মর্তের ভূ-স্বর্গ কাশ্মিরের বর্তমান চিত্র দেখলে বুকের মধ্যে শেল বাধেঁ। আজ কাশ্মীরে নারীরা নির্যাতিত। এই নির্যাতিত নারীদের প্রতি রইলো আমাদের সহমর্মিতা। হাজার বছরের ঐতিহ্যে ভরা এই কাশ্মিরের লোককাহিনিতে স্মরণীয় হয়ে আছেন হাব্বা খাতুন।

Habba Khatoon

ষোড়শ শতকে কাশ্মীরের শ্রীনগরের চন্দ্রহার গ্রামে সুফি কবি হাব্বা খাতুন জন্মগ্রহন করেন।গ্রামে তিনি পরিচিত ছিলেন জুন বা জুনি নামে। তিনি ছিলেন সে কালের সেরা সুন্দরীদের একজন, সবচেয়ে সুরেলা কণ্ঠের গানের বুলবুলির (হাব্বা খাতুনকেই বলা হতো নাইটিঙ্গল অব কাশ্মীর) সৌন্দর্য ও প্রতিভা তাঁর স্বামী আজিজ লোনিকে আকৃষ্ট করতে পারেনি, বরং স্বামী তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও সাংগীতিক প্রতিভার বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছেন শাশুড়ির হাতে। ভালোবাসার তাড়না ও বিড়ম্বনা, হৃদয়ের কান্না গীতিকবিতায় চয়ন করতে থাকেন এবং নিজের সুরে গাইতেও থাকেন।শেষ পর্যন্ত তাঁর স্বামী আজিজ লোনি তাঁকে পরিত্যাগ করেন।

তাঁর সেই সুর এবং সৌন্দর্য রাজকুমার ইউসুফ শাহ চাককে আকৃষ্ট করে, তিনি তাঁর প্রেমে পড়েন এবং বিয়ে করেন। রাজকুমার ক্ষমতাসীন হলে হাব্বা খাতুন রানি হন। কাশ্মীরের চন্দ্রহার গ্রামের দুস্থ এই নারীর অভাবনীয় এ প্রাপ্তি পশ্চিমের বিশ্লেষকদের কাছে ‘দ্য সিন্ডারেলা অব চন্দ্রহার’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

দিল্লির সম্রাট আকবর কাশ্মীরের আনুগত্য অর্জন করতে পারেননি। আকবর যখনই কাশ্মীর দখল করার চেষ্টা করেছেন, তখনই কাশ্মীরের শাসক ইউসুফ শাহ তার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছেন। অবশেষে আকবর তার কাছে সন্ধির পয়গাম প্রেরণ করেন। সভাসদদের পরামর্শে রাজা ইউসুফ শাহ চাককে দিল্লিতে আমন্ত্রণ করেন। চকের সহধর্মিণী হাব্বা খাতুন স্বামীর অমংগল আশংকায় তাঁকে দিল্লিতে যেতে বাধা দিয়েছিলেন কিন্তু ইউসুফ শাহ চক তাঁর কথা না শুনে মোগল বাদশাহর সম্মানে দিল্লি গেলেন। হাব্বা খাতুনের সন্দেহ বাস্তবে পরিণত হয়।

Yusuf Shah last ruler of Chak dynasty and Habba Khatoon

যে বিশ্বাস নিয়ে তিনি গিয়েছেন, সম্রাটের অনুচররা তা রক্ষা করেনি।
ইউসুফ শাহ চাক আর কখনো নিজ রাজধানী শ্রীনগরে ফিরে যেতে পারেননি। তাঁকে হত্যা করা হয়।
ব্যথিত হাব্বা খাতুন প্রাসাদ ছেড়ে ঝিলম নদীর তীরে একটি কুটিরে আশ্রয় নেন এবং আমৃত্যু বিরহ-বেদনা যন্ত্রণার গীত রচনা করেন, সুর দেন এবং গেয়ে যান।
হাব্বা খাতুনের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি—
 
বন্ধু এই যৌবন ফুরিয়ে যাবার
আমি পথেই ফুরিয়েছি সমস্ত দিন
কোথায় আমাদের জন্ম?
আমাদের মৃত্যু হয়নি কেন?
কেন আমাদের এত শ্রুতিমধুর নাম
এখন আমাদের অপেক্ষা—শেষ বিচারের দিন
 
হাব্বা খাতুন নামটি ইউসুফ শাহ চাকেরই দেওয়া। ১৬০৯ সালে ৫৫ বছর বয়সে আজওয়ান নামক স্থানে তাঁর মৃত্যু হয়। জম্মু-শ্রীনগর মহাসড়কের পাশে তাঁর সমাধি সাহিত্য প্রেমিকদের অন্যতম তীর্থ।

Habba Khatoon lived on the banks of the Jhelum for twenty years composing poems and songs about loss and separation.

 
কাশ্মীরি কবিতার উল্লেখযোগ্য সূচনা পুরুষের হাতে নয়, লালা কিংবা লালা দেদ নামের চতুর্দশ শতকের শিবপূজারি এক নারীর হাতে। হিন্দু যোগিনী এই কবিকে তাঁর সমকালীন বিখ্যাত সুফি পণ্ডিত শাহ হামদান একজন ‘সন্ত’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। শ্রীনগরে চতুর্দশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষভাগে তাঁর জন্ম, মৃত্যুর বছর ১৩৭৩। জীবনের দ্বাদশ বর্ষে বিবাহিত স্বামী নির্যাতিত লাল দেদ দ্বাবিংশ বর্ষে সংসারত্যাগী বৈরাগ্য আশ্রয়ী। তিনি তাঁর সৃষ্টিতে ও মানবিক গুণে এতটাই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন যে তিনি মুসলমানের কাছে লালা আরিফা, হিন্দুর কাছে লালা দিদি, যোগীর কাছে লালা যোগেশ্বরী। লালা দেদের পর কাশ্মীরের প্রধান কবি হিসেবে সমাদৃত হন ষোড়শ শতকের একদা কৃষককন্যা স্বামী পরিত্যক্ত হাব্বা খাতুন, নিয়তি যাকে রাজরানির আসনেও বসিয়েছিল।
 
কাশ্মিরকে ‘জান্নাতুল আওলিয়া’ বা ওলিদের বেহেশত বলা হয়। শ্রীনগর থেকে মুজাফফরাবাদ পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মিরের শহরে শহরে, গ্রামে গ্রামে আওলিয়া-মাশায়েখের অসংখ্য মাজার নজরে পড়ে। এ অঞ্চলে ইসলাম তরবারি দিয়ে নয়, বরং জম্মুর হজরত বুলবুল শাহ রহ., সায়্যিদ মীর আলী হামাদানী রহ., শায়খ নুরুদ্দীন ওলি রহ., শায়খ শামসুদ্দীন ইরাকি রহ. ও হজরত বাবা জিউন শাহ রহ.-এর মতো সুফিদের শিক্ষার মাধ্যমে ছড়িয়েছে।
এটা সেই অঞ্চল, যেখানে অধিকৃত অঞ্চলে লিল্লাহ আরেফা ও হাব্বা খাতুন এর মতো নারী সুফিদের কবিতা আজো মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়।
আজাদ কাশ্মিরে হজরত মায়ী উম্মী রহ. ও হজরত মায়ী তুতী সাহেবা রহ.-এর মাজারে ভক্তদের ভিড় এ কথা বলার জন্য যথেষ্ট যে, এখানে নারীদের বেশ সম্মান করা হয়।

Grave