২৫শে মার্চ, ১৯৭১। সারাদিনই তুমুল উত্তেজনা চলেছে। সবাই জেনে গেছে মুজিব-ভুট্টো-ইয়াহিয়ার আলোচনা ভেস্তে গেছে। সন্ধ্যায় ইয়াহিয়ার ভাষণ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু শোনা গেলো বিকেল বেলায় তিনি তড়িঘড়ি করে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। পুরো শহরের অবস্থা থমথমে। শহরের জায়গায় জায়গায় গাছের গুঁড়ি আর পাইপ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়েছে ছাত্র-জনতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, জনসাধারণের ওপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আক্রমণ চলতে থাকলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।
ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের সংবাদদাতা রবার্ট ক্যায়লর এই সব খবরাখবরের একটা রিপোর্ট তৈরি করে যখন নিজ কক্ষ থেকে নেমে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের লবিতে এসে দাঁড়িয়েছেন তখন ঘড়ির কাঁটা ১১টা ছুঁয়েছে। টেলিগ্রাফ অফিসে যাওয়া দরকার- একটা টেলিগ্রাম করতে হবে। অফিস দূর আছে, সেই সেক্রেটারিয়েট রোডের শেষপ্রান্তে। ট্যাক্সি ছাড়া যাওয়া মুশকিল। কিন্তু হোটেলে ঢুকবার দরজায় বেশ জটলা। অন্যান্য সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধিদের সেখানে দেখা যাচ্ছে। মার্চের প্রায় শুরু থেকেই তাঁরা এ শহরে আছে। ক্যায়লর এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। কোথা থেকে যেনো একটা ব্ল্যাকবোর্ড এনে সেখানে বসানো হয়েছে, চক দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা “Please do not go outside.” বাইরে তাকিয়ে ক্যায়লর চমকে উঠলেন; যুদ্ধের সাজে, অস্ত্র হাতে হেলমেট পরা সৈন্যের দল টহল দিচ্ছে। এর মধ্যে দু’চারজন যারা বাইরে বের হবার চেষ্টা করেছিলেন তাদের সবাইকে জোর করে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে সৈন্যরা। সৈন্যদের ক্যাপ্টেন ধমক দিয়ে বলেছেন বাইরে গেলেই গুলি করা হবে। ক্যায়লর চমকে উঠলেন এ কথায়। তবে কি ঢাকাও ভিয়েতনামের মত নির্মম গণহত্যার শিকার হতে চলেছে! মাত্র তিন বছর আগে ভিয়েতনামের হুয়েতে তিনি নিজে প্রত্যক্ষ করেছিলেন সেই বীভৎস ঘটনা।
প্রাথমিক একটা ধারণা হল- যেহেতু ভুট্টো সেই হোটেলেই অবস্থান করছেন, হয়তো তার জন্যই এই অতিরিক্ত কড়াকড়ি আর সৈন্য মোতায়েন হয়েছে। কিন্তু ভুল ভাঙল কিছুক্ষণের ভেতরেই। সারা শহরেই নাকি সৈন্য নেমেছে। ব্যারিকেড ঠেলে তারা এগিয়ে চলেছে। কয়েকজন ব্রিটিশ কূটনীতিক একটা অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফিরছিলেন। সৈন্যরা কূটনীতিকদের জোর করে হোটেলে নিয়ে এসেছে। রাত ১২টার পর কক্ষে ফিরে জানালা দিয়ে দেখলেন সামরিক বাহিনীর বহর হোটেলের পাশের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। কয়েকটা টেলিফোন করলেন পরিচিতদের; জানলেন অন্য সংবাদদাতারাও সবাই আটকে পড়েছেন। রাত ১টার পর চারদিক থেকে মেশিনগানের গুলির আওয়াজ আসতে থাকল। দরজা জানালা সব বন্ধ; কিন্তু গুলির শব্দে কান পাতা দায়। টেলিফোনটাও অকেজো হয়ে গেল। রাত ৩টার দিকে একদল সৈন্য রাস্তার উল্টোপাশের ‘দি পিপল’ পত্রিকা অফিসে রকেট ছুড়ে আগুন লাগিয়ে দিল, সাথে চলল গুলি। গুলির বিকট শব্দ ছাপিয়ে ক্যায়লরের কানে পৌঁছুল পত্রিকা অফিসে আটকে পড়া মানুষের আর্তচিৎকার।
ভোর হতে গুলির শব্দ কিছুটা কমে এলো। রাস্তায় কোনো মানুষের দেখা পাওয়া গেল না। শুধু কিছু জিপ আর ট্যাংক দেখা গেল। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি দীর্ঘ হয়ে তখন আকাশ ছুঁয়েছে। ছাত্রদের ওপর পাকিস্তানী সামরিক শাসকেরা বরাবরই ক্ষিপ্ত। তবে কি হলগুলোতে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে! রেডিওর খবর ইয়াহিয়ার পশ্চিম পাকিস্তান ফিরে যাওয়ার খবর নিশ্চিত করল। হোটেলের বাইরে যাওয়ার কোনো অনুমতি মিলল না। ২৬শে মার্চ বিকেল নাগাদ শহরের দক্ষিণ দিক থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা গেল। সন্ধ্যা নামতে বুঝা গেল পুরান ঢাকা জ্বলছে।
রাত সোয়া ৮টায় জানা গেল ক্যায়লর সহ হোটেলের ২৫জন পশ্চিমা সংবাদদাতাকে সরকারি ব্যবস্থায় করাচি সরিয়ে নেয়া হবে। জিপে উঠে বসলেন ক্যায়লর, পেছনে অস্ত্র বহনের জায়গাতে থাকল তার স্যুটকেস। জিপ ছুটে চলল তেজগাঁও বিমানবন্দরের দিকে, পেছনে পড়ে রইল অন্ধকার, নিশ্চুপ, ভৌতিক এক শহর। মাত্র গতকালই যে শহরটা ছিল মিছিলে মুখর, সে শহরে আজ কোনো প্রাণের দেখা পাওয়া গেল না। বোয়িং ৭০৭ এ চেপে ক্যায়লর করাচি পৌঁছুলেন পরদিন দুপুরে। পাকিস্তানি বিমানের ভারতের আকাশসীমায় প্রবেশ নিষেধ, তাই শ্রীলঙ্কা ঘুরে করাচি যেতে হয়েছে। ঢাকায় একবার কাস্টমস তল্লাশি হয়েছিল, করাচি নেমে আবারও হল। ক্যায়লরের সাথের নোটবই, স্যুটকেসে রাখা খবরের কাগজের কাটিং আর ১৪টা অব্যবহৃত ছবির রিল এসব তো রাখলই, স্ত্রীর লেখা চিঠিগুলোও বাদ গেল না। সবকিছু জব্দ করবার পর ন্যুনতম একটা রিসিপ্ট দেবারও প্রয়োজন তারা বোধ করল না। জরুরী সবকিছু হারিয়ে একদম ভেঙে গেল মনটা।
মার্চের ২৭ তারিখ রাতেই করাচি বিমানবন্দর থেকে বোম্বের উদ্দেশ্যে বিমানে চাপলেন ক্যায়লর। বিমানের সিটে বসে প্যান্টের পেছনের পকেটে হাত দিতেই চমকে উঠলেন। নাহ, সব কিছু হারিয়ে যায়নি! ঢাকায় একটা ছোট্ট রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন। সেটাই প্যান্টের পেছনের পকেটে সবার অগোচরে রয়ে গেছে। বডি সার্চেও ধরা পড়েনি। তাঁর ভাষায়- “I catch my flight to Bombay and consider myself lucky that although I have lost my notebooks and I still have a story which I wrote before leaving Dacca in my hip pocket.”
রবার্ট ক্যায়লরের সেই রিপোর্টটা ১৯৭১ এর ২৯শে মার্চ সিঙ্গাপুরের নিউ ন্যাশন (বর্তমানে বিলুপ্ত) পত্রিকায় ছাপা হয়। শিরোনাম – Pressman’s Diary of Dacca Events: Shooting, fires and confusion in the city. পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কাপুরুষোচিত আক্রমণের কথা পৌঁছে যায় বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
আর ততক্ষণে কারফিউ, হত্যা আর আগুন ঠেলে একটু একটু করে উঠে দাঁড়াচ্ছে বিশ্বের নবীনতম দেশ –বাংলাদেশ।
ছবিঃ
১. ১৯৭১ সালে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, ঢাকা
২. ২০১৮ সালে তোলা আলোকচিত্রে রবার্ট ক্যায়লর, এবং
৩. সিঙ্গাপুরের নিউ ন্যাশন পত্রিকায় ১৯৭১ সালে প্রকাশিত ক্যায়লরের প্রতিবেদন।
সহায়ক সূত্রঃ
১. রুমীর আম্মা ও অন্যান্য প্রবন্ধ- সরদার ফজলুল করিম, সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৮৯
২. একাত্তরের ঢাকা- সেলিনা হোসেন, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ১৯৮৯।