১৯৬১ সালের জুন মাসের এক শনিবার। সেইবার সিডনিতে বেশ শীত পড়েছে। রেভারেণ্ড অ্যালান ওয়াকার তার সান্ধ্যকালীন পড়ালেখা শেষে কম্বল টেনে শুয়ে পড়েছেন। পাশের গীর্জা থেকে মধ্যরাত পেরিয়ে যাবার ঘণ্টাধ্বনি শোনা গেল। এর ঠিক পরপরই বেজে উঠল বসার ঘরে রাখা টেলিফোনটা। এতোরাতে কে ফোন দিতে পারে? হন্তদন্ত হয়ে উঠে ফোন ধরলেন অ্যালান। ফোনের অপরপ্রান্তে পুরুষকণ্ঠ- “হ্যালো! দিস ইজ ব্রাউন ফ্রম কিংক্রস…” বিষন্ন কণ্ঠে ব্রাউন থেমে থেমে শোনালেন তার ঋণে জর্জরিত জীবনের কথা, চাকচিক্যে ভরা এই শহরে একে একে সকল প্রিয়জন কিভাবে তাকে ছেড়ে চলে গেল সেই সব কথা। সমাজকর্মী ও সুবক্তা হিসাবে অ্যালান ততদিনে সিডনিবাসীর এক প্রিয় মুখ। তাই তাঁর কাছে এই যন্ত্রনাকাতর জীবন থেকে মুক্তির উপায় জানতে চাইলেন ব্রাউন। মধ্যরাতে এরকম আকুতিতে প্রথম ঘাবড়ে গেলেও সময় নিয়ে তাঁর সাধ্যমত বুঝানোর চেষ্টা করলেন অ্যালান। অবশেষে ব্রাউন, অ্যালানের সাথে ৩দিন পর মঙ্গলবার দেখা করবার বিষয়ে সম্মত হলেন। মঙ্গলবার দুপুরে পুলিশের একটা ফোন পেলেন অ্যালান। পুলিশ জানালো- কিংক্রস এলাকার এক ফ্ল্যাটে রয় ব্রাউন নামে এক ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন, তার মরদেহের সাথে অ্যালানকে লেখা একটা চিঠি পাওয়া গেছে। সেই গোটা চিঠি জুড়ে ব্রাউন বেঁচে থাকার অক্ষমতার কথা লিখে রেখে গেছেন।
আচমকা এরকম একটা ঘটনায় মুষড়ে পড়লেন অ্যালান। তাঁর কি কিছু করার ছিল এখানে? কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে কি আত্মহত্যা করতে ইচ্ছুক এই নিঃসঙ্গ, কপর্দকশুণ্য মানুষগুলোকে ফেরানো যায়?
কোনো কাজেই মন বসাতে পারছিলেন না অ্যালান। বন্ধু ও সমমনা ব্যক্তিদের সাথে দীর্ঘ আলোচনা চললো। অবশেষে ১৯৬৩ সালের মার্চে মানসিক সংকটে সহায়তা প্রদানের জন্য ২৪ ঘণ্টার এক ফোন সেবা চালু করলেন। নাম দিলেন ‘লাইফলাইন’। চালু করবার একদিনের মধ্যেই সেবা কেন্দ্রের পরামর্শদাতারা একশো’র বেশি ফোন কল পেলেন। একসময় এই সেবা সিডনি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে গেল অস্ট্রেলিয়ার সকল প্রদেশের রাজধানিতে। ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের কল্যাণে অ্যালানের এই উদ্যোগের কথা জানলো গোটা বিশ্ব। প্রতিষ্ঠার পর প্রায় ৫৬ বছর পেরিয়ে গেছে লাইফলাইন। লাইফলাইনের অনুরূপ উদ্যোগ বিবিধ নামে প্রসারিত হয়েছে বিশ্বের ৫০টি দেশে। অস্ট্রেলিয়ায় বর্তমানে এই সেবাতে প্রতিদিন ১৮০০ এর অধিক ফোন কল আসে যার মধ্যে অন্তত ৫০টি কল করেন আত্মহত্যার উচ্চঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিরা। যেকোন সামাজিক অস্থিরতা, আর্থিক মন্দায় এই কল সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। কল পরিসংখ্যানমতে নিঃসঙ্গ মানুষের হাহাকারে মা দিবসে আর বড়দিনে এই সেবা অনেক বেশি ব্যস্ত থাকে। ফোন সেবার পাশাপাশি অসহায় এই মানুষগুলোর জন্য লাইফলাইন গড়ে তুলেছে নিজস্ব পুনর্বাসন কেন্দ্র, হাসপাতাল, কর্মসংস্থান আর আবাসন ব্যবস্থা।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে- লাইফলাইনের এই বিশাল কর্মযজ্ঞের অর্থায়ন আসে কোথা থেকে? শুরুর সময়ে ধর্মীয় মিশনারিগুলো সহায়তা করলেও পরবর্তীতে নিজেদের তহবিল গঠনের জন্য গোটা অস্ট্রেলিয়া জুড়ে লাইফলাইন অনেক গুলো ওপি শপ বা অপরচুনিটি শপ গড়ে তুলে। এই দোকানগুলোতে দান করা পুরানো কাপড়, আসবাব, গৃহস্থালি দ্রব্যাদি থেকে শুরু করে বইপত্র সবকিছুই সুলভে বিক্রয় হয়। বিক্রয়লব্ধ সেই অর্থই সচল রাখে লাইফলাইন এর কার্যক্রম। মজার ব্যাপার হল এই প্রতিষ্ঠানের তহবিলের সবচেয়ে বড় অংশটি আসে পুরানো বইয়ের এক মেলা থেকে। মেলার নাম ‘লাইফলাইন বুকফেস্ট’।
১৯৮৯ সালে শুরু হওয়া এই মেলা Lifeline Bookfest বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম পুরানো বইয়ের মেলা। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে লাইফলাইনের উদ্যোগে আয়োজিত এই মেলায় নানাবিধ বিষয়ের মিলিয়ন মিলিয়ন বই বিক্রি হয়। মেলার আয়োজন ও কর্মযজ্ঞের বিশালতা চোখে পড়বার মত। ৭০০০ এর বেশি স্বেচ্ছাসেবকের নিরলস শ্রমের ফসল এই বই মেলা। তারা সময় নিয়ে এই লক্ষ লক্ষ বই বিষয়ভিত্তিক ভাবে দীর্ঘ ডেস্কগুলোর ওপরে সাজিয়ে রাখেন। দর্শক, ক্রেতারও উৎসাহের সীমা থাকে না। মেলার দরজা খুলবার আগে থেকেই যে যার থলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। স্বাভাবিক কারণে ইংরেজি ভাষার বই-ই সবচেয়ে বেশি থাকে, তবে অন্যান্য ভাষারও কিছু বইয়ের সংগ্রহ লাইফলাইন প্রদর্শন ও বিক্রি করে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে পুরানো হলেও সংগৃহিত বইগুলো নতুনের মতই চকচকে অবস্থায় থাকে। আর এর দাম থাকে একদম নাগালের ভেতরে। একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ২০১২ তে ব্রিসবেনে আয়োজন করা এই মেলা থেকে একটা বই কিনেছিলাম, নাম- “Treasures from the World’s Great Libraries”। ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব অস্ট্রেলিয়ার শতবর্ষ উপলক্ষে বিশ্বের ৩৮টি বিখ্যাত লাইব্রেরি তাদের উল্লেখযোগ্য মূল্যবান সংগ্রহসমূহের এক প্রদর্শনী আয়োজন করে সিডনিতে। প্রদর্শিত সামগ্রীর কিছু ছবি ও বিবরণ নিয়েই তৈরি হয়েছিল এই স্মারক গ্রন্থ। ৩৫ ডলার মূল্যমানের এই বই ‘লাইফলাইন বুকফেস্ট’ এ সংগ্রহ করি মাত্র ৪ ডলারে। মেলার শেষদিন স্টক খালি করবার জন্য লাইফলাইন যা করে তা বই প্রেমিকদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। তারা বিভিন্ন আকারের খালি বাক্স বিক্রি করে যেটাতে ভরে ক্রেতারা বই সংগ্রহ করেন। সবচেয়ে ছোট বাক্সটির জন্য আপনাকে পরিশোধ করতে হবে মাত্র ৫ ডলার। এই বাক্সে যে কয়টা বই আপনি পছন্দ মত ভরতে পারবেন তার সবটাই আপনার। দেখা যায় ১০-১২টা মধ্যম আকারের বই খুব সহজেই তাতে এঁটে যায়।
বিক্রয়ের জন্য এই অসংখ্য বই লাইফলাইনের স্বেচ্ছাসেবকরা যোগাড় করেন নানাভাবে। ওপি শপে দান করা বই এর পাশাপাশি আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ উৎস হল আবাসিক এলাকার রাস্তার পাশে “ফ্রি বুকস”লেবেল লাগানো বাক্সগুলো। পাঠ শেষে বইয়ের মালিক তার পুরানো হয়ে যাওয়া বইটা রেখে দেন উল্লেখিত বাক্সে; সেখান থেকে আগ্রহী যে কেউ পড়বার জন্য বই তুলে নিতে পারেন। দেখা যায় পাঠচক্রের কোনো একটি পর্যায়ে বইটির পাঠক লাইফলাইনের মাধ্যমে দাতব্য তহবিল গঠনে সামান্য হলেও অবদান রাখেন।
আপনার, আমার সংগ্রহের এমন অনেক বই নিশ্চয়ই আছে যার প্রয়োজন আমাদের কাছে ফুরিয়েছে, কিন্তু বিবিধ কারণে অন্য কোনো পাঠকের হয়তো তা হাতের নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে।নতুন বইয়ের মূল্যের ক্রমাগত উর্ধ্বগতি যেখানে আমাদের ক্রয়ক্ষমতাকে উপহাস করে চলেছে সেখানে লাইফলাইনের মতন একটা মানবিক উদ্যোগ নিঃসন্দেহে আমাদের বইয়ের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি মানুষের পাশে দাঁড়ানোরও সুযোগ করে দিবে।