ইসলাম খান চিশতি যখন ঢাকায় সুবেদার হয়ে আসেন, তখন শাসন কাজের পাশাপিাশি তিনি দিল্লীর মুঘল দরবারের মতন আনন্দ-বিনোদনের জন্য ঢাকায় প্রথম দরবারী নাচ-গানের আসর চালু করেন। তাঁর দরবারে নিয়মিত নাচ-গানের আসরে ‘লুলি’, ‘কাঞ্চনী’, ‘হরকানী’, ও ‘ডোমিনী’ নামে হাজারের বেশি নৃত্যশিল্পী ছিল। যাদের জন্য প্রতিমাসে সেই সময়ের হিসেবে ৮০ হাজার রুপি খরচ হতো। ১৬ শতকে ঢাকার এইসব নৃত্যশিল্পীদের সুনাম পুরো ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি সম্রাট জাহাঙ্গীর ঢাকার নৃত্যশিল্পীদের সুনাম শুনে, ইসলাম খানকে ঢাকার কয়েকজন নৃত্যশিল্পীকে দিল্লীতে পাঠানোর অনুরোধ করেন। এখান থেকেই ঢাকার বাঈজীদের ইতিহাস শুরু। তারপর নবাবী আমলে ঢাকার আহসান মঞ্জিলের রংমহল, শাহবাগের ইশরাত মঞ্জিল, দিলকুশার বাগানবাড়ি ছিল নৃত্য-গীত ও বাঈজীদের রমরমা অবস্থা। উনিশ শতকে ঢাকার শাহবাগে প্রথম নবাব আব্দুল গণির এক অনুষ্ঠানে বিখ্যাত মুশতারী বাঈ সঙ্গীত ও এলাহীজান বাঈজী নৃত্য পরিবেশন করেন। লেখক হাকিম হাবিবুর রহমান এসব দেখেছিলেন এবং তার বইতে তা লিখে রেখে গেছেন। নবাব গণির দরবারে আরো যেসব বাঈজীরা নাচ-গান করতেন তাদের মধ্যে পিয়ারীবাঈ, হীরাবাঈ, ওয়ামুবাঈ, আবেদী বাঈ, আন্নু নান্নু ও নওয়াবীন বাঈ প্রমুখ বিখ্যাত ছিলেন। এছাড়া আরো ছিলেন বাতানী, জামুরাদ, পান্না, হিমানী, আমিরজান, রাজলক্ষ্মী, কানী, আবছন বাঈজী প্রমুখ। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো গহরজান বাঈজী, যিনি ১৮৯০ সালে ঢাকার কাজী বাড়ির এক বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। তিনিই ছিলেন উপমহাদেশে গ্রামোফোন রেকর্ডে কণ্ঠদানকারী প্রথম মহিলা শিল্পী।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে বীরবল সম্রাট আকবরের দরবারে এসেছিলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার প্রতিভা ও যোগ্যতার জন্য রাজা উপাধি পান। বীরবলের মাঝে সম্রাট আকবর দেখেছিলেন এক অসাধারণ ব্যাক্তিত্ব, প্রাণবন্ত মন, আকর্ষিক বুদ্ধিমত্তা আর সব থেকে বড় যে জিনিসটা ছিল তা হল, সম্রাটের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও নিষ্ঠা। বীরবলের অসাধারণ কবি প্রতিভার জন্য তাকে কবি রাই বা কবিদের রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন আকবর। তিনি ব্রজের একজন কবি ছিলেন আর সম্রাটের দরবার বীরবলের কবিতায় মুখরিত হয়ে উঠতো। তিনি একজন উদার মনের মানুষও ছিলেন। তার এতো সব প্রতিভার কারণেই মোঘল দরবারে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিতে সময় লাগেনি।
আমরা আরো দেখতে পায় ঢাকার আরেক নামকরা বাঈজী দেবী বাঈ ঢাকার প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র “দ্য লাস্ট কিস” (১৯৩১)-এ অভিনয় করেছিলেন। বাঈজীদের জীবনে যেমন হাসি-আনন্দ আছে, তেমনি আছে দুঃখ-বেদনারও ইতিহাস। কোন কোন বাঈজী সামাজিক কল্যাণমূলক কাজের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। বাঈজী অর্থ পেশাদার নর্তকী ও গায়িকা। সেকালে বাঈজীরা তাদের নিজগৃহে আসর বসিয়ে অথবা বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে, নবাব, রাজা, মহারাজা, জমিদারদের দরবারে মাহফিলে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নাচ-গান পরিবেশন করতেন এবং কিছু নবাব, জমিদারদের রঙমহলে, বাগানবাড়িতে একবারে নিয়োগ করা বাঈজীরা নাচ-গান করতেন। এমনকি ১৮২৩ সালে রাজা রামমোহন রায়ের বাগানবাড়ীতে নিকি বাঈজী নাচ-গান করেছেন বলেও জানা যায়। সে সময়ে বৃটিশ ও ফরাসী চিত্রকররা প্রচুর ঢাকার বাঈজীদের ছবি একেঁছেন। বেশির ভাগ বাঈজীই রাগসঙ্গীত ও শাস্ত্রীয় নৃত্য বিষয়ে শিক্ষা নিতেন। ঢাকা, লখনৌ, এলাহাবাদ, বেনারস, আগ্রা, কলকাতা, দিল্লী প্রভৃতি শহর ছিল বাঈজীদের জন্য বিখ্যাত।
ঢাকার জিন্দাবাহার লেন, ইসলামপুর ও পাটুয়াটুলী, ওয়াইজঘাট, বুড়িগঙ্গা নদীতীরের গঙ্গাজলি এলাকায় সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে বাঈজীদের নুপুরের ঝঙ্কার ও গানে সমস্ত পরিবেশ মুখরিত হয়ে উঠত। জিন্দাবাহার লেনের দেবী বাঈজী ও হরিমতি বাঈজীর নাম উল্লেখ্যযোগ্য। জানা যায়, গঙ্গাজলির দোতালা প্রশস্ত বাড়ীগুলোর নীচতলায় বাঈজীদের কাজের লোকেরা থাকতো, আর বাঈজীরা থাকতেন দোতালায়। বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হতো। বারান্দায় পাতা থাকত ইজি চেয়ার। বাঈজীদের খাস কামরা সাজানো থাকত শান শওকতে ও ফরাশ বিছানো। সকালে তারা দল বেধে বুড়িগঙ্গা নদীতে যেতেন গোসল করতে। এই সব দৃশ্য ও তাদের কথা নাট্যকার সাঈদ আহমেদ, হাকিম হাবিবুর রহমান, সত্যেন সেন সহ অনেকে তাদের রচনায় বর্ণনা করে গেছেন। যাইহোক, নবাব, রাজা, মহারাজাদের পতনের কারণে এবং সময়ের বিবর্তন ও মূল্যবোধের পরিবর্তনে নবাবী আমলের বাঈজীদের সেই আলো ঝলমল করা রঙমহল আর নেই ঠিকই কিন্তু তাদের উত্তরসূরী এখনো রয়ে গেছে।