১৯২১ সাল। ঢাকা কলেজ। বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন পড়াশোনা করছেন সেখানে। তার এক ক্লাস নিচের ক্লাসে পড়তেন লীলা নাগ। কে এই লীলা নাগ? চলুন জেনে নেয়া যাক লীলা নাগ সম্পর্কে মোতাহার হোসেনের ভাষায়। কাজী মোতাহার হোসেন বলেছেন, এঁর মত সমাজ-সেবিকা ও মর্যাদাময়ী নারী আর দেখি নাই। এঁর থিওরী হল, নারীদেরও উপার্জনশীলা হতে হবে, নইলে কখনো তারা পুরুষের কাছে মর্যাদা পাবে না। তাই তিনি মেয়েদের রুমাল, টেবলক্লথ প্রভৃতির উপর সুন্দর নক্সা এঁকে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই সব বিক্রি করে তিনি মেয়েদের একটা উপার্জনের পন্থা উন্মুক্ত করে দেন।”

লীলা নাগের ছাত্র জীবন শুরু হয় ঢাকার ইডেন স্কুলে। এরপর তিনি ঢাকা কলেজে পড়েছেন। ১৯২১ সালে তিনি কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বি.এ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে পদ্মাবতী স্বর্ণ পদক লাভ করেন। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু তার মেধা ও আকাঙ্খা দেখে তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ হার্টস তাকে পড়ার অনুমতি দেন। ১৯২১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল়য়ে ইংরেজি বিষয়ে এমএ ভর্তি হন এবং ১৯২৩ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তিনিই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমএ ডিগ্রীধারী মহিলা।

১৯২৭ – ২৮ এ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন নারীদের উপর শারীরিক নির্যাতনের মাত্রা যায় বেড়ে। সেই সময় লীলা নাগ মেয়েদের আত্মরক্ষার জন্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নারী আত্মরক্ষা ফান্ড, যেখানে মেয়েদের মার্শাল আর্ট এবং শরীরচর্চার প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। তিনি কলকাতায় ‘ছাত্রীভবন ‘ নামে একটি ছাত্রীদের আবাসিক হল প্রতিষ্ঠা করেন। লবন সত্যাগ্রহের সময় তিনি ঢাকা মহিলা সত্যগ্রহ কমিটি গড়ে তুলেছিলেন। ঢাকা ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় ঘুরেছেন এই লবন আইন ভঙ্গ করার জন্যে। তিনি এই নারী আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দেয়ার জন্যে সম্পাদিত করেছিলেন “জয়শ্রী” পত্রিকা।

কেন আমরা তার সম্পর্কে জানবো? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষার্থী ছিলেন বলে? নাকি নারীবাদী ছিলেন বলে? তিনি শুধু নারীবাদীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বিপ্লবী। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে উত্তাল এক সমাজ তখন। ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখেছেন, তার বাসার পরিবেশটা ছিল স্বদেশীদের পক্ষে। বিদেশী কাপড় বাদ দিয়ে তারা পড়তো স্বদেশী মোটা কাপড়। তাদের গলায় ছিলো সুর, “মায়ের দেয়া মোটা কাপড়, মাথায় তুলে নে রে ভাই, মা যে তোদের দিন দুঃখিনী এর চেয়ে বেশি সাধ্য নাই।” ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি হলে বাড়িতে পালন হয়েছিল অরন্ধন। এই পরিবেশের সন্তানরাই তো বিপ্লবী হবে। তিনিও তাই হয়েছিলেন। দেশপ্রেমের আগুন জলে উঠেছিল তার মনে।

ভারতবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কারাবরণ করেছিলেন বহুবার। ১৯৩৯ সালে বিয়ের পর তার নাম হয় লীলা রায়। তার স্বামীও ছিলেন একজন বিপ্লবী। পরবর্তীতে বিপ্লবী লীলা নাগ ও তার স্বামী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর দলে যোগ দেন। তার বিপ্লবী জীবনে প্রত্যক্ষ করছিলেন কলকাতা ও নোয়াখালীর দাঙ্গা। তিনি ছুঁটে গিয়েছিলেন ত্রাণকার্যে অংশ নিতে। সেখানেই তিনি গান্ধীজির সাথে দেখা করেছিলেন।

বাঙালি নারীদের শিক্ষায় অগ্রগতির জন্যে ঢাকার আরমানীটোলা বালিকা বিদ্যালয়, কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুল এবং শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয় (তৎকালীন নারীশিক্ষা মন্দির) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে ভারত ভাগের পর লীলা নাগ কলকাতায় চলে যান এবং সেখানেও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

Did you know?
১. বিতর্ক আছে, লীলা নাগ একাই সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন কি না। কারণ, সেই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে বি.এ প্রথম বর্ষে ভর্তি হন সুষমা সেনগুপ্ত। তিনি ছিলেন সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের মেয়ে। সুষমা সেনগুপ্তের নিজস্ব লেখা থেকে জানা যায়, “আইএ পড়তে পড়তে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। ঢাকায় ইউনিভার্সিটি হলো। বিএ পড়তে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। সে বছর লীলাও এমএ ক্লাসে ভর্তি হলো। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আমরা দুজন প্রথম ছাত্রী। এক কমন রুমে বসতাম দুজন। ক্লাসে যাবার সময় অধ্যাপক আমাদের ডেকে নিয়ে যেতেন।” অর্থাৎ, প্রথম ছাত্রী হবার কৃতিত্ব লীলা নাগ ও সুষমা সেনগুপ্ত দু’জনকেই দেয়া যেতে পারে।

২. ১৯২৩ সলে ঢাকায় দীপালি সংঘ নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুললেন লীলা নাগ। এখানে যুদ্ধের (combat) কলাকৌশল সেখান হতো। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে আমরা সবাই চিনি। তিনিও এই সংঘঠন থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহন করেছিলেন।

৩. লীলা নাগের সম্পাদিত নারীবাদী পত্রিকা “জয়শ্রী”- র নামকরণ করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

অভিশপ্ত রাজকুমারীর কবর: লি জিংসুন ও চীনের রহস্যময় সমাধি

অনেক অনেক বছর আগে, চীনের এক অভিশপ্ত রাজকুমারীর সমাধি ঘিরে জন্ম নেয় অজস্র কাহিনি। মানুষ বিশ্বাস করত—মৃত্যু মানেই সবকিছুর শেষ নয়। এক নতুন জীবন শুরু হয় আরেক জগতে। তাই মৃতদের সমাধিতে রেখে দেওয়া হতো দামী জিনিসপত্র, যেন পরকালেও রাজকীয়ভাবে বেঁচে থাকতে পারেন তাঁরা। কিন্তু এই...

কপিলাবস্তুর সন্ধান: গৌতম বুদ্ধের হারানো ইতিহাস যেভাবে উদ্ধার করেন বাবু পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব শুধু ভারতবর্ষেই নন, সমগ্র বিশ্বের ধর্মীয় ইতিহাসকে তিনি বদলে দিয়েছিলেন। তিনি বদলে দিয়েছিলেন মানুষের চিন্তাধারা, ভাবনা ও দর্শনকে। শাক্য রাজপরিবারের রাজপুত্র তিনি। কিন্তু রাজপ্রাসাদে তাঁর মন টিকল না। একদিন রাজত্ব ও কপিলাবস্তুর নগর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন মানুষের...

শিউলি ফুলের বিষণ্ণতার গল্প

শরতের রাতের সৌন্দর্য বলতে যে ফুলকে বোঝানো হয়, তা হলো শিউলি ফুল। তবে এ সৌন্দর্য আনন্দের নয়, বেদনার প্রতীক। শিউলি ফুলের নাকি সব সময়ই মন খারাপ থাকে। সূর্যের ওপর তার এক রাশ অভিমান। তাই তো রাতের আঁধারেই নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পছন্দ করে সে এবং সূর্য ওঠার আগেই লুকিয়ে ঝরে পড়ে।...

মিশরীয় সিন্ডারেলা

মিশরে তখন ১৬ তম রাজবংশের যুগ। পার্সিয়ান আক্রমনের সম্ভাবনায় দিন গুণছে মিশর। সে সময় মিশরীয় সৈন্যদের তুলনায় গ্রীক সৈন্যদের কদর ছিলো অনেক বেশি। কারণ গ্রীক সৈন্যদের দক্ষতার গল্প প্রচলিত ছিলো বিশ্ব জুড়ে। এমন সময় ফারাও এপ্রিয়েজকে হত্যা করে মিশরের নতুন ফারাও হলেন রাজবংশের...

প্রাচীন সভ্যতায় ঈশ্বরের ধারণার উৎপত্তি ও সংখ্যাগত অবনমন

যে কোন সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলেই আমরা বহু ঈশ্বর বা গডের অস্তিত্বের কথা জানতে পারি। তবে আজকের প্রেক্ষাপটে ঈশ্বর সম্পর্কে এ ধারণা অনেকটাই পাল্টেছে। কেননা বর্তমান বিশ্বে বহু ধর্মমত এখনও বিদ্যমান থাকলেও ঈশ্বরের সংখ্যার বিষয়টি কমে এসেছে। একেশ্বরবাদ কিংবা বহুঈশ্বরবাদী...

মেহেদী হাসান খান

মেহেদী হাসান খান ১৮ বছর বয়সের মেহেদী হাসান খান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হলেন,কিন্তু পড়াশোনায় তার মন নাই! কিন্তু কেন? তিনি নাওয়া- খাওয়া, পড়াশোনা বাদ দিয়ে একটা ছোট্ট কম্পিউটার সম্বল করে বাংলা ভাষায় লেখার জন্য লড়াই শুরু করলেন। একটাই জেদ, বাংলা...

ঢাকার হারিয়ে যাওয়া সংগ্রহশালা- বলধা জাদুঘর

১৯২৫ সালের ঢাকা; ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে রেললাইন ধরে নারায়ণগঞ্জের দিকে কিছুদূর এগুলে উয়ারি। উয়ারির শেষ সীমানায় এক সরু রাস্তা চলে দিয়েছে নারিন্দার দিকে। সরু সেই রাস্তার একপাশে বহু পুরাতন খ্রিস্টান কবরখানা আর তার বিপরীতে উঁচু পাচিলঘেরা কম্পাউন্ডের ভেতর দোতলা...

সুন্দরবন ধ্বংসের ইতিবৃত্ত

ব্রাজিলের চিরসবুজ বিস্তৃত এমাজন (Amazon Rainforest) গহীন বনাঞ্চলকে বলা হয় বিশ্বের ফুসফুস, তেমনি সুন্দরবনও বাংলাদেশের শ্বাস-প্রশ্বাসের এক অঙ্গ। এই ঘন বনাঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও এক প্রতিরোধ। সুন্দরবনকে ঘিরে আশেপাশের জনপদে ছড়িয়ে আছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী। এমনি...

ঢাকার এক বিস্মৃত চিকিৎসক

দিনটি ছিল ১৫ই নভেম্বর ১৮৬৪ সাল, মঙ্গলবার। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই। নারিন্দার খ্রিস্টান কবরস্থানের দীর্ঘ ঘাসের ঝোপে অবশ্য তখনই অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা হলে এই এলাকায় সহজে কেউ পা বাড়ায় না। কিন্তু সেদিন পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য- আছে ইংরেজ, আরমেনিয়, দেশী সব...

ঢাকার ঐতিহাসিক তারা মসজিদ

পূর্বকথাঃ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আরমানিটোলার মহল্লা আলে আবু সাঈদে তখন এক প্রভাবশালী জমিদারের বাস, নাম- মীর্জা গোলাম পীর। দাদা মীর আবু সাঈদ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা যুগে তুরস্ক থেকে এসে ঢাকায় থিতু হয়েছিলেন। মীর্জা গোলাম পীরের আরেক নাম মীর্জা আহমেদ জান। তবে...