১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে একটি বিরাট প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। দেশ বিদেশ থেকে বহু ব্যবসায়ী ও ক্রেতার দল এসে শহরটিতে ভীড় করেছেন। চোখ ও মনের আনন্দের খোরাক পাবেন এই ভরসায় বহু পরিব্রাজকেরও সমগম ঘটেছে শহরের বিভিন্ন হোটেলে। হোটেল ব্যাবসাও রমরমা। কোন হোটেলেই তিল ঠাঁই আর নাহিরে। শহরটি অনিন্দপিপাসু লোকে বেশ সরগরম।

মার্সেইজ থেকে এক ইংরেজ মা ও মেয়ে এসেছেন প্যারিসে। তারা দুজনেই ভারত থেকে দিন কতক আগে পৌঁছেছেন। প্যারিসের সব চাইতে অভিজাত একটি হোটেলে তারা দুটি একক ঘর ভাড়া নিয়েছেন। রেজিস্ট্রি খাতায় সই করার পর দোতালায় তাদের নিজ নিজ ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। ৪৪২ নম্বর ঘরে রইলেন মা। পাশেরটি নির্ধারিত হল মেয়ের জন্য। মায়ের ঘরটি বিলাসবহুল প্রাচুর্যে সাজানো ! দরজা জানালায় প্লাম রঙের উজ্জ্বল ভারী মখমলের পর্দা ঝুলছে। গোলাপী দেওয়ালপত্র দিয়ে দেওয়ালগুলি মোড়া। ঘরের একদিকে উচু পিঠওয়ালা সোফা সাজানো। দৃষ্টি ও মন কেড়ে নেয় এমন সব সুন্দর সুন্দর গদি। ডিমের আকৃতি বিশিষ্ট একটি টেবিল রয়েছে ঘরের শোভা বর্ধন করতে । টেবিলটিও দামী সাটিন কাঠের তৈরী। একটি অরমূল ঘড়িও টিকটিক করে বেজে চলেছে ঘরের দেয়ালে চতুর্দিক পরিপাটি। ঘরে ঢুকলেই মন ভরে ওঠে।বয়স্ক মহিলাটি দীর্ঘ ভ্রমণের পর মনে হয় শ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। এখানে আসার পর তিনি রীতিমত অসুস্থও বোধ করেন। অবসাদে অবশেষে তিনি বিছানায় গড়িয়ে পড়েন। তার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে হোটেল ম্যানেজার হোটেলের ডাক্তারকে নিয়ে সেই ঘরে এসে হাজির হলেন। রোগীকে পরীক্ষা করা সারা হলে ডাক্তার মেয়েটিকে নানা প্রশ্ন করলেন। তারপর উত্তেজিত ডাক্তার ম্যানেজারের সঙ্গে একটু আড়ালে গিয়ে ফিসফিস করে কি যেন আলোচনা করলেন। মেয়েটি যদিও ফরাসী ভাষা বুঝতে বা বলতে পারতো না, তথাপি ডাক্তারের ধীরে ধীরে বানান করে বুঝিয়ে দেওয়া পরামর্শ সহজেই ধরতে পারলো। ডাক্তার তাকে জানালেন যে তার মা গুরুতর অসুস্থ। তার বিশেষ একটি ওষুধের প্রয়োজন। ওষুধটি ডাক্তারের নিজের চেম্বার ছাড়া অন্য কোথায় পাওয়া যাবে না। ডাক্তারের চেম্বারটিও বেশ দূরে। শহরের প্রায় অন্য প্রান্তে অবস্থিত। যেহেতু ডাক্তার গুরুতর অসুস্থ রোগীণীকে ফেলে যেতে পারছেন না সেহেতু মেয়েটি যেন নিজেই গিয়ে তার চেম্বার থেকে ওষুধটি সংগ্রহ করে আনে। তিনি আরো জানালেন যে, তার নিজের ঘোড়ার গাড়িটি বাইরে অপেক্ষা করছে। কাজেই তার যাতায়াতের কোন রকম অসুবিধা হবে না ।মেয়েটি ডাক্তারের ঘোড়ার গাড়ীতে যাত্রা শুরু করলো। ঘোড়া দুটো অত্যন্ত ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে। ঘোড়ার এই মন্থর গতি মেয়েটিকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে তুললো। মায়ের অসুস্থতার জন্য উদ্বেগে এমনিতেই মেয়েটি রুদ্ধশ্বাস হয়ে আছে — কখন পৌছাবে , কখন ওষুধ নিয়ে মায়ের কাছে ফিরে যাবে ! চিন্তা ভারাক্রান্ত মেয়েটি বুঝি পাগল হয়ে যাবে ! পথে গাড়ীটি কোন একটি অফিসের কাছে দাঁড়ালো। মেয়েটি ভেবে পায় না — কি কারণে গাড়ীটি এখানে দেরী করছে। তার অস্থিরতা যেন আরো বেড়ে গেল। অবশেষে তার প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে গাড়ীটি আবার চলতে শুরু করল ও শেষ পর্যন্ত ডাক্তারের চেম্বারে এসে গাড়ী থামলো। তাড়াতাড়ি অষুধ নিয়ে মেয়েটি ফিরে চললো। কিন্তু কোচোয়নি ঠিক আগের মতই ধীর গতিতে গাড়ী চালিয়ে চলেছে। মেয়েটির হাজার তাগাদায়ও গাড়ীর গতি একটুও বাড়ালো না।

ওষুধ নিয়ে মেয়েটি যখন ফিরে এলো — চার ঘন্টা সময় কোথা দিয়ে অতিবাহিত হয়ে গেছে সে বুঝতেই পারলো না। তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় মেয়েটি রীতিমত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। হোটেলে পৌছে সে লাফিয়ে গাড়ী থেকে নামলো। ছুটে গেল ম্যানেজারের কাছে মায়ের সংবাদের জন্য। ‘কেমন আছেন আমার মা ‘ ? — জিজ্ঞাসা করলো সে ।

‘কার কথা আপনি জানতে চাইছেন মহাশয়?’ পাল্টা প্রশ্ন করলেন ম্যানেজার।ম্যানেজারকে নিজের ও মায়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বারবার তার বিলম্বের কারণ ব্যক্ত করলেন। তাকে বিস্মিত করে দিয়ে ম্যানেজার বললেন, ‘মহাশয়া , আপনার মায়ের সম্বন্ধে তো আমি কিছুই জানি না। আপনি তো একাই এখানে এসেছেন।’

অবিশ্বাস্য। মেয়েটি প্রতিবাদ করে উঠলো । ঘন্টা ছয়েক আগে আমরা দুজনে আপনার রেজিস্ট্রি খাতায় নাম সই করেছি। বইটি দয়া করে বের করে দেখুন।’

ম্যানেজার ধীরে সুস্থে বেশ সময় নিয়ে খাতা খানা বের করলেন। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টিয়ে এক একটি নামের নীচে অঙ্গুল বুলিয়ে ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে তার মায়ের নামের খোঁজ করলেন। নির্দিষ্ট একটি পৃষ্ঠার মাঝামাঝি তার নিজের সই মেয়েটি দেখতে পেল। কিন্তু তার মায়ের সইটি হাজার খুঁজেও আবিস্কার করতে পারলো না। বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে সে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো যখন সে দেখলো তার মা যে স্থানে সই করেছিলেন ঠিক সেই জায়গাটিতে অন্য একজনের নাম লেখা। মেয়েটি বার বার বলতে থাকলো, ‘আমরা দুজনেই সই করেছিলাম। আমার মাকে ৪৪২ নং ঘরটি দেওয়া হয়েছিল। তিনি এখনও ওখানেই আছেন। দয়া করে আমাকে সেখানে নিয়ে চলুন।’ম্যানেজার তাকে জানালেন যে ঘরটি এখন একটি ফরাসী পরিবারের দখলে। মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি দোতালায় গেলেন। নির্দিষ্ট ঘরে ঢুকে সে রীতিমত বাকরুদ্ধ হয়ে গেল ! ঘরটিতে অপরিচিত লোকের ব্যবহারের জিনিসপত্রে ঠাসা । তার মায়ের কিংবা তার জিনিসপত্রের নাম নিশানাই নেই। ঘরের পূর্বেকার পরিবেশও কেমন যেন ম্যাজিকের মত বদলে গেছে। দরজা জানালায় প্লাম রঙ্গের ভারী পর্দার কোন চিহই নেই। গোলাপী ওয়াল পেপারে আবৃত দেয়ালের রং ও ঘন্টা চারেকের ভিতর পাল্টিয়ে গেছে। উচু পিঠওয়ালা সোফাগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে। আর অরমূল ঘড়িটিও যেন কোন যাদুমন্ত্রে কোথায় চালান হয়ে গেছে।

ছুটে নীচে নেমে এসে মেয়েটি ডাক্তারকে ধরলো। ‘কোথায় আমার মা? আকুল হয়ে বার বার ডাক্তারকে প্রশ্ন করতে থাকলো। তার মায়ের ভাগ্যে কি ঘটলো তা জানবার জন্য সে ব্যগ্র হয়ে উঠলো। তাগাদা দিয়ে সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললো। ডাক্তারও সব কথা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করলে। তিনি এমন ভান করলেন যেন মেয়েটিকে জীবনে এইমাত্র প্রথম দেখলেন। তিনি বার বার শপথ নিয়ে বলতে থাকলেন যে তিনি তার মাকে জীবনে কখনও দেখেননি, বা রোগী হিসাবেও তার চিকিৎসা করেননি।

অনন্যোপায় হয়ে মেয়েটি ঘটনাটি স্থানীয় বৃটিশ রাষ্ট্রদূতের গোচরে আনলো। তিনি তার এই অভিযোগ বিশ্বাস করতে পারলেন না। এমনকি মেয়েটি পুলিশ কিংবা সংবাদপত্র ওয়ালাদেরও তার বক্তব্য বিশ্বাস করাতে পারলো না।এই ঘটনার ব্যাখ্যা কে কিভাবে দিবেন জানি না । কিন্তু একটি ব্যাখ্যা এভাবে দেওয়া যায়। মেয়েটির মা হয়তো বা ভারত থেকে প্লেগ রোগ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে তার দেহের বিভিন্ন উপসর্গ থেকে সহজেই তা ধরতে পেরেছিলেন। হোটেল ম্যানেজারের সঙ্গে গোপনে পরামর্শ করে সংবাদটি তারা চেপে যান। ঐ সময় সংবাদটি যদি তারা গোপন না করতেন তবে প্যারিসের, সেই জমজমাট প্রদর্শনীটাই ভণ্ডুল হয়ে যেত। আতঙ্কিত লোক প্রাণ ভয়ে প্রদর্শনী ফেলে শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করলে হোটেল ব্যবসায়ীদের ব্যবসাও মার খেতো ভয়ানক ভাবে। দু’পয়সা কমানোর পথ বন্ধ হলে ডাক্তার ও ম্যানেজার উভয়েরই হত বিপুল লোকসান। কিন্তু তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়। এই ৪ ঘন্টার মত এত অল্প সময়ের মধ্যে ৪৪২ নং ঘরটিকে আবার নতুন আঙ্গিকে, নিখুঁতভাবে সাজানো কি সম্ভবপর ছিল ? মায়ের মৃত দেহেরই বা কি হল ? মেয়েটি কি তাহলে অকারণে বানিয়ে বানিয়ে মায়ের কাহিনী বলেছিলেন ? কি তার স্বার্থ ? এ রহস্য জাল কি কোন দিন উন্মোচিত হবে ? বেরিয়ে আসবে কি সত্য ঘটনা ?