মিশরীয়দের চেতন অবচেতন মন জুড়ে ছিল ধর্ম এবং পরকাল। তাদের বিশ্বাস পরকালে সুন্দর জীবন পাওয়ার জন্য দেবতারা তাদের সাহায্য করবে। তাই দেবতাদের আনন্দ ,ভোগ এবং সন্তুষ্টি বিধান মিশরীয়দের প্রধান দায়িত্ব ছিল। এই জন্য নানা রঙে নানা ঢঙে দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য তারা ব্রতী হতো। দেবতাদের পছন্দ ছিল সুগন্ধি, নাচ এবং গান। তাই তাদের সামনে গান এবং নাচের আয়োজন করা হতো। আর এই কারণে প্রাচীন মিশরের গায়ক- গায়িকা, নর্তক -নর্তকী, সংগীত বিশেষজ্ঞরা অত্যন্ত সম্মানিত ছিল। মন্দিরের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান ছাড়াও নানা রকম ধর্মীয় উৎসবে, কোন নবাগত শিশুর জন্ম উপলক্ষে বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া উপলক্ষে এই নাচ , গান ও সুগন্ধির ভীষণ প্রয়োজন ছিল। সংগীতের অসীম গুরুত্বের কারণেই হয়তো মন্দিরের বিভিন্ন দেয়ালচিত্রে সংগীত বিশেষজ্ঞ, গায়িকা এবং মিশরের নর্তকীদের বিভিন্ন রঙ্গিন চিত্র খুঁজে পাওয়া গিয়েছে । সেখানে তারা বেশ উৎসবমুখর ভাবেই দেবতাকে সন্তুষ্ট করার কাজে ব্যাস্ত বলে মনে হচ্ছে । তাদের এই সংগীতের মূর্ছনাকে আরও সুরেলা করার জন্য বীনা, বাঁশি, সাজি, খঞ্জনি, এই সমস্ত যন্ত্রের ব্যবহার হতো।

প্রাচীন মিশরীয় নৃত্যশিল্পী, গায়ক, ও বাদকদের দেয়ালচিত্র; Image Source: Study Blue.
সঙ্গীত শিল্পীদের নির্দিষ্ট কিছু পদবীও ছিল। অর্থাৎ মিশরীয়দের মধ্যে সংগীত বিশারদ বা নর্তকীদের মধ্যে শ্রেণীবিন্যাস ছিল। সবচাইতে উচ্চ স্তরের সঙ্গীতজ্ঞরা ছিল মন্দিরের দেবতার সেবায় নিয়োজিত। তবে দেবতার সেবার জন্য নিয়োজিত শিল্পীদের বেশ মূল্যও দিতে হতো। শুধুমাত্র পুরোহিত এবং ফারাওদের মিশরে দেবতাদের দর্শন পাওয়ার অনুমতি ছিল। এই কারণে মন্দিরে দেবতাদের সেবায় নিয়োজিত শিল্পীদের মন্দিরে প্রবেশের আগেই চোখ তুলে ফেলে দিয়ে অন্ধ করে দেওয়া হতো, এর ফলে তারা দেবতাদের মুখ দর্শন আর করতে পারতো না l সমাধির দেয়াল চিত্রে অন্ধ বীণাবাদকের ছবি এর প্রমাণ বহন করে। দেবতার সামনে এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ শারীরিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন গায়ক উপস্থাপিত হতে পারবে কিনা সেই সম্পর্কে মিশরবিদদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু দেখা গিয়েছে দেবতার তুষ্টির জন্য অন্ধ বীণাবাদক তার বীণার মূর্ছনায় মাদকতা তৈরির অনুমতি পেয়েছিল। শুধুমাত্র মন্দিরের অভ্যন্তরেই না দেবতার মূর্তি নিয়ে যখন শোভাযাত্রা বের হতো তখন সেখানেও গায়ক- গায়িকা, নর্তকীরা অংশগ্রহণ করতো। মিছিলেই তারা নাচতো, বাদ্যযন্ত্র বাজাতো। কখনো কখনো দুরাত্মা বা অশুভ আত্মাকে ভয় দেখিয়ে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য উচ্চস্বরে চিৎকার করে গান করতো। ঘন্টা তাড়নী বা সিস্ট্রাম এই বাদ্যযন্ত্র গুলো ব্যবহারের বহু ছবি এবং নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে মিশরে।

দেবতা শু-র সামনের বীণাবাদক বীণা বাজাচ্ছেন; Image Source : George Holton.
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুষ্টু আত্মাকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যই এই ঘন্টা তাড়নী ব্যবহার করা হতো। অনেক ক্ষেত্রে মিশরীয় দেবী হাথোরকে লেডি অফ ডান্স হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর সিস্ট্রেম ছিল তামা দিয়ে তৈরি এক ধরনের ঝুমঝুমি। হাথোরের সাথে এই বাদ্যযন্ত্র গুলোর সম্পর্ক ছিল গভীর। তাই সিস্ট্রাম গুলোতে হাথোরের মূর্তি খোদাই করা হতো। অনেক সময় হাথোরের মুখের আকৃতিতেই সিস্ট্রামটি তৈরি করা হতো। মন্দিরেও বিভিন্ন চিত্রকলায় হাথোরের হাতে সিস্ট্রেম দেখতে পাওয়া গিয়েছে। অনেক সময় প্রসব বেদনাকে লাঘব করবার জন্য ধাত্রীরা নর্তক -নর্তকীর রূপ ধারণ করে প্রসব প্রক্রিয়াকে সহজ করবার চেষ্টা করতো। মেরেরুকার সাক্কারের সমাধিতে দেখা গিয়েছে একদল নারী নাচিয়ে তার স্ত্রী ওয়াটেখেথোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এবং নিচে হায়ারোগ্লিফিকে লেখা” But see the secret of birth! Oh pull!” অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময়ও তাদের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া গিয়েছে। মৃত ব্যক্তির আত্মাকে আনন্দ দেবার জন্য এবং দুষ্ট আত্মাকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য তারা নাচ গানের ব্যবস্থা করতো। ফসল উৎপাদনের সময়েও নাচ, গান চলতো। ক্ষেত থেকে ফসল কেটে আনার প্রক্রিয়াতে তাদের মনে হতো ফসলের দেবতা ওসিরিসকে তারা কষ্ট দিচ্ছে বা আঘাত করছে। তাই কৃষি দেবতার মনোরঞ্জনের জন্য ‘নাচ‘ কৃষি কাজের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো সমাজের প্রগতি এবং উন্নয়নের জন্য নাচ গান সহায়তাকারী উপাদান। তাই সন্তান জন্মদান, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, দেবতাকে সন্তুষ্ট করা, কৃষিকাজ যাই হোক না কেন সবকিছুতেই নাচ, গান, ছিল অপরিহার্য। মন্দিরগুলির মধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক নাচ গানের ছবি তাদের সমাজ ব্যবস্থায় সংগীতের গুরুত্বকেই তুলে ধরে