সেদিন প্যারিসে শেষবারের মতো দেখেছিলেন সুনীল সোনালী চুলের সেই দীর্ঘাঙ্গিনী তরুণীটিকে। প্রথমবার যেমন দেখেছিলেন তাকে, ঠিক তেমনটাই লাগছিলো সেদিনও। মাথাভর্তি আলোকলতার মতোন এলোমেলো সোনালি চুল, গায়ে ভোরের সূর্যের মতোন লাল রঙের সোয়েটার, সারা মুখে সুস্বাস্থ্যের ঝলমলানি এবং হাতে একগুচ্ছ সাদা লিলি ফুল! ঠিক যেমনটি তাকে প্রথমবার অনুভব করেছিলেন সুনীল। তবে প্রথমবার তাকে দেখবার পর সুনীলের ভেতরে কোনো অজানা আশঙ্কা উঁকি দেয় নি, বরং তখন তার অনুভবের পুরোটা জুড়েই ছিলো ভালো লাগা। কিন্তু সেদিন প্যারিসে যখন দুজনই দুটি আলাদা ফ্লাইট ধরে ফ্রান্স ছাড়তে উদ্যত হয়েছেন, কেমন যেনো বুক ভারী হয়ে আসছে সুনীলের, যেনো হারাতে বসেছেন তিনি মিষ্টি হাসির সেই মেয়েটিকে। বাস্তবে কিন্তু ঘটেছিলোও তা-ই। সেদিনই ছিলো মার্গারিট ম্যাথিউ এর সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শেষ দেখা।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা আমরা কে না জানি? বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য রত্ন ছিলেন তিনি। একাধারে তিনি ছিলেন কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সম্পাদক, সাংবাদিক এবং কলামিস্ট। পরবর্তী জীবন কোলকাতায় কাটালেও আসলে তিনি বাংলাদেশেরই মাদারীপুরের সন্তান। সুতরাং এই দেশের সাথে তার জন্মসূত্রে সম্পর্ক রয়েছে।
সুনীল সাংবাদিকতা পেশায় থাকা অবস্থাতেই তার বন্ধুত্ব হয় যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান এবং একজন প্রখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক মিস্টার পল অ্যাঙ্গেলের সাথে। সেই সুবাদে আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়েটিভ রাইটিং ওয়ার্কশপে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পাবার সাথে সাথেই রাজি হয়ে যান সুনীল। আইওয়াতেই তার পরিচয় হয় ফরাসি তরুণী মার্গারিট ম্যাথিউ এর সঙ্গে।
মার্গারিটের সঙ্গে সুনীলের ঘনিষ্ঠতার শুরুটাও হয় সাহিত্য দিয়েই। পোস্ট ডক্টরেট করতে মার্গারিট এসেছিলেন আমেরিকায়। ভুলবশত সুনীলের কাছে একটি বই রেখে যাবার অজুহাতেই দ্বিতীয়বার দেখা করেন তারা দুজন। মার্গারিটের সঙ্গে সুনীল খুঁজে পেয়েছিলেন মনের মিল। সুনীল লিখতে ভালোবাসতেন, আর মার্গারিট পড়তে। মার্গারিট সুনীলকে শোনাতেন ফরাসি কবিতা, আর সুনীল মার্গারিটকে শোনাতেন ভারতীয় উপমহাদেশের গল্প। এভাবেই এক গভীর বন্ধুত্ব ও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে সুনীলের সঙ্গে মার্গারিটের।
কবিতা ও সাহিত্যের প্রতি মার্গারিটের প্রেম থাকলেও তিনি ছিলেন প্রচন্ড ধার্মিক, একজন নিষ্ঠাবান ক্যাথলিক। এ কারণে সুনীলের সাথে তার সম্পর্ক যতোই গভীর হোক না কেনো, তিনি কোনো অনৈতিকতার দিকে এগোন নি। সুনীল প্রথমে অভিমান করেছিলেন বটে! কিন্তু হয়তো মার্গারিটের এই গুণটিও সুনীলের মনকে তার দিকে আরও বেশি আকর্ষণ করেছিলো।
মার্গারিট নিজের মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে নিজ দেশে ছুটে যান এক দিন। সুনীলের তরুণ মন তখন প্রচন্ড রকমের অস্থির। তিনিও বেরিয়ে পড়লেন ভ্রমণে। লস এঞ্জেলস, শিকাগো, অ্যারিজোনা, বার্কলে, মেক্সিকো ইত্যাদি বহু জায়গা ঘুরেছেন সুনীল। এরই মধ্যে মার্গারিটের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমে। তবে মাঝে মাঝে টেলিফোনেও কথা হতো তাদের।
মার্গারিটের টানে সুনীল প্যারিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন অবশেষে। প্যারিসে বেশ চমৎকার কিছু দিন কাটালেন সুনীল ও মার্গারিট। তবে মার্গারিটের গবেষণার অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করবার জন্য আবারো তাকে পাড়ি জমাতে হবে আমেরিকায়। এই সেই মুহূর্ত, যখন মার্গারিটকে শেষবারের মতো বিদায় দিয়ে প্যারিস ত্যাগ করেছিলেন সুনীল। মার্গারিট চলে গেলেন আমেরিকায়, আর সুনীল ফিরে এলেন কোলকাতায়।
আগেই বলেছি, সুনীলের মন এক জায়গায় স্থির ছিলো না কখনোই। মার্গারিটের সঙ্গে নিয়মিত তার যোগাযোগ থাকলেও প্যারিস ছেড়ে আসার তিন বছরের মাথায় সুনীল প্রেমে পড়েন ফরাসি জানা এক তরুণী স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের। স্বাতীকে বিয়ের প্রস্তাবও দেন সুনীল। সুনীল স্বাতীকে মার্গারিটের কথা সমস্তই খুলে বলেন এবং মার্গারিটকেও জানান স্বাতীর কথা। ফলস্বরূপ, স্বাতী ও মার্গারিট পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠলেন। নিয়মিত চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ হতো তাদের।
এক দিন সুনীল ও স্বাতীর বিয়ে হয়ে গেলো। খবর পেয়ে শুভেচ্ছা জানালেন মার্গারিট। এর এক বছরের মাথায় সুনীল ও স্বাতীর ঘর আলো করে এলো তাদের একমাত্র ছেলে। ছেলের নাম রাখা হলো সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়। সুনীলের সন্তান হবার খবর শুনে আবেগাপ্লুত হলেন মার্গারিট। গির্জায় গিয়ে নতুন শিশুর জন্য প্রার্থনা করেছিলেন তিনি। কিছু টাকাও পাঠিয়েছিলেন তিনি সৌভিকের জন্য উপহারস্বরূপ।
এভাবেই চমৎকার এক বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো সুনীলের পরিবারের সঙ্গে সুদূরে থাকা মার্গারিটের। তবে এক দিন সব ওলট-পালট হয়ে গেলো। বহু দিন যাবৎ মার্গারিটের কোনো চিঠি নেই, নেই কোনো খোঁজ। মার্গারিটের এমন নীরবতা সুনীলের যেনো সহ্য হচ্ছিলো না। তাই তিনি যোগাযোগ করলেন পল অ্যাঙ্গেলের সঙ্গে। তার কাছ থেকে সুনীল যা জানতে পারলেন, তা তিনি সহ্য করতে পারলেন না। পল অ্যাঙ্গেল জানালেন, কতগুলো অপরিচিত লোক আমেরিকার রাস্তা থেকে গাড়িতে করে মার্গারিটকে তুলে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে আর পাওয়া যায় নি তাকে। পুলিশও তখন পর্যন্ত মার্গারিটের কোনো হদিস পায় নি। পল অ্যাঙ্গেলের কথা শুনে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন সুনীল। তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগলো। থর থর করে কাঁপতে লাগলেন তিনি। হয়তো প্রচন্ড অস্থিরমনা সুনীলের মনের কোনো এক কোণ থেকে মার্গারিটের প্রেমের ছোঁয়া তখনও মুছে যায় নি। সুনীলের লেখা আত্মজীবনীগুলোই তার প্রমাণ। তিনি বার বার মার্গারিটের প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন সেখানে। সত্যিই যেনো সুনীলের হৃদয়ে মার্গারিট ফুল হয়ে ফুটে আছে চিরকালের জন্য।
রেফারেন্সঃ
- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং মার্গারিট ম্যাতিউ – নীরব এক প্রেমকাহিনি
- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় -উইকিপিডিয়া