১৯৪৭ সালে রানী ভিক্টোরিয়ার নাতি লর্ড মাউন্টব্যাটেন যখন ভাইসরয় হয়ে ভারতে আসেন, তখন সেখানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেরের অন্তিম অবস্থা চলছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও শুরু হয়েছে। কংগ্রেস প্রথম থেকেই অখন্ড ভারতের স্বাধীনতার দাবিতে অটল ছিলো। মুসলিম লীগ, ভারতীয় মুসলমানদের আলাদা এক রাষ্ট্র পাকিস্তানের দাবি থেকে সরে দাঁড়াতে প্রস্তুত নয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর এর ফলে উদ্ভুত সব সমস্যা এড়াতে মাউন্টব্যাটেন তাই দ্বারস্থ হচ্ছিলেন ভারতীয় রাজনীতিবিদদের কাছে। জিন্নাহ মাউন্টব্যাটেনকে সরাসরি প্রস্তাব দিলেন দেশ ভাগের। কিন্তু এই ভাগের আগে অ্যানেস্থেশিয়া দিয়ে রোগীকে অজ্ঞান করাতে হবে, তা জিন্নাহকে মাউন্টব্যাটেনকে জানান। ভারত ভাগ নিয়ে তাড়াহুড়া করার প্রথম সংকেত পাওয়া যায় ১৯৪৭ এর ১২ জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে জওহরলাল নেহেরুর পাঠানো চিঠিতে।
মাউন্টব্যাটেন ভারতবাসীকে অ্যানেস্থেশিয়া দেবার জন্য সিরিল র্যাডক্লিফকে ভারতবর্ষে নিয়ে আসেন। তিনি ব্রিটেনের চ্যান্সারি বারের দক্ষ আইনজীবী ছিলেন।
আইনের বাইরে অভিজ্ঞতা বলতে তার ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের তথ্য মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে কাজ করা। র্যাডক্লিফকে সীমান্ত নির্ধারণ কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিতে তার নাম সুপারিশ করেন লর্ড লিস্টোওয়েল। এতো বড় দেশভাগের দায়িত্ব একা এক তার কাঁধে দেওয়া ঠিক হবে কিনা, তা নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিলেন মাউন্টব্যাটেন। তবে এই ব্যাপারে জিন্নাহ তাকে পরামর্শ দেন, একজন চেয়ারম্যান হলে তিনি সঠিকভাবে দুই সীমান্তের লাভ-ক্ষতির ব্যাপারটি বুঝতে পারবেন এবং ঠিকমতো সমাধানও দিতে পারবেন। ৪০ কোটি মানুষের এই ভারতবর্ষকে ভাগ করতে মাত্র পাঁচ সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছিল এই আইনজীবীকে। বিশাল ভারতের ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কে দূরে থাক, যে দেশকে কেটেকুটে দুভাগে ভাগ করার জন্য তাকে দেওয়া হলো, তার সঠিক মানচিত্রটিও তিনি পেলেন না।
সিরিল র্যাডক্লিফের ব্রিটেনে আইনি সাফল্য আর খ্যাতি ছিলো অনেক। কিন্তু ভারতের ব্যাপারে আগ্রহ কিংবা অভিজ্ঞতা কোনোটাই ছিলো না এই আইনজীবীর। বহু বছরের পুরাতন সেই মানচিত্রের সামনে বসে ধর্মকে সামনে রেখে লাইন টানা শুরু করলে যে মানবিক বিপর্যয় আসতে পারে এই ব্যাপারে ন্যূনতম কোনো ধারণাও ছিলো না। র্যাডক্লিফ লাইনের ফলে সৃষ্টি হয় হাজারো সমস্যা। বিবিসির এক ডকুমেন্টারিতে তো তাকে নিয়ে এটা অনেকটা মজা করেই বলা হয়েছে
৫ সপ্তাহ সময়ে নির্ধারিত সীমান্তই কাল হয়ে দাঁড়ায় ভারতের ৪০ কোটি মানুষের জন্য। নেহেরুর ধারণা ছিলো, সীমান্ত নিয়ে গড়িমসি করতে করতে ব্রিটিশরা আবার না ঘাড়ে চেপে বসে। সীমান্ত কমিশন যত তাড়াতাড়ি রিপোর্ট দেবে, তত তাড়াতাড়ি ব্রিটিশদের হাত থেকে ক্ষমতা ভারতীয়দের হাতে চলে আসবে। হাজার বছর ধরে বসবাস করা মানুষগুলো যে সীমান্তের বেড়াজালে আটকে হঠাৎ করেই পর হয়ে যাবে, হয়তো সেটা বুঝতে ভুল করে ফেলেছিলেন কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের বাঘা বাঘা সব নেতারা। ১৯৪৭ সালের ১২ আগস্ট সিরিল র্যাডক্লিফ তার রিপোর্ট তৈরি করে ঘোষণা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু মাউন্টব্যাটেন তা পিছিয়ে দিলেন। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলো, ১৫ আগস্ট ভারতের হাতে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, দুই দেশের মানুষ যখন স্বাধীনতার জন্য উল্লাস করছে, তারা তখনো জানে না কোথায় তাদের সীমান্ত শেষ আর কোথায় তার শুরু।
১৭ ই আগষ্ট প্রকাশিত হলো র্যাডক্লিফের সীমান্ত কমিশনের রিপোর্টের গেজেটেড কপি। ভারতভাগের আসল ভয়াবহতার শুরু সেদিন থেকেই। ধীরে ধীরে সারা ভারত জুড়ে ভাগ শুরু হয়ে গেলো। সরকারি গেজেট থেকে জেলা-থানা থেকে গ্রাম অবধি সেই সীমান্ত কমিশনের রিপোর্ট যেতে শুরু করলো, ততই যেন সাধারণ মানুষের হাহাকার বাড়তে লাগলো। সিএননের ভিডিওচিত্রে উঠে এসেছে লাখো মানুষের এই স্থানান্তরের খন্ডচিত্র।
নিজেদের ঘরবাড়ি, যথাসর্বস্ব , জমিজমার উপর দিয়ে যেন র্যাডক্লিফ লাইনের স্টীম রোলার চালিয়ে গেলেন। সীমান্ত এলাকা আর তার দুপাশে শত শত জায়গায় ছড়িয়ে পড়লো ধর্মীয় সহিংসতা, সে সময় ৫ থেকে ১০ লাখ মানুষ মারা যাবার কারন র্যাডক্লিফের টানা লাইন। তাড়াহুড়োর কারনে সীমান্তে এতো মানুষের মৃত্যু হতে পারে, ব্যাপারটি হয়তো র্যাডক্লিফের ধারনায় ছিলোনা, আবার ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের জনসংখ্যার সঠিক ভাগ নিয়ে ধারণা না থাকায় এতো বিপুল পরিমাণ মানুষ যে ঘরবাড়ি বিচ্যুত হতে পারে, তা কল্পনার বাইরেই থেকে যায় সীমান্ত কমিশনের।
১৪ আর ১৫ আগস্ট স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা হওয়ার আনন্দে অচেতন হয়ে যাওয়া পুরো ভারতবাসীর যন্ত্রণা বাড়তেই থাকে। জায়গাজমি ও বসতভিটা রেখে হিন্দু এবং শিখ ধর্মাবলম্বীরা পাড়ি জমান ভারতে আর মুসলমানেরা পাকিস্তানে। পাঞ্জাব, বাংলা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, কাশ্মীর সহ র্যাডক্লিফ লাইনের আশেপাশের এলাকাগুলোতে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। শুধু ব্রিটিশ হিসেব অনুযায়ী, ভারত জুড়ে তখন ৬০০ শরণার্থী শিবির গড়ে ওঠে। এই শিবিরগুলোতে মানুষেরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাবার সময় কিংবা নতুন দেশে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর এই স্থানান্তরের সময় কম করে হলেও সত্তুর হাজার নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এসময় অনেক ধর্মীয় আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো।
সদ্য স্বাধীন হওয়া দু দেশের মধ্যে ক্রমেই তিক্ততা বাড়তে থাকে। জম্মু কাশ্মীর নিয়ে স্বাধীন হওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় ভারত আর পাকিস্তানের। ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর শুরু হওয়া যুদ্ধ চলে ১ জানুয়ারি ১৯৪৯ পর্যন্ত। ১৯৬৫ আর ১৯৯৯ সালে কাশ্মীরের কারগিলে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে। স্বাধীনতার এতো বছর পরেও সমাধান হয়নি সীমান্তজনিত অনেক সমস্যার। তাই তাড়াহুড়া করে নির্ধারণ করা সীমান্ত শুধু দুই প্রতিবেশী দেশের রক্ত ঝরিয়ে যাচ্ছে।
সিরিল র্যাডক্লিফ দেশভাগ শেষ করে ভারত ছাড়ার আগেই পুড়িয়ে ফেলেন তার সব নোট। পুরস্কার স্বরুপ দেশে ফিরে তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে নাইট উপাধি পান। তবে তার মনে কোন সন্দেহ ছিলোনা যে পাঞ্জাবী আর বাঙ্গালীরা তার সম্পর্কে কি চিন্তা করবে বা তাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবে ! তিনি নিজেই বলেছেন, “অন্তত ৮ কোটি মানুষ আমাকে দেখবে ক্ষোভ নিয়ে”। তবে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ আর কখনোই ভারত ও পাকিস্তানে আর আসেনি।