স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা অত্যান্ত স্বর্গীয়। এই সম্পর্ক আরো মধুর করে তোলা হয় নানা রকম উপহারের বিনিময়ের মাধ্যমে। আর উপহারটা যদি সম্রাট পুত্র তাঁর স্ত্রীকে দেয়, তবে নিশ্চয় সেটা হবে অভিনব কিছু। ঠিক তেমনি শাহজাহানের পুত্র দারা শিকোহ তাঁর স্ত্রী নাদিরা বানু বেগমকে উপহার দিয়েছিলেন এক মিনিয়েচার পেইন্টিংয়ের অ্যালবাম। দারা ছিলেন বাদশাহ শাহজাহানের সবচাইতে প্রিয় সন্তান এবং বাবা শাহজাহান তাকে ভবিষ্যৎের সম্রাট হিসেবে মনোনিত করেছিলেন। কিন্তু হায়! দারাকে মোঘল ইতিহাসে সবচাইতে ট্রাজিক হিরো হিসেবেই পরবর্তীতে বর্ণনা করা হয়ে থাকে।
ফার্সী ভাষায় দারা শিকোহ শব্দের অর্থ হচ্ছে দ্যা গ্রেট সম্রাট দারিয়ুস (The Great Persian King Dariyus)। দারিয়ুস পারস্যের সম্রাট ছিলেন। দারা অত্যান্ত বিজ্ঞ, জ্ঞানী, ও সৌন্দর্যের পূঁজারী, জ্ঞানপিপাসু, ভালবাসায় পরিপূর্ণ একজন যোগ্য স্বামী ও যোগ্য বাবা। দারা শিকোহ ১৬৫৯ সালে মোঘল সিংহাসনের উত্তরাধিকারের যুদ্ধে তার নিজের ভাই আওরঙ্গজেবের কাছে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়ে মুত্যুবরণ করেন। যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে তার স্হাবর-অস্থাবর সমস্ত কিছুই এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে ও হারিয়ে যায়। দারার ব্যবহার করা বিভিন্ন দ্রব্যাদি হারিয়ে গেলেও ভাগ্যক্রমে দারা শিকোর মিনিয়েচার পেইন্টিংয়ের অ্যালবামটি বেঁচে যায়। সারা পৃথিবীর মানুষ যেন দারার এই অমরকীর্তি আ্যালবামটি দেখতে পায়, তারই ব্যবস্থা বিধাতা করে দিয়েছিলেন। এই অ্যালবামের প্রথম পৃষ্টায় দারা শিকোহ নিজ হাতে যা লিখেছিল, তার উপর কেউ সোনালী রং দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে হঠাৎ করে ঐ সোনালী রঙের প্রলেপটি উঠে গেলে দারার হাতের লেখাটি লোকচক্ষুর সামনে চলে আসলে- সবাই বুঝতে পরেলো এটা কার সম্পদ এবং অপার বিস্ময়ে সবাই তাকিয়ে থাকলো। অকশনে বিক্রি হওয়া এই আ্যালবামটি এখন লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রয়েছে। আমাদের ভারত উপমহাদেশের এই সম্পদ চলে গেল সাত সমুদ্রের ওপার।
মা মমতাজ মহল জীবিত থাকা অবস্থাতেই দারার সাথে নাদিরা বানুর বিয়ের বাগদান হয়ে গিয়েছিল। সেসময় শুরু হলো এই বিরাট প্রকল্পের কাজ। অনন্য শিল্পগুনে ভরা এই মিনিয়েচার পেইন্টিংগুলো অত্যন্ত যত্নের সাথে ভালবাসার স্ত্রী নাদিরা বানু বেগমের জন্য দারা শিকোহ তৈরী করেছিল মোঘল দরবারের বিখ্যাত শিল্পীদের দিয়ে। অ্যালবামের মধ্যে যে চিত্রগুলি ছিল, সেগুলি ১৬৩৩ থেকে ১৬৫৭ সালের মধ্যে আঁকা হয়েছিল। ছবিগুলো একটার সাথে একটা মুখোমুখি ছিল, যেখানে কিশোর বয়সের রাজকুমার, রাজকুমারী, ঋষি, যোগী, পাখি, ফুল, লতা, এবং দারা তার জ্ঞান অর্জনে ব্যস্ত, ধ্যানরত সন্ন্যাসী, ইত্যাদি বিষয়বস্তুর চিত্র আঁকা। এই অ্যালবামের মাধ্যমে আমরা দারার শিল্পনৈপূন্য, বিচক্ষণবুদ্ধি, তাঁর ভালোলাগা, তাঁর মনের ভাষা ইত্যাদি স্মপর্কে পরিচিত হতে পারি।
অ্যালবামের প্রথম পৃষ্টায় নাদিরা বানুকে উদ্দেশ্য করে তাঁর নিজের হাতে লেখা কবিতার মত কয়েকটি লাইনের বাংলা হলো- “ আমি আমার এই অ্যালবামটি প্রিয়তম স্ত্রী নাদিরা বানুকে আমার ভালোবাসার নিদর্শণ হিসেবে উপহার দিলাম।”
এই মিনিয়েচার অ্যালবামটির ছবিগুলি আমরা নিচে দিয়ে দিলাম। ছবিগুলি খুব নিখুতভাবে দেখলে আমাদের একটা কথাও আপনাদের কাছে মিথ্যা বলে মনে হবে না। তার শিল্পমন সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে এই মিনিয়েচার পেইন্টিংগুলোতে।