সোনারগাঁও এর প্রাচীন নাম সুবর্ণগ্রাম। শীতলক্ষ্যা, মেঘনা, ইছামতি ও ব্রহ্মপুত্র বেষ্টিত প্রাচীন এই জনপদ বহিঃশত্রুর কাছে ছিলো দুর্ভেদ্য। সোনারগাঁয়ের পানাম নগর বিশিষ্ঠ ছিলো নানান কারণে ।
রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি সোনারগাঁয়ে প্রথম রাজ্য স্থাপন করেন রাজা দনুজমাধব দশরথ দেব। রাজধানী সোনারগাঁও ছিলো প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার সঙ্গমস্থলের স্থলভাগে ।
১২৮০ সালে বিদ্রোহী তোগরলকে দমনে দিল্লী থেকে আসা বলবন শাহ- কে নৌপথে সাহাজ্য করেন এই দনুজ রায় বা দনুজ মর্দন।
তবে সোনারগাঁয়ের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের শুরু ১৩৩৮তে স্বাধীন মুসলিম সালতানাতের রাজধানী হওয়া থেকে। কিন্তু গুটি কয়েক স্থাপত্যকীর্তি ব্যতিরেকে কিছুই অবশিষ্ট নেই সুলতানি আমলের।
সোনারগাঁয়ের পানাম নগরের সন্নিকটে আছে এই গিয়াসুদ্দিনের সমাধি। বিমাতার চক্রান্তে রাজধানী পান্ডুয়া থেকে পালিয়ে এসে সোনারগাঁয়ে রাজত্ব স্থাপন করেন সুলতান সেকান্দার শাহ’র পুত্র গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ।
বিদ্রোহী পুত্রকে শায়েস্তা করতে এসে পিতা সেকান্দার শাহ ঘটনাচক্রে নিহত হন পুত্রের সাথে সমুখ সমরে। তবে মৃত্যুর আগে প্রাণপ্রিয় পুত্র গিয়াসুদ্দিনকে মার্জনা করে দিয়ে যান নিজে রাজ্য।
সুলতান গিয়াসুদ্দিনের ন্যায়পরায়ণতার কাহিনী একসময় পাঠ্য ছিলো স্কুলে। সুলতানের লক্ষ্যভ্রষ্ট তীরে মারা যায় এক বিধবার পুত্র। এর জন্য ক্ষতিপূরণের কাজীর কাছ থেকে শাস্তি মাথা পেতে নেন সুলতান।
গিয়াসুদ্দিন ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও কাব্যানুরাগী। ফার্সি কবি হাফিজকে তিনি আমন্ত্রণ সোনারগাঁয়। সাথে উপঢৌকন পাঠান মহামূল্যবান মসলিন। না আসতে পেরে সুলতানকে কবি উপহার পাঠান এক গজল। এই গজলের সূত্রে ফার্সি এক পর্যটক সোনারগাঁয় এসে মুগ্ধ হন পানাম নগরীর সৌন্দর্যে।
প্রাচীনকাল হতেই সমৃদ্ধ বানিজ্য নগর ছিলো সোনারগাঁও। চতুর্দশ শতাব্দীতে ‘দুর্ভেদ্য, দুরাক্রম্য’ সোনারগাঁয়ে এসে ইবনে বতুতা দেখতে পান জাভাদ্বীপে গমন্নোদ্যত সারি সারি বানিজ্যতরী।
১৫৮৪ সালে সুপ্রসিদ্ধ পর্যটক রাল্ফ ফিচ লিখেন, ” সোনারগাঁও পরগনাতেই ভারতবর্ষের সর্বোৎকৃষ্ট বস্ত্র প্রস্তুত হয়।’ জগদ্বিখ্যাত ছিলো এখানকার মসলিন।
তাঁর বর্ণনায় তৎকালে সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন মসনদে আলা ঈসা খাঁ।
ঈসা খাঁ পুত্র মুসা খা’র পতন হলে ১৬১১ তে সোনারগাঁ অধিকারে আসে মুঘলদের। নির্মাণ হয় সড়ক ও সেতু। পানাম সরাসরি যুক্ত হয় ঢাকার সাথে। রাজধানী যায় ঢাকায়, লোপ ও হ্রাস পায় সোনাগাঁয়ের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব।
১৮৩৯ সালে জেমস টেইলরের প্রতিবেদনে পানাম ছিল আম তেঁতুল বাঁশঝাড়ের ঘন পত্রপল্লবে আচ্ছাদিত ভুতুড়ে পল্লী। কয়েক গজের মধ্যে না আসলে কিছুই দৃষ্টিগোচর হয়না গ্রামের। শুষ্ক মওশুমে আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ রাস্তা, বর্ষায় অর্ধনিমজ্জিত কর্দমাক্ত। ছোট নৌকা বা হাতী ঘোড়ার পিঠে ছাড়া প্রবেশ করা দুঃসাধ্য।
রুগ্ন কৃশ চেহারার অধিবাসীদের এই পল্লী তখন জিলার সবচাইতে অস্বাস্থ্যকর বলে পরিগণিত। খড়ের ঘর ও তুই তিন তলা ইটের কোঠার দু’টো সারি নিয়ে গ্রামটি গঠিত।
অসংখ্য বদ্ধ খাল নালা পুকুর পুষ্কুরিনীতে পরিবেষ্টিত। একসময় হয়তো প্রতিরক্ষার জন্য পরিখা খনন করা হয়েছিলো। এরকমই এক খালের উপর পুরোনো এক পুলে পড়ে আছে এক তোরণের ধ্বংসাবশেষ। পানামের সমৃদ্ধির সময় বন্ধ করে রাখা হতো রাতে, খুলে দেয়া হতো সকালে।
পানামের নিকটেই ছিলো ব্যাঘ্র নেকড়ের চারণভুমি বিপদসঙ্কুল ঘন জঙ্গল আর এর মধ্য ধ্বংসুন্মোখ গুটিকয়েক মসজিদ ও অট্টালিকা।
প্রাচীনকাল হতেই সমৃদ্ধ বানিজ্য নগর ছিলো সোনারগাঁও। চতুর্দশ শতাব্দীতে ‘দুর্ভেদ্য, দুরাক্রম্য’ সোনারগাঁয়ে এসে ইবনে বতুতা দেখতে পান জাভাদ্বীপে গমন্নোদ্যত সারি সারি বানিজ্যতরী।
ঊনিশ শতকে কলে প্রস্তুত বিলাতি থান কাপড়ের ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে পানাম নগরের অভ্যুদয়ের ফলে সোনারগাঁও ফিরে পায় কিছুটা বাণিজ্যিক চাঞ্চল্য।
পানাম নগরের বর্তমান ভগ্নপ্রায় দালান কোঠা হচ্ছে ঊনিশ শতকে হিন্দু ব্যবসায়ীদের তৈরি আবাসিক ভবন। ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় নতুন উপনিবেশিক স্থাপত্য রীতিতে এগুলি নির্মিত।
এখনো টিকে আছে সড়কের উত্তর পাশে ৩১টি আর দক্ষিণ পাশে ২১টি বাড়ি। পানি সরবাহের জন্য দুপাশে ২টি খাল ও ৫টিপুকুর। অন্দর্মহল ও বহির্মহল, দুই ভাগে বিভক্ত বাড়ির চারদিকের ঘেরাটোপের ভিতর আছে উন্মুক্ত উঠান।
উত্তর-দক্ষিনে বিস্তৃত বাড়িগুলোর বারান্দায় কাস্ট আয়রনের নিখুঁত কারু কাজের রেলিং, মেঝেতে লাল,সাদা, কালো শ্বেতপাথর/টাইলস এ কারুকাজ। নগরীর মাঝ বরাবর পানাম সড়ক।
প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কুয়া। জলাবদ্ধ যাতে না হয়,খালের দিকে ঢালু, খাল অথবা জলাশয় সংলগ্ন স্নান ঘর। প্রতিটি বাড়ি অবস্থিত পরস্পর থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে।
১৯৬৫ তে পাক-ভারত যুদ্ধকালীন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হিন্দু মালিকানাধীন এই বাড়িগুলো হয় লুটেরাদেরসহজ লক্ষ্যবস্তু। দরজা-জানালা পর্যন্ত রক্ষা পায়নি লুট হতে। বাস্তুভিটা ছেড়। বাসিন্দারা রাতারাতি পাড়ি জমান সীমান্তের ওপাড়ে। জনমানব হীন হয়ে পড়ে পানাম নগরী। খসে পড়তে থাকে ইট আর ঝরে পড়তে থাকে আস্তর।
সেই শুরু,আর জেগে উঠেনি পানাম। নাম উঠেছে lost cityর তালিকায়। ধ্বংসপ্রাপ্ত একশ টি নগরীর ২০০৬ সালে করা তালিকায় (World monument fund কর্তৃক) অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এর নাম ।
তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে গৃহীত প্রকল্পের আওতায় ৪০টি ভবনের সংস্কার, ৪টি পুকুরঘাট মেরামত ও পুণর্নির্মাণ, সেতু সংস্কার, প্রত্নসামগ্রী ক্রয় ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তৈরির মাধ্যমে এই নগরীর পুণরুদ্ধার কাজ হাতে নেয়া হয়েছে।
এই নগরীর সাথে জড়িয়ে আছে ঈসা খাঁর গৌরবময় বীরত্বপূর্ণ স্মৃতি আর সর্বকালের বিশ্বসেরা বস্ত্র মসলিনের গৌরবময় ও করুণ ইতিহাস। এই নগরীকে ঘিরে মসলিনের ইতিহাস এর পরের পর্বে।
Contributed By: তপন রায়
পানাম নগরের খাল ও খালপাড়ে স্নান ঘর
পানাম নগরের খাল ও খালপাড়ে স্নান ঘর