পঞ্চম মোঘল সম্রাট শাহজাহান এবং মমতাজ মহলের চার পুত্র সন্তান দারা শিকো, শাহ সুজা, আওরঙ্গজেব এবং মুরাদ বক্স। মোঘল সিংহাসনের উত্তরাধিকারের দাবীতে তারা যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছিল তা ইতিহাসে এক সর্বজনবিদিত ঘটনা। চার সন্তানের মধ্যে সম্রাট শাহজাহান সবসময় তার প্রিয় পুত্র দারাশিকোকে ই প্রাধান্য দিতেন। তাই মোঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে দারাশিকোকেই মনোনীত করেন। বোন জাহানারা বেগমও তাই চেয়েছিলেন। জাহানারা বেগমের হারেম ও রাজ্য পরিচালনা উভয় ক্ষেত্রে ছিল অনেক ক্ষমতা। দারা তার সমর্থন পেয়েছিলেন l বাবার এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে বাকি তিন ভাই ছিলেন খুবই সংবেদনশীল এবং তাঁর কেউই মনে মনে এটা মেনে নিতে পারেনি। প্রথম থেকেই শাহজাহান চার ছেলেকে চার সুবাহর দাযিত্ব দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব ছিলেন দাক্ষিনাত্যের এবং শাহ সুজা ছিলেন বাংলার সুবেদার। দারা শিকো বিহারের সুবেদার থাকলেও বেশিরভাগ সময় বাবার পাশেপাশেই থাকতেন। সেই সময় আওরঙ্গজেব ও শাহ সুজার মধ্যে ছিল বেশ মিল এবং দুই ভাই নিজেদের মধ্যে একটি জোটও বাঁধেন। তারা ঠিক করেন, আওরঙ্গজেবের ছেলে শাহজাদা সুলতান মুহম্মদের সাথে শাহ সুজার মেয়ে গুলরুখ বানুর বিয়ে দিবেন। কিন্তু পরবর্তীতে এই কথা তারা আর রাখতে পারেননি।
১৬৫৭ সালে সম্রাট শাহজাহানের অসুস্থতার খবরটি ছড়িয়ে পড়েছিল তার মৃত্যুসংবাদ হিসেবে। এই খবর শোনার পরপরই বাংলা সুবাহর সুবেদার শাহ সুজা নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন। উত্তরাধিকারের যুদ্ধে ভাইয়ে ভাইয়ে শুরু হয় সংঘর্ষ। কিন্তু আওরঙ্গজেব ঠান্ডা মাথায় কাজ করলেন l তার প্রথম লক্ষ্য ছিল দারা শিকো l তাই প্রথমে শাহ সুজার দিকে মনোযোগ না দিয়ে পর পর দুটি যুদ্ধে দারা শিকোকে পরাজিত করেন এবং মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এই সময় তার সাথে ছিল ছোট ভাই মুরাদবক্স।
এরপর আসা যাক বাংলা সুবাহায়, শাহ সুজার কাছে। যুদ্ধ শুরু হয় দুই ভাইয়ের মধ্যে l আওরঙ্গজেবের সাথে শাহ সুজার যুদ্ধে শাহজাদা মুহাম্মদের যুদ্ধ করতে হয় নিজের চাচার বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধে তার বাবা তাকে মীর জুমলার অধীনে কাজ করার নির্দেশ দেন l নিজে সম্রাটের ছেলে হয়ে একজন সেনাপতির অধীনে কাজ করাটা ছিল তার কাছে চরম অপমানজনক l একজন সেনাপতির অধীনে কাজ করাটা শুধু তার মধ্যে অস্থিরতা ও অস্বস্তি তৈরী করেছিল। তার মন-কষ্টের কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে দেখা যায়, সেনাপতি মীর জুমলা ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ, কূটকৌশলী, চতুর। কোথাও কোথাও আমরা তথ্য পেয়েছি, আওরঙ্গজেবও মীর জুমলার এই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং সচেতন থাকতেন। একদিকে মীর জুমলার এই কর্তৃত্ব পরায়ণতা আর অন্যদিকে বাগদত্তা স্ত্রীর জন্য বিরহ হয়তো শাহজাদা মুহাম্মদের মনে একটি শূন্যতা তৈরী করেছিল, যা তার জীবনকে শুধু দুঃখময় করে তোলেনি, টেনে নিয়ে গিয়েছিলো ব্যার্থতার দ্বারপ্রান্তে। কি হয়েছিল তার সাথে? কি সেই ব্যার্থতা?
১৬৫৯ সাল। সেদিন ছিল ভীষণ বর্ষার রাত, চারদিকে ঘন অন্ধকার। তার মধ্যেই শাহজাদা মুহাম্মদ কয়েকজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে নদী পার হয়ে গঙ্গার পশ্চিমপাড়ের দোগাছির যুদ্ধের শিবির থেকে পালিয়ে হঠাৎ করে শাহ সুজার অস্থায়ী ঘাঁটি তাণ্ডায় গুলরুখের কাছে চলে আসেন। কেন? কারণ শাহজাদা সুলতান মুহম্মদের মনে ছিল শাহজাদী গুলরুখ বানুর জন্য প্রচন্ড ভালোবাসা। অনেক দিন তাদের মধ্যে কোন দেখা-সাক্ষাত হয়নি। তাই বাগদত্তা স্ত্রীকে দেখার বাসনায় তিনি যুদ্ধের মধ্যেই এই ঝুঁকি নেন। সুলতান মুহম্মদের আগমনে সবার মনে গুপ্তচরের সন্দেহ হলেও শাহ সুজা তার হবু জামাইকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন।
এখন দেখা যাক, এই ঘটনাটি মীর জুমলা কিভাবে নিলেন, তার তাঁবুতে কি হচ্ছে। মীর জুমলার সাথে সুলতান মুহম্মদের বরাবরই একটি দ্বন্দ্ব ছিল। শাহজাদা সুলতান মুহাম্মদের এভাবে শাহ সুজার ঘাঁটিতে চলে যাওয়া মীর জুমলাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দেয়। তিনি এই সংবাদটি আওরঙ্গজেবকে জানানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং জানিয়ে দেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব এই সংবাদটি সহজভাবে নিতে পারেননি। মনে মনে তিনি ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিলেন, কিন্তু তা প্রকাশ করেননি । বরং সুলতান মুহম্মদকে ফিরিয়ে আনার জন্য নানারকম চেষ্টা শুরু করেন আওরঙ্গজেব। কিছুদিন পরে সুলতান মুহম্মদ সুজার শিবির থেকে নিজে থেকেই ফিরে আসেন আওরঙ্গজেবের শিবিরে l ফেরত আসার পর আওরঙ্গজেবের নির্দেশেই তাকে বন্দি করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। এই কারাগারেই বন্দী অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছিল।
অন্যদিকে আওরঙ্গজেব তাদের দুই ভাইয়ের সন্ধির কথা ভুলে যান । শুরু হয় চরম যুদ্ধ। খাজোয়ার যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে শাহ সুজা পালিয়ে ঢাকায় চলে আসেন এবং এখানেই আশ্রয় নেন। কিন্তু সেখানেও রেহাই পেলেন না। আওরঙ্গজেবের নির্দেশে মোঘল সেনাপতি মীর জুমলা শাহ সুজার পিছু ধাওয়া করতে থাকেন। ১৬৬০ সালে সুজা প্রথমে ঢাকা এবং পরে সেখান থেকে আরাকানে পালিয়ে যান। সে সময় আরাকানের রাজা ছিলেন বৌদ্ধধর্মের অনুসারী সান্দা। পরিবারের সদস্য ও অনুগত কিছু সৈন্য সামন্ত, সেই সাথে প্রচুর সোনা, রূপা, হীরা জহরত সহ অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে শাহ সুজা নদীপথে হাজির হলেন চট্টগ্রামে। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তিনি স্থলপথে আরাকানের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তার স্মরণে এখনো ঐ পথটির নাম সুজা রোড। ভগ্ন হৃদয়ে শাহ সুজা স্বপরিবারে আরাকান রাজার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। এটি ছিল শাহ সুজার জীবনের এক চরম ভুল সিদ্ধান্ত। আরাকান রাজা প্রতিনিধি পাঠিয়ে তাদের রাজকীয় অতিথির মর্যাদায় বরণ করেন; তবে প্রথমেই শর্ত দিলেন তাদেরকে সকল অস্ত্র জমা দিতে হবে। রাজপ্রাসাদের অদুরে তাদের জন্য তৈরী আলাদা প্রাসাদে পরিবার পরিজন আর তার সহযাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা হল। অনেকের মতে, সুজার আরাকানে যাওয়ার একটি বড় কারন ছিল সেখান থেকে পবিত্র মক্কা শরীফ যাওয়া ও পবিত্র হজ্জ করে সেখানেই তাঁর শেষ জীবন কাটিয়ে দেয়া। আরাকান রাজা নিজস্ব জাহাজ বহরে করে অতিথির শেষ ইচ্ছা পুরন করবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন।
কিন্তু লোভী বর্মী রাজা তার সব প্রতিশ্রুতি ভুলে গেল। সে শুধু শাহ সুজার ধন সম্পত্তিই লুট করেনি, আরাকান রাজা শাহ সুজার অপরূপ সুন্দরী মেয়ে গুলরুখকে দেখেই তাকে পাওয়ার জন্য উম্মাদ হয়ে ওঠে। গুলরুখের অপরূপ রূপ দেখে বিস্মিত হয়েছিল রাণীমহলের রাণীরাও। আরকান রাজা মরিয়া হয়ে পড়েছিলেন গুলরুখকে পাওয়ার জন্য। বিয়ের প্রস্তাবও দেয়া হয়। কিন্তু একজন বর্মী রাজার সাথে মোগল শাহজাদীর বিয়ে হয় কি করে? তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া হয়। তাই চরম বিশ্বাসঘাতক আরাকান রাজা নিরস্ত্র অতিথিদের উপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। ১৬৬০ সালের ডিসেম্বরে, সেদিন মোঘলদের রক্তে ভিজে উঠেছিল আরাকানের মাটি । আরাকান সৈন্যরা শাহ সুজাসহ তার পরিবারের স্ত্রী ও তিন ছেলেকে বন্দী করে, পরবর্তীতে হত্যা করে।
কিন্তু আরাকান রাজার এই বেইমানির পেছনে যে শুধুমাত্র মোঘল ধন-সম্পদ বা শাহজাদী গুলরুখই একমাত্র কারণ ছিল এমনটাও হয়তো নয়। শাহ সুজাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্যে আওরঙ্গজেবের পক্ষ হয়ে সেনাপতি মীর জুমলা বারবার হুমকি দিচ্ছিলেন। মীর জুমলা আরাকানে আক্রমণ করে বসলে আরাকার রাজা হার ছিল একরকম নিশ্চিত। কিন্তু কারণ যাই হোক না কেন, মোঘল ইতিহাসের সেই নিষ্ঠূরতম দিনে আরাকান রাজার অত্যাচারের শিকার হয়েছিল বাংলায় সুবেদার শাহ সুজার প্রিয় কন্যা গোলাপ সুন্দরী গুলরূখ বানুও।
তার শেষ জীবন ও করুন মৃত্যুর ঘটনা লোককাহিনীতে আজও মিশে আছে। দুঃখের বিষয় হল, শাহজাদা সুলতান মুহম্মদ ও শাহাজাদি গুলরুখ বানু কেউ কাউকে পায়নি। ইতিহাসের অমোঘ নিয়তিতে কারও মৃত্যু হয় কারাগারে ধুঁকে ধুঁকে (অনেকের ধারণামতে তাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়), কেউ মৃত্যু বরণ করে চরম লাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে। মোঘল সাম্রাজ্যের এই বিয়োগান্তক ঘটনা দিল্লী থেকে রাজমহল, রাজমহল থেকে ঢাকা হয়ে আরাকানের নাফ নদীতে গিয়ে সলিল সমাধি হয়। রাজা-বাদশাহদের ইতিহাসগুলো বোধহয় এমনই কঠিন ছিল। যেখানে প্রেমের স্মৃতি ধরে রাখতে সম্রাট শাহজাহান গড়েন অপরুপ সুন্দর তাজমহল; সেখানে তার সন্তানদের মৃত্যু হয় কি করুন ভাবে l