বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন। সারা বছরজুড়ে কোনো না কোনো উৎসব লেগেই থাকে বাঙালির ঘরে ঘরে। তেমনি এক উৎসব হল ভাইফোঁটা। ভাইবোনের পবিত্র ও সুন্দর সম্পর্ককে উদযাপন করা হয় এ উৎসবের মাধ্যমে। ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় বোনের এদিন ভাইদের কপালে ফোঁটা বা তিলক দেয়, ভাইদের পঞ্চব্যঞ্জন রেঁধে খাওয়ায়। হাসি-আড্ডা, খুনসুটিতে মেতে ওঠে ভাইবোনেরা।
ভাইফোঁটা উৎসবের পোশাকি নাম ‘ভাতৃদ্বিতীয়া’। এ দিকে ভাইদের মঙ্গল ও দীর্ঘায়ু কামনায় বোনেরা এই উৎসব পালন করে থাকে। কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে এ উৎসব পালন করা হয়। দুইদিন আগেই দীপাবলিও কালীপূজার মধ্য দিয়ে উৎসবের শুরু হয়ে যায়।
ভাইফোঁটা উৎসবের নেপথ্যে একটি হিন্দু পৌরাণিক
কাহিনী রয়েছে। হিন্দু পুরাণ ‘মৎসপুরাণ‘-এ মহর্ষি কশ্যপ ও অদিতির পুত্র সূর্যদেব বা বিবস্বান এর কথা বলা আছে। সূর্যদেবের তিন পত্নী;সংজ্ঞা, প্রভা ও রজনী।
সংজ্ঞা ও সূর্যের যম এবং যমী/যমুনা নামে পুত্রকন্যা রয়েছে।
এই ভাতৃদ্বিতীয়ার দিনে যমী তাঁর ভাই মৃত্যুর দেবতা যমের মঙ্গল কামনায় তাঁকে ফোঁটা দেন। সেই কাহিনী অনুসরণ করে হিন্দু মেয়েরা যমুনার মতো ভাইকে ফোঁটা দিয়ে থাকে। এ কারণে এই উৎসবের আরেক নাম ‘যমদ্বিতীয়া‘।
আবার অন্য একটি কাহিনী মতে,নরকাসুর নামে দৈত্যকে বধ করে যখন শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় ফিরে আসেন, তখন তাঁর বোন সুভদ্রা তাঁকে ফোঁটা দিয়ে মিষ্টি খেতে দেন।
আবার ভাইফোঁটার উৎসবের পিছনে অন্য একটি ইতিহাসও আছে। চতুর্দশ শতাব্দীতে সর্বানন্দসুরী নামে এক আচার্য পণ্ডিতের তালপাতার পুথি ‘দীপোৎসবকল্প’ তে একটি কাহিনীর উল্লেখ আছে যা জৈনধর্মের সাথে সম্পর্কিত।
‘দীপোৎসবকল্প’ তে উল্লেখিত কাহিনী অনুসারে জৈনধর্মের প্রবর্তক মহাবীর বর্ধমান যখন মারা যান তখন তাঁর অন্যতম অনুগত সঙ্গী রাজা নন্দীবর্ধন মানসিক এবং শারীরিকভাবে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেন।
এই অবস্থায় নন্দীবর্ধনের প্রিয় বোন অনসূয়া তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। রাজার কপালে রাজতিলক পরিয়ে তাঁকে কিছু খাবার খাইয়ে দেন অনসূয়া। তারপর তাঁকে বলেন,” রাজ্যের প্রজারা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে, এই অনশন তোমাকে মানায় না। হে ভ্রাতা, হে রাজন, রাজতিলক এঁকে দিলাম তোমার কপালে এবং ক্ষুধা নিরসনের জন্য গ্রহণ করো খাদ্য। তুমি সাদর আপ্যায়িত হও। সর্ববিধ মঙ্গলের জন্য তুমি জেগে ওঠো, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। তোমার দীর্ঘায়ু কামনা করি। প্রতি বছর এইদিনে তোমাকে রাজতিলক পরিয়ে অভিষিক্ত করা হবে, এই আমার ব্রত।”
বোনের কথা শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং বোনের হাতে খাদ্য খেয়ে রাজা অনশন ভঙ্গ করেন এবং তাঁর কাজে এবং স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন করেন।
সেদিনটি ছিল কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথি।
মহাবীরের মহাপ্রয়াণ ঘটেছিল ৫২৭ খ্রিস্টাব্দে। সেই হিসেবে এই কাহিনী সত্য হলে এই ভাইফোঁটা উৎসবের বয়স প্রায় আড়াই হাজার বছর।
যদিও অমাবস্যা শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রতিপদ তিথিতেই ফোঁটা দেওয়া যায়। তবে মূল ভাই ফোঁটা উৎসব হয় ভাতৃদ্বিতীয়ার দিনেই।
ভাইফোঁটার দিন ভাইবোনেরা সকাল সকাল স্নান করে সেজেগুজে তৈরি হয়ে যায়। এরপর বোনেরা চন্দন কাঠ জল দিয়ে ঘষে তাদের ভাইদের কপালে কনিষ্ঠা আঙ্গুল বা মধ্যমা(অনেক জায়গায় অনামিকা) দিয়ে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দিয়ে ছড়া কেটে বলে-
” ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,
যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা,
আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা৷
যম যেমন চিরজীবী, ভাই হোক চিরজীবী ৷।“
এভাবে বোনেরা ভাইদের দীর্ঘজীবন কামনা করে। এ ছড়াটি অবশ্য বিভিন্ন পরিবারের রীতিনীতি ভেদে সামান্য পরিবর্তিত হয়ে থাকে।কেউ কেউ চন্দনের সাথে দইয়ের ফোঁটাও দিয়ে থাকে।
এরপর বোনেরা ভাইদের মাথা ধান ও দূর্বা দেয়। এসময় শঙ্খ বাজানো হয় এবং নারীরা উলুধ্বনি করেন। তারপর ঘটভর্তি গঙ্গাজল আমপাতা দিয়ে ভাইয়ের মাথা ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এরপর প্রদীপ জ্বালিয়ে ভাইয়ের আরতি করে এবং প্রদীপের আলোর মতো ভাইয়ের উজ্জ্বল জীবন কামনা করা হয়। তারপর ভাইকে মিষ্টমুখ করানো হয়। এরপর প্রণাম এবল আশীর্বাদপর্ব। বোন ভাইয়ের বড় হলে ভাই বোনকে প্রণাম করে বোনের আশীর্বাদ নেয় অন্যথায় বোন ভাইকে প্রণাম করে ভাইয়ের আশীর্বাদ নেয়। এরপর গুরুজনদের প্রণাম করে আশীর্বাদ নেওয়া হয়। তারপর ভাইবোনের চলে উপহার বিনিময় ও খুনসুটি।এদিনে বোনেরা ভাইদের জন্য হরেক পদের রান্নাও করে।
অনেক পরিবারে, কুয়াশার জল জমিয়ে তা দিয়ে ভাইয়ের কপাল মুছে তারপর ফোঁটা দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। অনেক পরিবারে চন্দনের পাশাপাশি তেল,গঙ্গামাটি, তুলসীতলার মাটি দিয়েও ফোঁটা দেওয়ার রীতি আছে। আবার অনেক পরিবারে ছুরি হাতে ভাইয়ের দুপাশে মাটিতে সাতবার আঘাত করে শত্রুবিনাশ করার রীতিও আছে।(এটা প্রতীকী)
পরিবারভেদে এবল স্থানভেদে ভাইফোঁটার আচার ও রীতিনীতিতে এর বেশ কিছু পার্থক্য লক্ষ করা যায়।
ভাইফোঁটা উপলক্ষে বিবাহিত বোনেরা ভাইকে তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে ভাইফোঁটা দিয়ে নানারকম রান্না করে খাওয়ায়।আবার, অনেক ভাই,ভাইফোঁটা উপলক্ষে বোনকে শ্বশুরবাড়ি থেকে ‘নাইওর’ নিয়ে আসে।
বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা তো বটেই এমনকি ভারতবর্ষে বিভিন্ন জায়গায়ও হিন্দুরা এ উৎসব পালন করে থাকে। পশ্চিম ভারতে এই উৎসব ‘ভাইদুজ’ নামে পরিচিত এবং এদিনটি পাঁচদিন ব্যাপী দীপাবলি উৎসবের শেষ দিন। মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কর্ণাটকে এ উৎসবকে বলা হয় ‘ভাইবিজ’। নেপালে এবং পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে এটি ‘ভাইটিকা’ নামে পরিচিত। মহারাষ্ট্রের হিন্দু মেয়েরা ‘ভাইবিজ’ উৎসবটিকে অবশ্যপালনীয় মনে করে। এমনকি যাদের ভাই নেই তারাও চন্দ্রদেবকে নিজের ভাই মনে করে এ উৎসব পালন করে।
মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ড, ছত্তিশগড়, হিমাচল প্রদেশ, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, গোয়ায় চালের গুঁড়ো দিয়ে আলপনা দেওয়া হয়, যাকে চৌকনা, চতুর্কোন, চোকনা বা চুকনা বলা হয় অঞ্চলভেদে। আলপনার নির্দিষ্ট জায়গায় ভাইকে বসিয়ে বোনেরা দিদিরা তাদের ভাইদের নরকাসুর বধকারী শ্রীকৃষ্ণ রূপে পুজো করে, কপালে চন্দনের তিল্কা বা তিলক পরিয়ে আরতি বা আর্তি করে।
নেপালে আবার ভাইয়ের চারদিকে কয়েকবার প্রদক্ষিণ করে পবিত্র গঙ্গাজল ও তেল দিয়ে সুরক্ষাবলয় তৈরি করা হয়(সকল অশুভ শক্তির থেকে রক্ষার জন্য)।
তারপর একধরনের বিশেষ ফুলের মালা পরিয়ে ভাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করা হয়। তারপর ভাইয়ের কপালে টিকা পরানো হয়। পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন রঙের টিকা পরানো হয়; লাল,হলুদ,বেগুনি,সবুজ এবং সাদা।
এছাড়াও পূর্ব ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, ওড়িশা প্রভৃতি রাজ্যেও বিভিন্ন রীতিতে এ উৎসব পালন করা হয়।
বাংলা অঞ্চলে (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) এবং অন্যান্য জায়গার বাঙালিদের মধ্যে শুধু ভাইবোন নয়, নাতনীরা দাদুদের, ঠাকুমা-দিদিমারা তাঁদের নাতিদের ফোঁটা দেওয়ারও রীতি রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন সম্পর্কের মহিলারাও বিভিন্ন সম্পর্কের পুরুষদের ভাই পাতিয়ে ফোঁটা দেওয়ারও রেওয়াজ রয়েছে।
তবে রীতিনীতি যাই হোক না কেন, আচারে যত ভিন্নতাই থাকুক না কেন, উদ্দেশ্য কিন্তু একই, ভাইয়ের মঙ্গল কামনা। ভাইবোনের পবিত্র সম্পর্কের এ সুন্দর উৎসব সুপ্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে উদযাপিত হয়ে আসছে ভাইবোনের সম্পর্ক অটুট থাকার কামনায়৷