বাগদাদ শহরের আত্মকথা: উত্থান, খ্যাতি এবং ধ্বংস
আমি বাগদাদ নগরী। আমি বর্তমান ইরাকের রাজধানী। আমার বুক চিড়ে চলে গেছে টাইগ্রিস নদী। ইউফ্রেটিস নদীটিও বয়ে চলেছে আমার একটু পাশ দিয়েই। আমার সৃষ্টি হয় অষ্টম শতাব্দীতে। আমার জন্মের পর ধাপে ধাপে হয়েছে আমার উত্তরণ। গভীর ইসলামিক দর্শন চর্চা, ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যের বিকাশ, এবং জ্ঞান–বিজ্ঞানে উন্নতির চরম শিখরে হয়েছিল আমার আরোহন। আমার ইতিহাস যেমন গৌরবের, তেমনি ধ্বংসেরও। বারবার করা হয়েছে আমাকে ধ্বংস, উঠে দাঁড়াতে চেয়েছি প্রতিবারই। আজ তা‘রই আখ্যান করবো এখানে খানিকটা।
আমার উত্থান
আব্বাসীয় খলিফা আবু জাফর আল–মানসুরের হাত ধরে ৭৬২ খ্রীষ্টাব্দের ৩০শে জুলাই শুরু হয় ইতিহাসের মহাসড়ক ধরে আমার পথ চলা। আল–মানসুরের স্বপ্ন ছিল আমাকে একটি বৃত্তর মতো গোলাকার শহর বানানো। আমাকে নির্মাণ করতে নিয়োগ করা হয়েছিল হাজার হাজার প্রকৌশলী, কারিগর, আইনজীবী এবং স্থপতি। এছাড়াও সাধারণ শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষের উপর। আমার চারিদিকে নির্মাণ করা হয়েছিল কয়েক স্তরের উঁচু দেয়াল। সবচেয়ে বহির্ভাগের ঘেরা দেয়ালটির উচ্চতা ছিল ৮০ ফুট। এ দেয়ালে ছিল মোট চারটি প্রবেশ দ্বার বা ফটক। এই ফটকগুলোই ছিল আমার কেন্দ্রস্থলে প্রবেশের একমাত্র পথ। এ চারটি ফটক হলো: দক্ষিণ–পশ্চিমে কুফা ফটক, দক্ষিণ–পূর্বে বসরা ফটক, উত্তর–পশ্চিমে শাম বা সিরিয়ান ফটক, আর উত্তর–পূর্ব দিকে রয়েছে খোরাসান প্রবেশ দ্বারটি। প্রতিটি প্রবেশদ্বার থেকে একটি সরাসরি সড়ক সোজা গিয়ে থেমেছে আমার কেন্দ্রে। এসব সড়কের দু‘দিকে নির্মাণ করা হয়েছিল চোখ ধাঁধানো অনেক সুন্দর–সুন্দর ফুলের বাগান এবং ছোট ছোট বিপনী।
৭৬৬ সালের মধ্যে আল–মনসুরের স্বপ্নের বৃত্তাকৃতি আমার নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়েছিল। নবম শতাব্দীর বিখ্যাত সর্ব বিষয়ে বিজ্ঞ এবং সাহিত্যিক আল–জাহিজ আমাকে নিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি বিশ্বের অনেক সুন্দর এবং পরিপাটি শহর দেখেছেন, কিন্তু আমার চেয়ে উন্নত এবং নিখুঁত এমন চোখ ধাঁধানো ও মন ভোলানো প্রশান্তির বৃত্তাকার শহর কোথাও দেখেন নি। আমার সৌন্দর্য্য ও নাগরিক সুবিধা দেখে তখন অনেকেই হতো রোমাঞ্চিত এবং পুলকিত। সবার ভালোবাসায় হতাম সিক্ত।
অষ্টম এবং নবম শতাব্দীর এক কেন্দ্রস্থল
কতগুলো বিশেষ কারণে খলিফা আল–মানসুর এই জায়গাটিকে বেছে নিয়েছিলেন আমার মতো একটি সুন্দর শহর নির্মাণের জন্য। যেমন, অনেক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পথ চলে গিয়েছে আমার উপর দিয়ে। আমার আবহাওয়া মাঝারি রকমের এবং সবার জন্য সহনীয়। আরেকটি কারণ হলো, আমার অবস্থান জলরাশির অনেক কাছে। আগেই বলেছি, টাইগ্রিস নদী চলে গিয়েছে আমার বুক চিড়ে। ইউফ্রেটিস নদীটিও বয়ে চলছে কাছেই। এ সমস্ত কারণেই দূর–দূরান্তের মানুষের কাছে আমি হয়ে উঠেছিলাম আকর্ষণীয়। আমার দিকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতো মানুষকে। খলিফা আল–মানসুর তাঁর স্বপ্নের শহরটির ভিত্তি নির্মাণ করেছিলেন বিশ্বের সেরা পন্ডিতদের দিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দলে দলে আমার কাছে ছুটে আসতো পন্ডিত, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, এবং পর্যটক। বিশ্ব সংস্কৃতি এবং জ্ঞানের একটি অন্যতম কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠলাম আমি।
চারিদিক থেকে অনেক প্রধান কাফেলা রুট এসে মিলিত হয়েছে খুরসান নামে এক সড়কে। আর আমি গড়ে উঠেছি এই খুরসান সড়কের উপরই। সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ভালো আবহাওয়ার জন্য আমার আশেপাশে গড়ে উঠে অনেক আকর্ষণীয় বাণিজ্যিক বিতান। দেশী–বিদেশী পন্য সম্ভারে ভরে উঠলো বিতানগুলো। ইউফ্রেটিস নদীর কাছে এবং টাইগ্রিস নদীর উপর অবস্থান হওয়ায় আমার সাথে অচিরেই গড়ে উঠলো চীন, ভারত এবং আর্মেনিয়ার মতো দেশের সাথে এক ঘনিষ্ট বাণিজ্য সংযোগ। দূরবর্তী দেশ থেকে আমার কাছে আসতে শুরু করলো বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, তাদের সাথে সাথে চলে আসতে লাগলো মূল্যবান সাহিত্য, কৃষ্টি, এবং জ্ঞান। আমি দ্রুত রূপান্তরিত হতে লাগলাম বিভিন্ন সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, এবং জ্ঞানের অপার মিলনস্থলে। হয়ে উঠলাম সে সময়ের এক আধুনিক কসমোপলিটান শহর, জ্ঞান চর্চার এক আকর্ষণীয় কেন্দ্রস্থল। আমার উপর গড়ে উঠতে লাগলো জগৎ বিখ্যাত ইমাম আবু হানিফা এবং ইমাম হাম্বলীর আইনবিষয়ক উচ্চ মানের বিদ্যালয়ের মতো অনেক শিক্ষালয়। আইনের উপর শিক্ষা ছিল মুসলমানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাদের বিশ্বাস, সৃষ্টিকর্তার আরোপিত বিচার এবং আইন বুঝতে হলে আইন শিক্ষা প্রয়োজন সবার। বর্তমান মুসলিম বিশ্বে সর্ববৃহৎ ইসলামিক আইনের ব্যাখ্যাদানকারী ইমাম হানিফার আবির্ভাব আমার এখান থেকেই।
আমার সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থান কাগজ উৎপাদনের জন্য ছিল খুবই সহায়ক। তখন বই ছাপানোর খরচ আমার এখানে ছিল বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক কম। অচিরেই বিশ্বে আমি হয়ে পড়লাম বই কেনা–বেচার একটি অন্যতম কেন্দ্রস্থল। আমার আনাচে–কানাচে ছড়িয়ে পড়লো অসংখ্য গ্রন্থাগার এবং বইয়ের দোকান। খুবই দ্রুত আমার অধিবাসীরা হয়ে পড়লো শিক্ষিত। তাদের এই শিক্ষিত হয়ে উঠার সাথে সাথে সাংস্কৃতিকভিত্তিক রচনা, কাব্য, এবং ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যের সূচনা হলো দ্রুত। আবির্ভুত হলো অনেক সৃষ্টিশীল কবি এবং লেখকের, তৈরী হলো এক বিশাল শিক্ষিত সমাজ। বিনোদনের জন্য বেড়ে গেলো ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যের চাহিদা, বিকশিত হলো ইসলাম, দর্শন এবং সংস্কৃতি চর্চার। সামগ্রিকভাবে আব্বাসীয়রা বিশ্বে পরিচিতি পেলো এক আধুনিক চিন্তাসম্পন্ন সাম্রাজ্যের। আমাকে চেনা হলো নতুনভাবে। আব্বাসীয়দের মিললো ইসলামের স্বর্ণযুগ প্রবর্তনের মুকুট।
বাইত–আল–হিকমা: আমার গর্ব
আমার জ্ঞানের বিস্তার এখানেই শেষ নয়। ৭৮৬ সালে শুরু হলো জ্ঞান–বিজ্ঞান বিস্তারের আরেক ধাপ। কে না শুনেছে খলিফা হারুনুর রশিদের কথা!
হারুনুর রশিদ ছিলেন আব্বাসীয়দের পঞ্চম খলিফা। ৭৮৬ সালে তিনি ২২ বছর বয়সে আব্বাসীয়দের খলিফা হন। খলিফা হারুনুর রশিদের স্ত্রী জুবাইদা ছিলেন আমার প্রতিষ্ঠাতা খলিফা আবু জাফর আল–মানসুরের নাতনী। আমার কেন্দ্রে খলিফা হারুনুর রশিদ প্রতিষ্ঠা করেন সে সময়ের বিশ্বের বিখ্যাত গ্রন্থাগার, “বাইত–আল–হিকমা” (House of Wisdom)। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় লিখিত বই আরবি ভাষায় অনুবাদ করতো এই গ্রন্থাগারটি। বিশেষ করে, গ্রীক ভাষায় লিখিত বইয়ের আরবি অনুবাদ হয়ে পড়ে অনেক জনপ্রিয়। প্রাচীন গ্রীক দর্শন এবং রাষ্ট্র বিজ্ঞানের চিন্তাধারা ছিল খুবই যুক্তিনির্ভর, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং প্রগতিশীল। খিলাফতের একটি নতুন আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম এবং প্রাথমিক অনুপ্রেরণা ছিল এ সব প্রাচীন রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিগুলো। খলিফা হারুনুর রশিদের সময়েই আমি জ্ঞান–বিজ্ঞান, চিকিৎসা শাস্ত্র, এবং সাহিত্যে অভূতপূর্বভাবে প্রসারিত হতে থাকি। আমার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। জ্ঞান–বিজ্ঞানের পিপাসা মেটাতে মানুষ ছুটে আসতে লাগলো আমার দিকে। তখন আমাকে বলা হতো ইসলামের স্বর্ণ যুগের কেন্দ্রস্থল।
“বিশ্বের কেন্দ্র” হলো আমার পরিচয়
ঐ সময়ে জ্ঞান–বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব অগ্রগতি এবং শিক্ষার প্রসারে আমি পরিচিতি পেলাম “বিশ্বের কেন্দ্র” হিসাবে। আমার এলাকার অনেক চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী, লেখক, দার্শনিক, চিকিৎসক, এবং পণ্ডিতরা বিশ্বে হয়ে পড়লো বিখ্যাত। বহির্বিশ্বের সাথে আমার বাণিজ্য এবং সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা আমার কাছে নিয়ে আসলো অন্য অঞ্চল থেকে জ্ঞানীদের। ভারত, সুদূর চীন এবং অন্যান্য দেশ থেকে চলে আসতে লাগলো পন্ডিতেরা জ্ঞানের ভান্ডার নিয়ে। তাদের উদ্দেশ্য শুধু জ্ঞান বিতরণ করা নয়, জ্ঞান আহরণ করাতেও ছিল তাদের সমান আগ্রহ। আমি হয়ে পড়ি বিশ্বজনীন জ্ঞানের সৃজন ক্ষেত্র। আমার স্বর্ণযুগকে বিকশিত এবং ধারণ করে রেখেছিলো আমারই অধিবাসীদের এক উচ্চ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। আমি যখন স্বর্ণযুগের শিখরে, ধারণা করা হয় ঐ সময়ে শহরটিতে বাস করতো প্রায় পনেরো লক্ষ অধিবাসী। আমি তখন পরিচিতি লাভ করলাম বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাচুর্য্যময় এবং উন্নত শহর হিসেবে।
কিন্তু কিছু রাজনৈতিক এবং কৌশলগত কারণে ৭৯৬ সালে খলিফা হারুনুর রশিদ তাঁর রাজধানী আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে যান সিরিয়ার রাকায় (Raqqa)। তারপর থেকে ধীরে ধীরে উন্নয়নের কিছুটা ভাটা পড়তে থাকে আমার। হারিয়ে ফেলতে থাকি আমার কিছুটা খ্যাতি। কিন্তু একেবারে হারিয়ে ফেলিনি আমার মর্যাদা।
আমার স্থবিরতা এবং ধ্বংস
দশম শতাব্দীতে আমার জনসংখ্যা কমে দাঁড়ায় পাঁচ লক্ষের মতো। এর প্রধান কতোগুলো কারণ ছিল। প্রথম কারণটি হলো, পরবর্তীকালে খলিফা হারুনুর রশিদের শাসনের অনেক পরে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী আমার কাছ থেকে স্থানান্তর করে ১২৫ কিঃ মিঃ দূরে সামারাতে নিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয় কারণটি ছিল, খলিফার শাসনের আভ্যন্তরীন কিছু সমস্যা। তৃতীয় কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, খলিফার পূর্ব এবং পশ্চিমের কিছু প্রদেশ হারানো। চতুর্থ কারণ ছিল, আব্বাসীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে ইরান এবং তুর্কী রাজবংশের ক্রমাগত প্রভাব। এতদসত্ত্বেও, ১২৫৮ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারী মঙ্গোল হালাকু খানের আক্রমণের আগে পর্যন্ত আমি ছিলাম ইসলামী বিশ্বের অন্যতম একটি সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল।
আমার এবং আমার অধিবাসীদের উপর মঙ্গোলরা ঘটায় পৃথিবীর ইতিহাসে এক নৃশংস হত্যাকান্ড এবং ধ্বংসযজ্ঞ। হালাকু খানের নেতৃত্বে মঙ্গোলরা হত্যা করে আব্বাসীয় খলিফা আল–মুস্তাসিম সহ আমার বেশীর ভাগ অধিবাসীকে। সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছিল আমার বিশাল এলাকা। আমার সেচ ব্যবস্থার জন্য নির্মিত খাল এবং জলাধারগুলোকে ধ্বংস করেছিল এক এক করে। আমি হলাম ক্ষত–বিক্ষত। আমার উপর মঙ্গোলদের এ আঘাত ইসলামী স্বর্ণযুগ তথা তখনকার এক আধুনিক সভ্যতাকে ধ্বংস করেছিল এমনভাবে যে, ইসলাম তা‘ আর কখনই পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করতে পারে নি।
এ ধ্বংসযজ্ঞের পর আমি শাসিত হতে থাকি ইরানকেন্দ্রীক মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্যের। মঙ্গোলরা আমাকে নতুন করে পুনর্গঠন করা শুরু করে, এবং আমি অচিরেই হয়ে উঠলাম আবারো এক সমৃদ্ধশালী শহর হিসেবে। কিন্তু হারিয়ে ফেললাম চিকিসাশাস্ত্র এবং জ্ঞান–বিজ্ঞানের কেন্দ্রস্থলের আগের সে মর্যাদা। কিন্তু আমার পুনর্নির্মাণ বেশীদিন স্থায়ী হলো না। আবার হলাম ধ্বংসের মুখোমুখি।
১৪০১ সালে আমাকে আক্রমণ করে তৈমুর লং, ধ্বংস করা হয় আমাকে আবারো। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত আমি শাসিত হই কখনও মঙ্গোল, কখনও পারস্য, আবার কখনও তুর্কীদের দ্বারা। ১৫৩৪ সালে অটোমান তুর্কীরা জয় করে ফেলে আমাকে। অটোমানদের অধীনে প্রথম দিকে আমার অবনতি হতে থাকে ধীরে ধীরে। এর প্রধান কারণ ছিল তুর্কী শাসকের সাথে পারস্যের শত্রুতা। এ সময় আমি ছিলাম প্রাচ্যের বৃহত্তম শহর। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে মামলুক রাজবংশের অধীনে আমি আবার পেতে থাকি হারানো মর্যাদা। আমি ফিরে পেতে চেষ্টা করলাম আমার হারানো গৌরব। গড়ে উঠতে চেয়েছিলাম আবারো বিশ্বের জ্ঞান–বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে। এরই মধ্যে টাইগ্রিস নদী দিয়ে গড়িয়ে গেলো অনেক জল।
বিংশ শতাব্দীতে আমি
চলে আসলো বিংশ শতাব্দী। ১৯০৭ সালে আমার জনসংখ্যা দাঁড়ালো মাত্র ১৮৫,০০০ তে। ১৯২১ সালে ব্রিটিশ শাসনের আগ পর্যন্ত আমাকে শাসন করেছে অটোম্যানরাই। ব্রিটিশরা আরব এবং কুর্দীদের নির্দয়ভাবে দমন করে জোরপূর্বক শাসন করে আমাকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত। ১৯৩২ সালে ইরাক স্বাধীনতা পায়। ১৯৫০ সালে আমার জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ লক্ষ আশি হাজারে। সত্তর দশকের প্রথম থেকেই জ্বালানী তেলের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমি হয়ে উঠলাম আবারো এক প্রাচুর্যময় শহরে। দ্রুত রূপান্তরিত হলাম একটি সম্পদশালী নগরে। দুর্ভাগ্য, আধুনিক নগর হিসেবে আমার এ পুনর্জাগরনের স্থায়িত্ব হয় মাত্র দশ বছরের মতো। ১৯৭৯ সালে শুরু হয় ইরান–ইরাক যুদ্ধ। আমাকে আবার দাঁড় করানো হয় ধ্বংসের মুখোমুখি। আশির দশকে আমার হাজার হাজার অধিবাসী প্রাণ হারায় এ লক্ষহীন যুদ্ধে।
ইরান–ইরাক যুদ্ধ থেমে গেলেও ১৯৯১ সালে আমার সামনে হাজির হয় আরেক ধ্বংসযজ্ঞ: Gulf War। শুরু হয় আমাকে নিয়ে নতুন করে আরেক ধ্বংসলীলা। ভেঙে ফেলা হয় আমার আধুনিক সব নগর–ব্যবস্থা, উড়িয়ে দেয়া হয় আমার নগরবাসীর সব সুযোগ–সুবিধা। দশ বছর ধরে চললো এ ধ্বংস। এ ধ্বংসলীলা শেষ হতে না হতেই ২০০৩ সালে আমি আবার পড়লাম দখলদারীদের হাতে। মিথ্যা অজুহাতে বিদেশিরা দখল করে ফেললো আমাকে। লুন্ঠিত হতে থাকলাম বিদেশিদের হাতে সীমাহীনভাবে। আমি পুরোপুরি রূপান্তরিত হলাম এক ধ্বংস–নগরীতে। আজ অবদি চলছে আমার উপর এ লুন্ঠন এবং ধ্বংসযজ্ঞ। আমি জানি না আর কতকাল চলবে আমাকে নিশ্চিন্ন করার এ বোধগোম্যহীন পৈশাচিক প্রয়াস। সহজে হাল ছেড়ে দিবো না আমি আবারো স্বর্ণ শিখরে উঠার। আমি বাগদাদ, উঠে দাঁড়াবোই আবার!
তথ্যসূত্র:
* বাগদাদ উইকিপেডিয়া।
* রচয়িতার ১৯৮২–৮৩ সালে বাগদাদে অবস্থানের অভিজ্ঞতা।