গাছপালার আলোচনা উঠলেই বাঙালীর আরেক গর্ব জগদীশ চন্দ্র বসুর কথা চলে আসে আগেভাগেই। জগদীশের জন্ম ১৮৫৮ সালে বর্তমান বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরে। তিনি একাধারে ছিলেন একজন সর্ববিদ্যাজ্ঞ (polymath), পদার্থবিদ, উদ্ভিদবিদ, এবং নৃতত্ত্ববিদ। জগদীশকে বলা হয় প্রথম ভারতীয় আধুনিক বিজ্ঞানী। তিনি ছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞান, রেডিও এবং মাইক্রোওয়েভ গবেষণায় বিশ্বের একজন দিকপাল। ভারতীয় উপমহাদেশে বিজ্ঞান গবেষণার ভিত্তি রচিত হয়েছে বলতে গেলে তারই হাত ধরে। বাংলায় প্রথম সায়েন্স ফিকশনও লিখেন জগদীশই। তিনি ১৯২১ সালে তার লেখা “পলাতক তুফান” নামে বাংলার প্রথম সায়েন্স ফিকশনটি প্রকাশিত করেন। ২০০৪ সালের বিবিসি’র এক জরিপে জগদীশের স্থান হয় সপ্তম “সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালী” হিসেবে।
তিনি বিশ্বের খ্যাতনামা বিদ্যাপীঠ, যেমন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন এবং নোবেল বিজয়ী লর্ড রেইলি’র (Lord Rayleigh) মতো বিশ্ব বরেণ্যদের সাথে গবেষণা করেন। জগদীশ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন। সেখানে তিনি ইংরেজদের কাছে জাতিগত বৈষম্যের শিকার হন। শুধু তাই নয়, পর্যাপ্ত অর্থ এবং সরঞ্জামের অভাব সত্ত্বেও জগদীশ তার বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালিয়ে গিয়েছিলেন। এত বাধা সত্ত্বেও, জগদীশের নতুন নতুন উদ্ভাবনকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং অদম্য।
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর বাড়ি
লিওনার্ড দ্যা ভিঞ্চিকে যেমন অনেকে শুধুমাত্র চিত্রকর (painter) হিসেবে জানে, তেমনি আমাদের অনেকের কাছে জগদীশও শুধুমাত্র একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হিসেবেই বেশী পরিচিত। কিন্তু তারা যে এর চেয়েও আরো অনেক বড় জ্ঞানী এবং মহান ছিলেন, তা হয়তো আমাদের অজানা। আমরা জানি, জগদীশই প্রথম আবিষ্কার করেন যে গাছ সংবেদনশীল এবং গাছেরও প্রাণ আছে। ১৯০১ সালে তিনি গাছের সংবেদনশীলতা সনাক্ত করার মেশিন ক্রেস্কোগ্রাফ (crescograph) আবিষ্কার করে বিশ্বে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে, তারও আগে তিনি রিমোট ওয়্যারলেস সিগন্যালিং গবেষণাতেও অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিলেন।
জগদীশকে বলা হয় ওয়্যারলেস টেলিযোগযোগ এবং আধুনিক ওয়াই-ফাইয়ের (Wi-Fi) জনক। আন্তর্জাতিক ইলেট্রিকাল এবং ইলেকট্রনিক্স প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠান IEEE তাকে রেডিও বিজ্ঞানের একজন অন্যতম জনক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৭৭ সালে সলিড-স্টেট ইলেকট্রনিক্সের উপর নিজস্ব অবদানের জন্য পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী নেভিল মট (Nevill Mott) মন্তব্য করেছিলেন যে, জগদীশ চন্দ্র বসু বিজ্ঞান গবেষণায় এবং উদ্ভাবনী ধ্যান-ধারণায় তার সে সময়ের চেয়ে কমপক্ষে ৬০ বছর এগিয়ে ছিলেন।
১৮৯৫ সালের নভেম্বরে, জগদীশ কলকাতার টাউন হলে তার যুগান্তকারী রেডিও ওয়েভের ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি আবিষ্কারটির একটি প্রদর্শনী করেন। তবে এই আবিষ্কারটি থেকে বাণিজ্যিক সুবিধা অর্জনের পরিবর্তে, জগদীশ তার গবেষণাগুলো অন্য সবার জন্য অবাদে উম্মুক্ত করে দিয়েছিলেন যাতে অন্যরা এ থেকে আরো উন্নত গবেষণা করতে পারে। তিনি মোটেও নিজের আর্থিক স্বার্থ দেখেন নি, তিনি চেয়েছিলেন সমগ্র মানবসমাজ এ থেকে উপকৃত হোক। কত উদার এবং মহৎ হলেই একজন মানুষ এমন চিন্তা-ভাবনা করতে পারে।
ইতালীর বিজ্ঞানী গুগলিয়েলমো মার্কোনি’র (Guglielmo Marconi) রেডিও আবিষ্কার করার এক বছর আগে জগদীশ ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি আবিষ্কার করেছিলেন। মার্কোনি জগদীশেরই গবেষণার ফল ব্যবহার করে রেডিও’র আবিষ্কারক হিসেবে জগৎ বিখ্যাত হয়েছিলেন। জগদীশের প্রধান ভুল ছিল তিনি তার রেডিও ওয়েভ আবিষ্কারটি পেটেন্ট করেন নি। তাই মার্কোনি জগদীশের আবিষ্কারকে নিজের রেডিও আবিষ্কারে ব্যবহার করে একাই এর কৃতিত্ব নিয়েছিলেন। এ নিয়ে অবশ্য জগদীশ কখনো আক্ষেপ করেননি। শুধুমাত্র জগদীশের মতো শ্রেষ্টরাই এমন হতে পারে।
তথ্য সূত্র:
Jagadish Chandra Bose, Famous Scientists -The Art of Genius.