরোধী অভিযান চালানোর নাম করে বিপ্লবীদের উপর চালানো হয় বর্বর অত্যাচার। তাদের এই অত্যাচারের ধরন সমুহ ছিল -জিহ্বা ও অন্যান্য স্পর্শকাতর অঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেয়া, মাথা নিচের দিকে করে বারবার পানিতে ডুবানো, দুই হাত পেছনে দিয়ে বেঁধে সিলিংয়ের সাথে ঝুলিয়ে রেখে পেটানো, হাত-পা বেঁধে বন্দীর উপর আক্রমণাত্মক কুকুর ছেড়ে দেয়া, দিনের পর দিন আটকে রেখে অনাহারে হত্যা করা, কানের মধ্য দিয়ে সরু রড, কাঠ বা এ জাতীয় কিছু প্রবেশ করিয়ে হত্যা করা।
এগুলো ছাড়াও তারা হত্যা, গণহত্যা, গণধর্ষনের মত জঘন্যতম কার্যক্রম চালাতে থাকে খোদ ভিয়েতনামের মাটিতেই। তাদের এই ন্যাক্কারজনক অপারেশন ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত চালানো হয়। অর্থাৎ যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরও ভিয়েতনামে তাদের এই মিশন অব্যাহত থাকে। প্রায় ৮১ হাজার ভিয়েত কং সদস্যদের তারা গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে ২৬ হাজার সদস্যকে তারা হত্যা করে। ভিয়েত কং দমনের নামে অনেক বেসামরিক নাগরিককেও হত্যা করে আমেরিকান সৈন্যরা। ফলে এই অপারেশন নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে। তবে এর আগেই ভিয়েত কং কে দমন করতে সমর্থ হয় সিআইএ।
নকল টিকাদান কর্মসূচি
এটি ছিল আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেন কে খুঁজে বের করার একটি গোপন পরিকল্পনা। এই অভিনব মিশনটি সিআইএ পরিচালনা করে পাকিস্তানের মাটিতে। ২০১০ সালে পাকিস্তানের এবোটাবাদে একটি ভুয়া হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিনের কার্যক্রম শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। উদ্দেশ্য ছিল রক্তের নমুনা নিয়ে ডিএনএ শনাক্তের মাধ্যমে ঐ এলাকায় আসলেই বিন লাদেন আছেন কিনা তার হদিস বের করা। খবরটি ফাঁস হয়ে গেলে পাকিস্তানে টিকা গ্রহণ নিয়ে বেশ কিছু ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিস্তার ঘটে। প্রচার হয় যে, ভ্যাকসিনেশন আসলে পশ্চিমাদের গোপন মিশন যা দেশের জনগণকে দুর্বল করে দেয়ার জন্য পরিচালিত হয়। তালেবান ভ্যাকসিন গ্রহণ না করার জন্য একটি ফতোয়াও জারি করে। ২০১৩ সালে চাপের মুখে সি আই এ গোয়েন্দা কাজে ভ্যাকসিন ব্যবহারের নীতি থেকে ফিরে আসে।
এই অপারেশন পরিচালনার পূর্বে খাইবার প্রদেশের শাকিল আফ্রিদি নামক এক চিকিৎসককে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সিআইএ ভাড়া করে । ফলে তিনি সিআইএ এর নির্দেশমত টিকা কর্মসূচির নাম করে এবোটাবাদের অসংখ্য শিশুর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেন। উদ্দেশ্য ছিল এসব শিশুর ডিএনএ এর সাথে ওসামা বিন লাদেনের ডিএনএ মিলানো। তবে এই পরিকল্পনায় তারা পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। ওসামা বিন লাদেন মারা যাবার পর সিআইএ এর এই জাল টিকাদানের কথা প্রকাশিত হয়ে যায়। ফলে শাকিল আফ্রিদি কে গ্রেপ্তার করা হয় এবং সিআইএ এর সাথে যোগাযোগ রেখে দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের অভিযোগে তাকে ৩০ বছরের সাজা দেয়া হয়। এই ঘটনার পর থেকে পাকিস্তানি সাধারণ মানুষ তাদের বাচ্চাদের টিকাদান কর্মসূচি তে যুক্ত করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
অপারেশন মারলিন
এটি ছিল ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের বিরুদ্ধে সি আইএ এর একটি গোপন ষড়যন্ত্রমুলক অপারেশন। ইরান যখন তাদের পারমাণবিক প্রকল্পের কাজ শুরু করে, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিল ক্লিনটন৷ আর তার পরামর্শেই সি আইএ এই পরিকল্পনায় হাত দেয়। আর অপারেশনটির প্রয়োগ করে বুশ প্রশাসন।
তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা এমন একটি এজেন্ডা হাতে নেয় যে, ইরানী বিজ্ঞানীদের হাতে একটি ভুল পারমাণবিক মডেল তুলে দেয়া হবে যার ফলে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প কে নিজ থেকেই ধ্বংস করবেন ইরানের বিজ্ঞানীরা। তারা তাদের এই অপারেশন সফল করার জন্য একজন রাশিয়ান পারমাণবিক বিজ্ঞানী কে নিয়োগ দেয় যিনি ইতিমধ্যে নিজ দেশ ত্যাগ করে এসেছেন। ১৯৯৬ সাল থেকেই ঐ রাশিয়ান বিজ্ঞানীর সাথে যোগাযোগ করে আসছিল সিআইএ। ২০০০ সালের মার্চ মাসে এই ভুল পারমাণবিক অস্ত্রের ডিজাইন ইরানে পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। তারা সেই রুশ বিজ্ঞানীকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত রেখে দেয়। উদ্দেশ্য ছিল অন্য কোন দেশে একইভাবে স্যাবোটেজ করা। কিন্তু অপারেশন মার্লিন ব্যর্থ হয়। ইরানি বিজ্ঞানীরা ভুল ডিজাইন ধরে ফেলে। এই গোপন অপারেশনের কথা ফাঁস করেছিলেন সি আইএর’ই এক কর্মকর্তা। জেফ্রি স্টার্লিন নামের এই হুইসেলব্লোয়ার নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক জেমস রিসেনের কাছে এই তথ্য ফাঁস করে দেন। জেমস রিসেনের বই state of war এ পুরো ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়।
অপারেশন মকিংবার্ড
স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন মার্কিনপন্থী পুঁজিবাদী জোট ও সোভিয়েত পন্থী কমিউনিজম জোটের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। এই প্রতিযোগিতার দৌড়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর মধ্যে অন্যতম একটি গোপন প্রকল্প ছিল অপারেশন মকিংবার্ড। যেটি সি আইএ কর্তৃক পরিচালিত হয়। তাদের মূল এজেন্ডা ছিল সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের পিছনে বিনিয়োগ করে কমিউনিজম বিরোধী প্রোপাগান্ডা ছড়ানো এবং গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের পক্ষে ইতিবাচক প্রচারনার মাধ্যমে মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য করে তোলা। এজন্য প্রায় ২৫ টি সংবাদপত্র ও সংবাদসংস্থার পেছনে বিপুল
অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। ঘুষ ও লবি নিয়োগের জন্যই এর সিংহভাগ অর্থ লগ্নি করা হয়। এই অর্থ ব্যয়ের বার্ষিক পরিমান ছিল প্রায় ২৩৫ মিলিয়ন। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে তাদের এই অপারেশন চলতে থাকে। এই দীর্ঘ সময়ে সি আইএ এর হাত দিয়েই প্রায় ৩ বিলিয়ন খরচ হয় । সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর তাদের এই গোপন অপারেশন আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়।
অপারেশন কাওয়াস
এটি ছিল সি আইএ এর নিজ দেশে চালানো অন্যতম একটি গোপন অপারেশন। ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এই অপারেশন পরিচালনা করা হয়। এই অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যুদ্ধবিরোধী, বর্ণবাদী বিরোধী আন্দোলনে বৈদেশিক প্রভাব জড়িত আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা। আর এ কাজে টার্গেট করা হয় ছাত্র ও তরুণদের সমন্বয়ে গড়া বিভিন্ন সংগঠনকে। প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনের আমলে শুরু হওয়া এই বিশেষ অপারেশন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনও অব্যাহত রাখেন। তাদের সাত বছরব্যাপী চালানো এই অভিযানে এক হাজার সংগঠনের প্রায় ৩ লক্ষ নেতা কর্মীর বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়। এই সময়ে প্রায় সাত হাজার নেতা কর্মীর তালিকা করা হয় যাদের কে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাছাড়া অসংখ্য নেতা কর্মীকে গ্রেপ্তার করে তাদের গোপন আস্তানায় নিয়ে জিজ্ঞেসবাদ করা হয় এবং অনেক কে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেলে পাঠানো হয়। তাছাড়া অনেককে নির্যাতন করে হত্যাও করা হয়। এই হত্যার সংখ্যা ডজন খানেক ছাড়িয়ে গেছে বলে অনেকে মনে করেন। গোপন এই অপারেশনটি নিউইয়র্ক টাইমসে ফাঁস হয়ে যায়।
তথ্যসূত্র
Former CIA officer convicted for exposing Operation Merlin
CIA organised fake vaccination drive to get Osama bin Laden’s family DNA