আকবর এবং জাহাঙ্গিরের সময় অধস্তন আমলা আসাদ বেগ কাজভিন, আবুল ফজলের হত্যা আর আকবরের মৃত্যুর প্রায় প্রত্যক্ষ্যদর্শী। তিনি দুটো অভিজ্ঞতাই লিখে যান। শুরুতে আবুল ফজলের হত্যাকাণ্ড তার পরে আকবরেরটি বয়ান করব। দুতিন কিস্তি হবে।
আসাদ বেগ দরবারে ছিলেন ১৬০১-১৬০৬ সময়ে, ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ে। তার উপাধি ছিল পেশরু খান। তিনি আবুল ফজল শেখ মুবারক নাগাউরির বিশ্বস্ত এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আকবরের ৪৭তম রাজত্ব বছরে বীর সিং বুন্দেলার হাতে সেলিমের নির্দশে আবুল ফজলের হত্যাকাণ্ড বর্ণিত হয়েছে আসাদ বেগের বয়ানে। বীর সিং বুন্দেলার বিদ্রোহ দমনে সম্রাটের বাহিনী ব্যর্থ হল কেন, সে কারন খুঁজতে আসাদ বেগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল দরবার থেকে। এরপর তাকে দক্ষিণে আদিল শাহের দরবারে দূত হিসেবে পাঠানো হয় আবুল ফজলের সঙ্গে। ফেরত আসার সময় তিনি সম্রাটের জন্যে পেশকাশ আর ড্যালিয়েলের জন্যে বিজাপুর রাজকন্যা আনছিলেন।
আবুল ফজলের নিহত হবার খবর আসে ৭ রাবি ১০১১ হ শুক্রবারের নামাজের সময়। খবরটা সম্রাটকে দেওয়া হলে তিনি গভীর হতাশায় ভেঙে পড়েন। তার সামনে রাখা রোজকার পানীয় মদ্য ছুঁলেন না। হতাশ হয়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁদতে থাকলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন আসাদ বেগ কোথায়। এই উত্তর দেওয়ার জন্যে কেউ তৈরি ছিল না, উত্তর পাওয়া গেল না। ইতিমধ্যে মির্জা জাফর আসফ খান দরবারে এলে, সম্রাটের কান্নায় তিনিও চিতকার করে কেঁদে ওঠেন। সম্রাট তাঁকেও আসাদ বেগের সংবাদ জিজ্ঞাসা করে বললেন – সে কী আবুল ফজলের সঙ্গে ছিল না। আসফ খান বললেন সিরঞ্জ অবদি তিনি আবুল ফজলের সঙ্গে ছিলেন। নতুন পরগণার ফৌজদার, আসাদ বেগকে পিছনে ফেলে রেখে আবুল ফজলকে মালওয়ায় নিয়ে যান। আবুল ফজল যখন মারা যান তখন আসাদ বেগ তার সঙ্গে ছিলেন না। সম্রাট আসফ খানকে ফরমান লিখতে বলেন যে আবুল ফজলের বাহিনীকে পিছনে ফেলে আসাদ বেগ যেন দ্রুত দরবারে ফিরে আসেন।
আসফ বেগ আবুল ফজলের হত্যাকাণ্ড বর্ণিত করেছেন বিশদে। তারপরে আকবরের মৃত্যু ঘটনায় আসব। মাথায় রাখতে হবে এই ঘটনাটা যখন লিখিত হচ্ছে, সে সময়ে জাহাঙ্গির শাসক। আবুল ফজলের হত্যাকাণ্ড ঘটে সেলিমের নির্দেশে। আসাদ বেগের কাজ হল সত্য না লুকিয়ে তথ্য বর্ণনা করা, এবং যাতে ঘটনাটা নতুন সম্রাটের কাছে খুবই আপত্তিকর না মনে হয়। তিনি লিখলেন আবুল ফজলের মৃত্যু ভাগ্যের খেলা, এবং তার বয়সও হয়েছিল। জনৈক অদক্ষ, অসুসজ্জিত গোপাল দাস তার সঙ্গে ছিল। রাজপুত গোপাল দাসকে সিবান্দি হিএবে ৩০০ রাজপুতইজবানএ উত্তীর্ণ করা হয়েছিল। রোজকার খবরে বোঝা যাচ্ছিল বুন্দেলা রাজার গতিবিধি। এমন কী, নিজের ভাই শেখ আবুল খয়েরের চিঠির কথা শোনেন নি। গোপাল দাসের যুক্তি ছিল, আবুল ফজলের বাহিনী ক্লান্ত, সেটি সিরোঞ্জিতে থাকুক ইন্দ্রজিৎ বুন্দেলাকে দমন করতে। এই যুক্তি আবুল ফজল মেনে নেন। যেন তিনি জানতেন তার ভাগ্য।
হত্যাকাণ্ড
আবুল ফজল আসাদ বেগকে সিরঞ্জে অপেক্ষা করতে নির্দেশ দিলে আসাদ বেগ বলেন তাকে যেন গোয়ালিয়র অবদি যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। তিনি লেখেন আবুল ফজল বহুবার তার অনুরোধ অগ্রাহ্য করেন। আসাদ বেগ ঘোড়া নিয়ে তাঁর সঙ্গে আসতে চাইলে আবুল ফজল নিষেধ করেন। ঠিক হল তার হাতি, নিশান এবং দমামা আসাদ খানের সঙ্গে থাকবে। আসাদ বেগের সহকারী রুস্তম খান তুর্কোমানকে সঙ্গে যাওয়ার নির্দেশ দিলেও আবুল ফজল শোনেন ন। রাস্তায় আবুল ফজল সরাই বারে বিশ্রাম নিলে একজন যোগী তার সঙ্গে দখা করতে আসেন। তিনি খবর দেন বীর সিং বুন্দেলা পরের দিন আবুল ফজলকে আক্রমন করতে পারেন। কিন্তু তিনি যোগীকে কিছু অর্থ দিয়ে তাঁকে চলে যেতে বলেন এবং তাঁর সাথীদের এই ঘটনা জানান না। এটাই নাকী আবুল ফজলের চরিত্র। তিনি সে রাতে কোনও নিরাপত্তা ছাড়াই ঘুমোন। পরের দিন শুক্রবার স্নান করে জামা পরিধান করলেন। জায়গিরদার, ক্রোড়ী সহ স্থানীয় বহু মানুষ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। এদের মধ্যে ছিলেন চল্লিশ পঞ্চাশটা ঘোড়াওয়ালা রুস্তম মির্জা। শেখ মির্জা, ফৌজদার কালা বাঘও তার বাহিনী এনেছেন। সব মিলিয়ে মোট ২০০ ঘোড়া ছিল। তিনি সকলকে চলে যেতে নির্দেশ দেন। ভাগ্য তাকে যেন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। তিনি ইয়াকুব খানকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। পেছনে তার বাহিনীর দামামা শোনা যাচ্ছিল।
তার দল এসে পৌঁছতে না পৌঁছতেই বুন্দেলা সৈনিক তাকে আক্রমন করল, মির্জা মহসিন বক্সী এগিয়ে এলেন এবং উঁচু টিলা থেকে দেখতে লাগলেন। তিনি দৌড়ে নামলেন। কিন্তু হাঁপিয়ে পড়া তার বাহিনী বুন্দেলাদের ছাড়িয়ে দূরে চলে যেতে সক্ষম হল। কিন্তু আবুল ফজল দ্রুত এগোতে পারছিলেন না। বুন্দেলারা নিশান আর বাদ্যযন্ত্র নিয়ে হাজির। কিছু পরে এসে হাজির বীর সিংহ বুন্দেলা ৫০০ ঘোড়া এবং নানান রকম ভয়ঙ্কর অস্ত্র নিয়ে। জনৈক গদাই খান অশ্ববাহিনী নিয়ে বুন্দেলাদের আক্রমন করল এবং মারা গেল। জনৈক সেনা আবুল ফজলকে দেখাল শত্রুর বর্ম আছে, তাদের নেই। ঠিক হল দূরে দাড়িয়ে তীর ধনুক দিয়ে আক্রমন করা যাক। তিনি শেখের ঘোড়া নিয়ে দূরে যেতে চাইলেন।
কিন্তু সেই মুহূর্তে শত্রুর ঘোড়া খুবই কাছে এসেগিয়েছিল। তারা হিংস্র আক্রমন শুরু করল। জনৈক রাজপুত সেনা শেখের পিঠে বর্শা দিয়ে আঘাত করে। জব্বর খাসাখালি একজন রাজপুতকে হত্যা করে আবুল ফজলকে ঘোড়া থেকে নামিয়ে নেয়। যুদ্ধে আবুল ফজল তীব্রভাবে আহত হয়েছিলেন। তিনি দাঁড়াতে না পেরে পড়ে গেলেন। বীর সিং বুন্দেলা ততক্ষণে আবুল ফজলের সামনে হাজির। জব্বর একটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে যায়। বীর সিং আহত আবুল ফজলের মাথা তার উরুতে রেখে দুপাট্টা দিয়ে মুখের ওপর ভেসে থাকা রক্ত মুছিয়ে দিতে থকেন। লুকিয়ে থাকা জব্বর যখন দেখলেন বীর সিং আবুল ফজলকে হত্যা করেছেন না, তিনি লুকোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে জানালেন তার জানুতে কার মাথা। বীর সিং তাকে সম্মান জানালেন এবং একটি ফরমান দেখিয়ে বললেন হজরতইজাহাঙ্গির এটা পাঠিয়েছেন। বীর সিং বললেন তিনি আবুল ফজলের নিরাপত্তা বিধান করবেন। জব্বার তলোয়ার বার করে দুচারজন রাজপুতকে হত্যা করে বীর সিংএর দিকে এগোলেন। বীর সিং দাঁড়ালেন। তার সঙ্গে থাকা কেউ একজন আবুল ফজলের মাথা বিচ্ছিন্ন করে দেয় ‘এই হতভাগ্য ছদ্ম কারাভানসরাইএর প্রথা হল,/ জ্ঞানীরা এটার থেকে দূরে থাক l
সঞ্জয় সুব্রহ্মণ্যম, মুজফফর আলম, উইটনেসিং ট্রানজিশন, ভিউজ অন দ্য এন্ড অব দ্য আকবরি ডিসপেনসেসন