আমেরিকা; ইউরোপের শাসন থেকে সদ্য স্বাধীনতা লাভকারী কৃষিনির্ভর মহাদেশ। ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা শিল্পোন্নোয়নের ধারে-কাছেও নেই আমেরিকা। তুলা চাষ, নীল চাষ প্রভৃতিই সাধারণ মানুষের জীবিকার মাধ্যম। হবেই বা না কেনো? খ্রিস্টান ধর্মের আদর্শ তো তা-ই বলে। তা ছাড়া ফ্রেঞ্চদের ‘জমিন্নোয়ন’ বা ‘জমি চাষ’ এর উপর গুরুত্বারোপ করা ফিজিওক্রেসি মতবাদও তো তা-ই বলে। তবে হঠাৎ এ কি হয়ে গেলো! পৃথিবীতে দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব ঘটে গেলো, তা-ও আবার আমেরিকায়! যে জাতি চাষাবাসবিহীন জীবনকে পাপ ও ভিত্তিহীন মনে করে, সে জাতির ক্ষেত্রে কি করে সম্ভব হলো এই বিপ্লব?

আমেরিকার উত্তরাঞ্চলের ছয়টি প্রদেশ নিয়ে গঠিত এলাকা নিউ ইংল্যান্ড। এই নিউ ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা জিনগতভাবে ব্রিটিশ, কিন্তু স্বাধীনতার পরও তারা আমেরিকায়ই রয়ে গেছেন। তাই তাদেরকে একটি আলাদা নামে ডাকা হয়, ‘ইয়াঙ্কী’।

১৭৮৫ সাল। বঙ্গোপসাগরীয় উপকূল। পশ্চিম ভারতীয় বাণিজ্যে বহু দিন আমেরিকানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিলো। তবে আজ কোনো নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই তীরে ভিড়লো আমেরিকান ইয়াঙ্কীদের জাহাজ। প্রায় ত্রিশ বছর যাবৎ বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষকে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে লোভী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা। অত্যাচার-নিপীড়নে যখন জর্জরিত বাংলার মানুষ, তখন অবৈধ উপায়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছিলো সাহেবরা। কিন্তু এতো বিপুল পরিমাণ অর্থ তো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজে করে ইংল্যান্ডে পাঠানো সম্ভব নয়। তাই এই অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য তাদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন ইয়াঙ্কী বণিকেরা। বাংলার বাণিজ্যে এভাবেই শুরু হলো আমেরিকানদের পথচলা।

আমেরিকার শিল্প বিপ্লবের মূল কারণ বাংলা-বাণিজ্য

স্যামুয়েল স্লেটারকে “আমেরিকান শিল্প বিপ্লবের জনক” বলে © Wikimedia

১৭৬০ সাল। ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব শুরু হলো, যার ধারা ১৮৪০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। লুটপাটের মাধ্যমে গড়ে তোলা বিপুল পুঁজিকে আমেরিকার ইয়াঙ্কী বণিকদের মাধ্যমে পণ্যে রূপান্তরিত করে ইংল্যান্ডে পাঠানোর মাধ্যমে সফলভাবে পৃথিবীর প্রথম শিল্প বিপ্লবের সূচনা করেছিলো ব্রিটিশরা।

১৭৯৫ সাল। আরও একটি শিল্প বিপ্লব ঘটে গেলো। এই স্বর্ণযুগের ধারা অব্যাহত ছিলো ১৮২০ সাল অবধি। কৃষিপ্রিয় আমেরিকানরা পুঁজি ছাড়াই করে দেখালো এই দুঃসাধ্য কাজ। ব্রিটিশদের সহায়তা করবার পেছনে নিশ্চয়ই ইয়াঙ্কীদের ব্যক্তিগত স্বার্থও বিদ্যমান ছিলো। বিনা পুঁজিতে বাংলার নৌবাণিজ্যে প্রভাব খাটানোর এমন সুবর্ণ সুযোগ তো আর কেউ হাতছাড়া করতে চাইবে না। আর বঙ্গোপসাগর তো বহু প্রাচীনকাল থেকেই ছিলো ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এক বাণিজ্যিক হাব।

১৮১৩ সাল পর্যন্ত আমেরিকার সব রাষ্ট্রপতিই ছিলেন শিল্পের বিপক্ষে। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, জর্জ ওয়াশিংটন, জন অ্যাডামস, টমাস জেফারসন, জেমস মেডিসন –এরা প্রত্যেকেই ছিলেন ফিজিওক্রেসিতে বিশ্বাসী। বাজার অর্থনীতিতে তাদের আস্থা একদমই ছিলো না। বহিঃর্বিশ্বের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন এবং বিনিময়ের মাধ্যমে হিসেবে মুদ্রার ব্যবহারে কোনো প্রকার আগ্রহই তাদের ছিলো না। শুধুমাত্র কৃষি পণ্যই ছিলো তাদের বিনিময়ের মাধ্যম। এতো কিছুর পরও ১৭৯০ সালে ঠিকই মুদ্রা ও ব্যাংক প্রবর্তনের অনুকূলে আইন প্রণয়নে বাধ্য হয় আমেরিকা এবং বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে ১৮১৩ সালের পর থেকেই আমেরিকার বাজার অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এই সময়ের আগে যেহেতু রাষ্ট্র শিল্প ও বাণিজ্যে কোনো বিনিয়োগ করে নি, তবে এই পরিবর্তন কি করে আসলো? রাতারাতি তো কোনো বিপ্লব সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং ইয়াঙ্কী আমেরিকানদের বাংলার সাথে বাণিজ্যই কি এর মূল কারণ নয়?

ইয়াঙ্কীদের হাত ধরে যেমন ব্রিটিশরা লাভবান হয়েছিলো, তেমনি আমেরিকানরাও হয়েছিলো। ব্রিটিশদের চোরাই টাকা ইংল্যান্ডে পাচারের মাধ্যমে মার্কিনরা ১৮০৭ সাল পর্যন্ত বাংলার বাণিজ্য থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করেছিলো, যাকে বলা যায়, ‘শূন্য হাতে এসে বাজিমাত’।

ইয়াঙ্কী ব্যবসায়ীরা বাংলায় এসে বাণিজ্য করবার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ পুঁজির জোগান কিভাবে দিলেন, তা কিন্তু একটি রহস্য বটে। আসলে এই বাণিজ্যে সফলতা লাভের জন্য তারা কিছু কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। তাদের আয়ের তিন ভাগের এক ভাগই আসতো ভাড়ায় পণ্য বহনের মাধ্যমে। এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে পণ্য পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে তারা বেশ অনেকটা অর্থ জমিয়েছিলেন। ব্রিটিশদের অবৈধ টাকা তো তারা ইংল্যান্ডে পৌঁছে দিতেনই, এ ছাড়াও এই লুটপাটের অর্থ ধার করেও তারা বাংলায় পণ্য ক্রয় করতেন। আবার জলদস্যুদের লুট করা সম্পদও তারা খুব কম দামে কিনে নিতেন। অনেক সময় নিজেরাও দস্যুবৃত্তিতে লিপ্ত হতেন সম্পদ আহরণের জন্য। বাংলা থেকে কেনা কিংবা বিভিন্ন উপায়ে অর্জিত পণ্যগুলোকে তারা চাহিদার ভিত্তিতে অন্যান্য বন্দরে বিক্রি করতেন। এভাবেই আস্তে আস্তে প্রায় বিনা পুঁজিতে ইয়াঙ্কীরা বাংলার বাণিজ্যের মাধ্যমে সফলতার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিলেন আমেরিকাকে।

১৮০৭ সালের পর থেকে আমেরিকার এই বিপুল সফলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের যুদ্ধ পরিস্থিতি। ১৬৮৯ সাল থেকেই অ্যাংলো-ফ্রেঞ্চ যুদ্ধ চলমান ছিলো। ১৮০৭ সালের পর থেকে এই পরিস্থিতি বেগবান হলে মার্কিনরা বাংলায় নৌবাণিজ্য পরিচালনা করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। তাদের বাণিজ্য জাহাজ বাজেয়াপ্ত করা হয়। অনেক মার্কিন বণিকদেরকে বন্দীও করা হয়। শুধু তা-ই নয়, বন্দী মার্কিন বণিকদেরকে বাধ্য করা হয় যুদ্ধের কাজে শ্রম প্রদানের জন্য।

সে সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন টমাস জেফারসন। অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি দ্রুত উদ্যোগ নিলেন। ১৮০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাস হলো ‘এম্বার্গো অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন। এই আইন অনুসারে, ব্রিটেনের সাথে আমেরিকার আমদানি ও রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়।

আমেরিকার শিল্প বিপ্লবের মূল কারণ বাংলা-বাণিজ্য

টমাস জেফারসন © Wikimedia

এম্বার্গো অ্যাক্টের কারণে বিপাকে পড়ে যান মার্কিন বণিকেরা। হুট করেই বন্ধ হয়ে যায় বাংলার সাথে লাভজনক ব্যবসা। এই পরিস্থিতি থেকে আমেরিকাকে বের করে আনার জন্য এগিয়ে আসেন ‘দ্য বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস’। আসলে ‘দ্য বোস্টন অ্যাসোসিয়েটস’ নামটি আমেরিকান লেখক ভেরা শ্লাকম্যানের দেয়া। আমেরিকার উত্তর উপকূলের নিউ ইংল্যান্ড এলাকার সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র এবং ম্যাসাচুসেটসের সবচেয়ে বড় শহর বোস্টনের চার জন ব্যবসায়ী নাথান অ্যাপেলটন, প্যাট্রিক ট্রেসি জ্যাকসন, অ্যাবট লরেন্স ও আমোস লরেন্সের সহায়তায় আমেরিকা আবারো নিজেদের পুঁজিকে কাজে লাগাতে পেরেছিলো। আর এরই ধারাবাহিকতায় বোস্টন অ্যাসোসিয়েটসরা পরিণত হন আমেরিকার শিল্প বিপ্লবের রূপকারে।

তবে প্রশ্ন কি রয়ে যায় না যে, এই বোস্টন অ্যাসোসিয়েটসরা আসলে কারা? কিভাবেই বা তারা এতো বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে আমেরিকায় শিল্প বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন? সামান্য গবেষণা করলে সহজেই জানা যায় যে, বোস্টন অ্যাসোসিয়েটসের চার জন সদস্যই কোলকাতার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

১৭৮১ থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত মাদ্রাজের গভর্নর ছিলেন জর্জ ম্যাকার্টনি। তিনি গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদনে জানিয়েছিলেন আমেরিকার সঙ্গে ভারতীয় বাণিজ্যের ফলস্বরূপ ভারতবর্ষে শিল্প বিপ্লব সংঘটনের সম্ভাবনার কথা। এই শিল্প বিপ্লব ঘটেছিলো ঠিকই, কিন্তু ভারতবর্ষে নয়, আমেরিকায়।

আমেরিকার শিল্প বিপ্লবের মূল কারণ বাংলা-বাণিজ্য

অ্যাবট লরেন্স (বাঁয়ে), প্যাট্রিক ট্রেসি জ্যাকসন (ডানে) এবং নাথান অ্যাপেলটন

বঙ্গোপসাগরে আমেরিকা থেকে পাঠানো সর্বপ্রথম জাহাজটি ছিলো ‘এমপ্রেস অফ চায়না’। ১৭৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাহাজটিকে পাঠান ধনী ব্যবসায়ী রবার্ট মরিস। এরপর একই বছরের জুন মাসে পাঠানো হয় ‘দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা’ নামের জাহাজটিকে। এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন টমাস বেল। ডিসেম্বর মাসে বঙ্গোপসাগরীয় উপকূল থেকে জাহাজটিকে নিয়ে যাওয়া হয় মাদ্রাজ বন্দরে। ১৭৮৫ সালের জুন মাসে আমেরিকার রোড আইল্যান্ড থেকে হুগলি বন্দরে পাঠানো হয় ‘হাইড্রা’ নামের জাহাজটিকে। ১৭৮৭ সালে রোড আইল্যান্ডের রাজধানী শহর প্রোভিডেন্স থেকে ‘জেনারেল ওয়াশিংটন’ নামের জাহাজটিকে মাদ্রাজে পাঠান উইলিয়াম ব্রাউন।

ম্যাসাচুসেটসের উত্তর উপকূলীয় শহর সালেমের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী রিচার্ড ডার্বির ছেলে ইলিয়াস হাস্কেট ডার্বিই সর্বপ্রথম ১৭৯০ সাল থেকে কোলকাতায় একাধিক বাণিজ্য জাহাজ প্রেরণের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে ব্যবসা পরিচালনা শুরু করেন। ডার্বিদের জাহাজে করেই ভারতীয় সুতি বস্ত্র সর্বপ্রথম আমেরিকায় এসেছিলো, যা পরবর্তীতে বাণিজ্যিক চাহিদার খাতিরে চীনে পাঠানো হয়েছিলো।

১৭৯৪ সালে আমেরিকান ও ব্রিটিশদের মধ্যে ‘জে ট্রিটী’ নামের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে আমেরিকানরাও ভারতবর্ষে স্বাধীনভাবে বাণিজ্য পরিচালনার মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের অধিকার লাভ করে। আর তাই ১৭৯৫ সাল থেকে ভারতবর্ষে মার্কিন বাণিজ্য ব্যাপকভাবে শুরু হয়।

আমেরিকার শিল্প বিপ্লবের মূল কারণ বাংলা-বাণিজ্য

এমপ্রেস অফ চায়না, © Wikimedia

এতোসব ঘটনার স্পষ্ট দলিল থাকা সত্ত্বেও কোনো এক অজানা কারণে আমেরিকার শিল্প বিপ্লবের মূল চাবিকাঠি যে বাংলার বাণিজ্য, এই ব্যাপারটিকে আড়ালেই রেখে চলেছেন জ্ঞানী-গুণী পন্ডিতেরা। নিজেদের অর্জনের গৌরবকে হাইলাইট করার খাতিরে যেনো কিছুটা ইচ্ছাকৃতভাবেই ভারতবর্ষ তথা বাংলার অবদানকে অবজ্ঞাভরে দেখেছেন মার্কিনরা। একটা সময় আমেরিকানরাও যে আমাদের এই সমৃদ্ধ উপমহাদেশের শরণাপন্ন হয়েছিলো, তা আজ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরবার দায়িত্ব আমাদেরই। আমাদের শক্তি, সামর্থ্য ও সমৃদ্ধির উপলব্ধি আমাদের সবার অন্তরে জাগ্রত হোক, এটাই প্রত্যাশা থাকবে।

রেফারেন্স: