বর্ণবৈষম্য নিয়ে যেই নেতা অগ্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন, যিনি কৃষ্ণাঙ্গদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন, তিনি আর কেউ নন, মার্টিন লুথার কিং। সবচেয়ে ছোট নোবেল বিজয়ী হিসেবে তার নাম সবার উপরে। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্য ও অত্যাচারের বর্ণনা দিয়ে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা আজও, “I Have a Dream” শিরোনামে সকলের কাছে পরিচিত। তার এই ভাষণে তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, সাম্যের ও শোষণমুক্ত এক সমাজের।
কৃষ্ণাঙ্গরা যে বর্ণ বৈষম্যের শিকার এবং নিজের দেশেই নির্বাসিত এটা তার মনে আঘাত করেছে। তাদের এই গায়ের রং তাদেরকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করেছিল। এই কারণেই তারা যেনো এক দারিদ্রতার সাগরে বাস করছে। তিনি তাদের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার ছোট ছোট চার সন্তান এমন একটি দেশে বাস করবে যেখানে তাদেরকে তাদের গায়ের রং দিয়ে বিচার করা হবে না, বরং তাদের জ্ঞান, বুদ্ধি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে বিচার করা হবে। তিনি ন্যায় বিচার চেয়েছিলেন। তিনি একটি সুস্থ পৃথিবী চেয়েছিলেন যেখানে কোনো দারিদ্রতা থাকবে না, থাকবে না কোনো বৈষম্য।
কিন্তু এতকিছু করেও, খুনির হাত থেকে তাকে কেউ বাঁচাতে পারেনি। ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাস। মেমফিসে সিটি স্যানিটেশন কর্মীদের আন্দোলনকে সমর্থন করার উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়েছিলেন মার্টিন।
সন্ধ্যা ছয়টা। জেমস আর্ল রে নামের এক শ্বেতাঙ্গ যুবক মেমফিসের এক মোটেলের বাইরে ঘুড়াঘুড়ি করছে। এই মোটেলে নোবেল বিজয়ী নেতা মার্টিন লুথার কিং অবস্থান করছেন। জেমস কিছুদিন আগেই রেমিংটন ৩০-০৬ রাইফেল কিনেছিলো। তার একটাই উদ্দেশ্য, মার্টিন লুথার কিং কে হত্যা করা। এই লোক কৃষ্ণাঙ্গদের সমঅধিকার দেয়ার জন্যে আন্দোলন করছে। কৃষ্ণাঙ্গরা কখনোই শেতাঙ্গদের মতো অধিকার পেতে পারেনা। প্রচন্ড এক আক্রোশে জেমস ভাবতে থাকে কথাগুলো।
সেই সময় মোটেলের নিজের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন মার্টিন। আজকের অনুষ্ঠানে বেন ব্রাঞ্চ নামক একজন গায়কের সাথে কথা হয়েছে মার্টিনের। বেনকে তিনি “Take my hand, precious lord” গানটি গাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। আরও ভাবছিলেন আজকের সারাদিনের ধর্মঘটের কথা। তার মন কি কিছুটা বিষন্ন? তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সারাজীবন লড়াই করে গেছেন। কিন্তু এখনও কি মানুষ সেই বর্ণবৈষম্য থেকে বের হতে পেরেছে?
জেমস তার অবস্থান নিয়েছে। অনেকক্ষন যাবৎ দূরবীন দিয়ে মার্টিনকে লক্ষ্য করছিলো জেমস। এটাই সুযোগ মার্টিন লুথার কিং কে শেষ করে দেয়ার। রাইফেল থেকে বুলেটটি ছুঁটে গেলো। বুলেটটি মার্টিনের ডান গাল ভেদ করে স্পাইনাল কর্ড হয়ে সরসরি ঘাড়ের শিরা ছিড়ে ফেললো। তিনি জ্ঞান হারিয়ে বারান্দার মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন।
জেমসের কাজ শেষ। তার মনে আজকে আশ্চর্য এক প্রশান্তি কাজ করছে। এখন সে জলদি পালিয়ে যেতে চায়। দূরবীন, রাইফেল ও বাকি বুলেটগুলো একটি কাগজে মুড়িয়ে একটি স্টোরের বাইরে ফেলে দিলো। দোকানের মালিকসহ আরও অনেকেই তাকে দেখলো। কিন্তু জেমস তাদেরকে কিছু বুঝতে না দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।
মার্টিনকে সেন্ট জোসেফ হসপিটালে নেয়া হয়। সেখানে তাকে নিয়ে যমে – মানুষে টানাটানি চলতে থাকে। কিন্তু এতো চেষ্টা করেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ডাক্তাররা তারা মৃত ঘোষণা করেন। চলে গেলেন এক কিংবদন্তি নেতা মার্টিন লুথার কিং।
কিন্তু এই হত্যাকান্ড করে জেমসও বাঁচতে পারেনি। ঠিক দুই মাস পর হিথ্রো এয়ারপোর্ট থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের দায়ে সে ৯৯ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হয়। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই কারাভোগ থেকে সে মুক্তি পায়নি। মার্টিন লুথার কিংকে হত্যা তার মনে প্রশান্তি আনলেও, জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছিল সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার।
আমেরিকার ইতিহাসে প্রায় ২০ জন প্রেসিডেন্টকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হত্যার শিকার হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনও দাসপ্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং জয়ীও হয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও একইভাবে আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। এমনি করেই বড় বড় নেতারা চলে গিয়েছিলেন পৃথিবী ছেড়ে মনে অপূর্ণ স্বপ্ন নিয়ে। বিশ্বে কিছু দল আছে যাদের মূল লক্ষ্যই থাকে মানুষে মানুষে দ্বন্দগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা। আমরা ইতিহাস পাতা থেকে দেখে আসছি, হিটলার-ইহুদিদের উপর , শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের উপর, মুসলিমরা অমুসলিমদের উপর, অমুসলিমরা মুসলিমদের উপর অত্যাচার করেই যাচ্ছে। এর শেষ কোথায়? আমরা কি এই বিদ্বেষ থেকে কোনোদিন বেরিয়ে আসতে পারবো ? আমরা কি পারবো পরবর্তী প্রজন্মকে একটি সুস্থ পৃথিবী উপহার দিতে?