চিঠি বা পত্র হলো একজনের পক্ষ থেকে অন্যজনের জন্য লিখিত বার্তা। চিঠি দুজন বা দুপক্ষের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখে।বন্ধু ও আত্মীয়দের মধ্যে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ট করে, পেশাদারি সম্পর্কের উন্নয়ন করে এবং আত্মপ্রকাশের সুযোগ দেয়। স্বাক্ষরতা টিকিয়ে রাখতেও একসময় চিঠির অবদান ছিল। কাগজ আবিষ্কারের আগে মানুষ গাছের পাতায়,গাছের ছালে,চামড়ায়,ধাতব পাতে লিখত।পাতায় লিখত বলেই এর নাম ‘পত্র ’। সুন্দর,শুদ্ধ চিঠির মাধ্যমে মানুষের শিক্ষা ,বুদ্ধিমত্তা,রুচি ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে ।সুলিখিত চিঠি অনেক সময় উন্নত সাহিত্য হিসেবে বিবেচিত হয়।যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’।
ঐতিহাসিকভাবে চিঠির প্রচলন ছিল প্রাচীন ভারত, প্রাচীন মিশর, প্রাচীন রোম, সুমের, মিশর এবং চীনে। চিঠি ছিল পাঠচর্চা, অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা, বিতর্কমূলক লেখা বা সম মনা অন্যদের সাথে আইডিয়া বিনিময়ের পদ্ধতি। কখনোবা চিঠি এতো শৈল্পিক রূপ পায় যে তা সাহিত্যের একটি বর্গ হয়ে ওঠে। কিছু লোক চিঠিকে মনে করতো কেবল লেখালেখি। আবার অন্যরা মনে করে যোগাযোগের মাধ্যম। বাইবেলের বেশ কয়েকটি পরিচ্ছেদ চিঠিতে লেখা।
আমাদের ব্যবহারিক জীবনে চিঠিপত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ।ব্যক্তিগত ও সামাজিক নানা প্রয়োজনে আমাদেরকে চিঠি লিখতে হয়।আত্মীয় ,বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ এবং সংবাদ আদান- প্রদানের মাধ্যম হিসেবে চিঠির রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অফিস-আদালতে ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজ অনেকাংশে চিঠিপত্রের ওপরই নির্ভরশীল।সাম্প্রতিককালে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগের সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যক্তিগত চিঠি লেখার গুরুত্ব কিছুটা কমেছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ও অন্যান্য চিঠি লেখার প্রয়োজন এতটুকুও কমেনি ।চিঠি লেখার প্রয়োজন আমাদের সংস্কৃতির এক অনুষঙ্গী উপাদান। যোগাযোগ এবং ভাববিনিময়ের এক অনুপম মাধ্যম হিসেবে চিঠি লেখার এই রীতি অব্যাহত থাকবে।
কিন্তু এখন সেই দিন আর নেই, যখন যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল ডাকব্যবস্থা। গ্রামবাংলা থেকে শহরের আনাচে কানাচে খাকি উর্দি পরা পোস্টম্যান সাইকেল চড়ে পিঠে ব্যাগ ভর্তি চিঠিপত্র ঝুলিয়ে নির্দিষ্ট বাড়ির আ্যাড্রেসে গিয়ে ডাক পাড়তো- ‘‘চিঠি আছে গো! চিঠি!! অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকা গৃহকর্তা তখন পত্রদাতার লেখনীর সুন্দর প্রতিফলন ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ এই চিঠির মাধ্যমে জানত পারতো। ব্যক্তিগত চিঠিগুলি হতো আন্তরিকতাপূর্ণ এবং হৃদয়স্পর্শী। পত্রলেখকের আবেগের অনুরণন, আনন্দের হাতছানি ও দুঃখের বিষাদগাথা। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি কবিতার অংশ এবিষয়ে প্রসাঙ্গিক। তিনি লিখেছেন- ‘‘কত চিঠি লেখে লোকে, কত সুখে, প্রেমে, আবেগে স্মৃতিতে, কত দুঃখ ও শোকে।’’ ডাকপিয়ন বা রানার নিয়েও একটা কবিতা লিখেছেন—-
কিন্তু আজকের দিনে অর্ন্তজালের ব্যাপক প্রসার ও ইমেল, মেসেঞ্জার, হোয়্যাটঅ্যাপ প্রভৃতি সোশ্যাল সাইটের সহজলভ্যতা ও জনপ্রিয়তা ‘চিঠি’ নামক যোগাযোগ ব্যবস্থা মাধ্যমের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ইতিমধ্যেই। বর্তমান প্রজন্মের কাছে চিঠি লেখার মাধ্যমে যোগাযোগ বিষয়টি আস্তে আস্তে গুরুত্ব হারিয়ে গেছে। এখন ডাকঘরগুলিতে যা চিঠি আসে তার সিংহভাগটাই দাফতরিক, মানে চিঠি যা সেগুলি স্কুল কলেজ বা অফিসের কোনও দরকারি চিঠি। তাই গ্রাম থেকে শহরের আজ যতগুলি ডাকঘর আছে সেখানে চিঠি পত্রের আদান-প্রদান কাজটা ক্রমশ গৌণ হয়ে আসছে। ডাকঘরগুলি বেশিরভাগ সময় ব্যবহৃত হচ্ছে মানুষের অর্থ সঞ্চয়ের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে। তাই বর্তমানে গ্রামীণ ডাকঘরগুলিকে ব্যাঙ্কের ক্ষুদ্র সংস্করন বললে খুব একটা বেশি বলা হবে না।
কিন্তু আমরা যদি অতীত ফিরে চাই, তাহলে দেখতে পাব আজকের মেসেঞ্জার, ইমেল ইত্যাদির অবর্তমানে এই চিঠিই ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। অতীতে সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের পর্যালোচনা জন্য আজও গবেষকরা পুরাতন চিঠির ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীতে কে কখন কাকে প্রথম চিঠি লিখেছে সে বিষয়ে তথ্য আজও অজানা। তবে বহু বছর আগে মেসোপটেমিয়ার সুমেরিয়ান অঞ্চলে মানুষ ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশ করত। যেমন আকাশের তারা দিয়ে বোঝানো হত রাত, কিংবা তীর ও ধনুকের ছবি দিয়ে বোঝানো হত যুদ্ধের বর্ণনাকে। ছবির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশের এই মাধ্যমের নাম ছিল পিক্টোগ্রাম (pictrogram)। এই পিক্টোগ্রামকে বলা হয় চিঠির বিবর্তিত রুপ।
উপমহাদেশীয় প্রাচীন ইতিহাস অনুসারে জানা যায় আগে একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় সংবাদ আদান প্রদানের জন্য পাঠানো হত কাসিদ বা ডাকবাহক। তবে দূরবর্তী অঞ্চলে খবর পাঠানোর জন্য ব্যবহৃত হত পায়রা বা কবুতর। এরজন্য পায়রাকে রীতিমতো প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। পায়রার পায়ে বেঁধে দেওয়া ছোট সংবাদের চিরকুট, যা পৌঁছে যেত নির্দিষ্ট গন্তব্যে। সম্রাট চেঙ্গিজ খাঁ তাঁর অধিকৃত রাজ্যগুলির সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখতেন এই কবুতরের মাধ্যমে। তারপর যত দিন এগিয়েছে ডাক ব্যবস্থায় এসেছে নতুন সংযোজন।
দিল্লির প্রথম সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের শাসনকালে ডাক ব্যবস্থায় যুক্ত হয় ঘোড়ার ব্যবহার। পর্যটক ইবন বতুতার বিবরণী থেকে জানা যায় সেই সময়ে দুইভাবে ডাক ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। এক পায়ে হেঁটে সাধারন ডাক বিলিবণ্টন ও অন্যটি হল জরুরি অবস্থায় যেমন কোনও বহিরাগতদের আক্রমণের সংবাদ অথবা যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের সংবাদ প্রেরণ করা হত ঘোড়ার ডাক ব্যবস্থার মাধ্যমে। শেরশাহর শাসনকালে ভারতীয় ডাক ব্যবস্থার আমূল সংস্কার ঘটে। তিনি ডাক ব্যবস্থার সুবিধার্থে নির্মাণ করেছিলেন সোনারগাঁও থেকে সিন্ধু প্রদেশ পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তা।
শুধুমাত্র ইতিহাসের দিকে তাকালে চিঠির গুরুত্বকে বোঝা অসম্ভব। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিঠি ছিল উল্লেখযোগ্য সম্পদ। বাংলা সাহিত্যে চিঠিকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে একের পর এক পত্রসাহিত্য। কবিগুরুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প ‘স্ত্রীর পত্র’ পুরোটাই চিঠির আকারে গল্প। আবার তাঁর লেখা অন্য একটি ছোট গল্প ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে আমরা দেখতে পাই অজ পাড়া গাঁয়ের পোস্ট অফিসের সঙ্গে জড়িয়ে নানা ঘটনাচিত্র। আবার কোনও সাহিত্যিকের রচনায় উপজীব্য হয়ে উঠেছে ডাক ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে প্রান্তিক মানুষগুলির জীবন-জীবিকা। এক্ষেত্রে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ‘ডাকহরকরা’ ছোটগল্পে আমরা খুঁজে পাই এক নিষ্ঠাবান ও দায়িত্ববান ডাকহরকরা ও তার দুশ্চরিত্র ছেলের গল্প। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’ কবিতায় উঠে এসেছে এক কল্পিত রানারের রাত-দিনের সংগ্রামের চিত্র——
রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম্ ঘণ্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,
রানার চলেছে, রানার!
প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে গ্রামবাংলার বুক থেকে চিরবিদায় নিয়েছে ডাকহরকরা জীবিকা। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচি ও অভ্যাসের পরিবর্তন এসেছে। মানুষ আজ চিঠির চেয়ে দ্রুতগতির ইমেল, মেসেঞ্জার চিঠি লিখতে বেশি অভ্যস্ত। আর আছে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষায় নম্বর বাড়ানোর জন্য চিঠি লেখার নিবিড় অনুশীলন। ‘শ্রীচরণেষু’, ‘পূজনীয়’, ‘শ্রদ্ধেয়’ ‘ইতি’র মতো শব্দগুলি ব্যবহার চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে। কাউকে আর বলতে শোনা যাবে না ‘বাড়ি ফিরে চিঠি লিখো। চিঠির গুরুত্ব চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে, চিঠি থাকবে শুধু ইতিহাসের পাতায়।
#আনন্দবাজার পত্রিকা