মধ্যাহ্ন ভোজে বসেছেন দু’জন খ্যাতিমান সাংবাদিক,যাদের একজন হলেন পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন কবি ও সাংবাদিক জন রির্চাড হার্সে আর অন্যজন হলেন ৩৫ বছর ধরে বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘নিউ ইয়র্কার’ এ কাজ করা প্রথিতযশা সাংবাদিক উইলিয়াম শন।
খাবার গ্রহনের ফাঁকে ফাঁকে তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল সম্প্রতি হিরোশিমা-নাগাসাকিতে ঘটে যাওয়া ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ও দূর্বিষহ হত্যাকান্ড নিয়ে।
সালটি ছিল ১৯৪৫, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। সেদিনও হিরোশিমাতে মানুষেরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যস্ত। কেউ সন্তান কে খাইয়ে দিচ্ছে,কেউ বাসায় ঢুকতে যাচ্ছে আবার কেউ হয়তোবা তার হাত ঘড়িটিতে দম দিচ্ছিল। এমন সময়ে পৃথিবীতে প্রথম বারের মতো কোন যুদ্ধে গণ বিধ্বংসী মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। এর তিন দিন পরেই নাগাসাকি শহরেও আঘাত হানে প্রচন্ড এই শক্তিশালি ইউরোনিয়াম বোমা। ৯ই আগষ্ট ১১টা ২মিনিটে বোমার আঘাতে থেমে যাওয়া ঘড়িটি আজও সাক্ষি দিচ্ছে সেই ভয়াবহতার। হতবিহ্বল হয়ে যায় জাপানের মানুষ। উপায়ন্তর না দেখে জাপান যুদ্ধে আত্বসর্মপন করে।
কি হয়েছিল বোমার আঘাতে? বোমার আঘাতে মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল শহর দু’টি। মারা যায় লক্ষ লক্ষ মানুষ আর যারা বেচেঁ গিয়েছিল তাদের ভোগ করতে হয়েছে অবর্ণনিয় যন্ত্রনা। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আজও অনেক মানুষ কে বংশগত ভাবে ভোগ করতে হচ্ছে সেই বোমার অভিশাপ। চোখ ও কানের সমস্যা আর অনেককে পঙ্গুত্বের অভিশাপ বহন করতে হচ্ছে আজীবন।
এত অমানবিক ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ আর ধ্বংসাত্মক কাজের পরেও আমেরিকার টেলিভিশনে বা সংবাদ মাধ্যমে এর কিছুই প্রকাশ করা হল না। সরকার গণ মাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল যাতে ক্ষয়ক্ষতির খবর প্রকাশিত না হয়। মিডিয়া ছিল সম্পূর্ণ সরকার নিয়ন্ত্রিত। ক্ষয়ক্ষতির তথ্য প্রকাশ করার জন্য ধূলোবালি,কিছু ভাংঙ্গা বাড়ি,শুষ্ক গাছপালা বারবার প্রদর্শন করা হচ্ছিল সংবাদ মাধ্যমে। তখনকার সামরিক বাহিনীর একজন জেনারেল আনবিক বোমার আঘাতে মৃত্যু কে খুবই শান্তির মৃত্যু বলেন, যা ছিল খুবই অমানবিক। সরকারের এই বিবেগহীন ও সন্দেহজনক বক্তব্য কে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে যখন বিশ্বের অন্যান্য গন মাধ্যম এবং জাপান থেকে খবর আসা শুরু হয়। তাদের নার্ভ এতটাই শক্ত যে আমেরিকার উচ্চ পদস্থরা একে সরকার বিরোধী প্রচারণা হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল।
তখন একজন সাংবাদিক হিসেবেই শুধু নয় একজন মানবিক গুণ সমপন্ন মানুষ হিসেবে হার্স এবং শন ঠিক করেন, হিরোশিমা আর নাগাসাকির মানুষের উপর দিয়ে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে তা সকলকে অবশ্যই জানতে দেয়া উচিৎ। যেই কথা সেই কাজ।
হার্স চলে যান হিরোশিমা নাগাসাকিতে। মিশনারী মায়ের সন্তান হার্স সামাজিকতার মূল্যবোধ পেয়েছিলেন ছোটবেলা থেকেই। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে গিয়ে মানুষের ঐ বির্পযয় দেখে হার্সের মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মমতা,সহমর্মিতা আর ভালবাসায় তিনি উদ্বেলিত হয়ে পড়েন। তিনি সেখানে দুই সপ্তাহ অবস্থান করে বিভিন্ন মানুষের সাক্ষাৎকার নেন এবং বিশদ ভাবে তথ্য সংগ্রহ করে ৩০,০০০ শব্দের এক প্রতিবেদন জমা দেন সংবাদপত্র অফিসে। তার লেখাগুলো পড়ে মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠে এই হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে। তার প্রতিবেদনটি পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশ পায়,যার নাম ছিল “হিরোশিমা”। হার্স যখন সশরীরে হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে উপস্থিত ছিলেন তখন প্রতিবেদন তৈরির পাশাপাশি তিনি সেখানে উপস্থিত কিছু মানুষের মনের কথা টুকে নিয়ে এসে লিখেন গল্পের আকারে একটি বই। গল্পের চরিত্রগুলো তিনি বেছে নিয়ে ছিলেন সেই হিরোশিমা-নাগাসাকির মানুষগুলো থেকেই। তাদের কথাগুলোকে শুধু নিজের মতো করে সাজিয়ে উপস্থাপন করেন বইটিতে। গল্পটি পুরো বিশ্বের মানবতাকে নাড়িয়ে দেয়। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে নিজের চোখে দেখা হার্সের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ ৩০হাজার শব্দের অফিসিয়াল প্রতিবেদন প্রকাশের পাশাপাশি তার অনন্য সাহিত্য প্রতিভা দিয়ে লেখা গল্পটি প্রতিটি মানুষের মনে ঘৃণা তৈরি করেছিল শক্তিশালী রাজ্যগুলোর বিরুদ্ধে । সাংবাদিক,সাহিত্যিক হার্স অনেক পুরষ্কার পান এই বইটির জন্য, সেই সাথে বিংশ শতাব্দীতে সাংবাদিকতায় শ্রেষ্ঠ ১০০কাজের মধ্যে প্রথম স্থান পায় তার বইটি।
হিরোশিমা-নাগাসাকিতে সংঘটিত অন্যায় সর্ম্পকে সকলের জানতে পারার পেছনে অনেক অবদান রয়েছে সাংবাদিক শেন ও হার্সের।
হার্স ছিলেন খুবই নিভৃতচারী মানুষ, তিনি খুব একটা লোক সম্মুখে আসতে চাইতেন না। তাকে নিয়ে খুব লেখা-লেখিও তিনি পছন্দ করতেন না কিন্তু সারাজীবন তিনি অমর হয়ে আছেন আর থাকবেন তার রচনা দিয়ে।
সাতাত্তর বছর আগের ঘটনা হলেও আজও তা মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করে। নাগাসাকির বেশ কিছু জায়গায় এখনো পারমানবিক বোমায় ধ্বংসের নির্দশন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যুদ্ধ থামলেও আজও সেখানে যুদ্ধের ভয়াবহতা বিরাজ করছে।
রেফারেন্স-(১) রোর বাংলা (২) bbc.com (৩)আনন্দ বাজার পত্রিকা (৪)Zeenews.india com/begali/photos