পৃথিবীর এমন একটি সভ্যতা যা শুধু প্রাচীন নয়, পুরো পৃথিবীর কাছে খুব গুরুত্ব বহন করে। এই সভ্যতা মানবের উত্থান পতনের ইতিহাস, সম্পদ ও সমৃদ্ধিতে ইতিহাস, ঐশর্য আর প্রাচুর্যের ইতিহাস বহন করছে। বর্তমান সভ্যতা সেই পুরোনো, প্রাচীন সভ্যতার কাছে চির ঋণী। হ্যা, ঠিকই ধরেছেন। পৃথিবীর এই প্রাচীন সভ্যতাটি হলো, মেসোপটেমীয় সভ্যতা। ‘মেসোপটেমিয়া (Mesopotamia)’ শব্দটির অর্থ, দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল। মেসো অর্থ দুই এবং পটেমিয়া অর্থ নদী। বর্তমান ইরাকের টাইগ্রিস বা দজলা ও ইউফ্রেটিস বা ফোরাত ইরাকের এই দুই নদীর মধ্যবর্তী স্থানেই অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল এই সভ্যতা। দুটি বড় নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল হওয়ার কারণে এটি খুবই উর্বর ছিল ও চাষবাদের জন্য আদর্শ ভূমি। এই অঞ্চলে অনেক ঢিপির মতো ছোট ছোট পাহাড় রয়েছে। এগুলো ‘টেল’ নামে পরিচিত। পরবর্তীতে এসব ‘টেল’ খুঁড়েই মাটির বিভিন্ন স্তরে সন্ধান পাওয়া যায় বসতির নানা চিহ্ন আর ধ্বংসাবশেষের। আর এসব ধ্বংসাবশেষগুলোই মেসোপটেমীয় সভ্যতার অস্তিত্ব বহন করে। ইরাক, সিরিয়া, তুরষ্ক এবং ইরান প্রদেশের বেশ কিছু অঞ্চল মেসোপটেমিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে মনে করা হয়। প্রাচীন এই সভ্যতাকে বলা হয় সভ্যতার আঁতুড়ঘর। কারণ একমাত্র এই সভ্যতাই পরবর্তীতে সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয়, অ্যাশেরীয় ও ক্যালেডীয়র মতো চারটি গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতার জন্ম দিয়েছিলো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে মিশরীয় সভ্যতার সাথে এর কোনও মিলই ছিল না। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ হতে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের মধ্যে মেসোপটেমিয়ায় অতি উন্নত এক সভ্যতার প্রকাশ ঘটেছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ সালের দিকে পার্সিয়ানরা এই অঞ্চল শাসন করলেও বেশিদিন নিজেদের দখলে রাখতে পারেনি। রোমানরা পার্সিয়ানদের কাছ থেকে দখল কেড়ে নেয়। কিন্তু তারাও খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ সালের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। পার্সিয়ানরা এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ আবার নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় এবং প্রায় সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত শাসন করে। এই সময় মেসোপটেমিয়াতে ব্যাপক ভাবে পার্সিয়ান প্রভাব পড়েছিল। এরপর শুরু হয় মুসলিম শাসনামল। এই সভ্যতা ইসলামের রাজধানী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে পুরো পৃথিবীতে আধিপত্য বিরাজ করে। বাগদাদের খলিফা হারন-আর-রশিদ এই মেসোপটেমীয় সভ্যতার উপর তার শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলো। পরবর্তীতে এই অঞ্চলে খিলাফত শাসন স্থায়ী হলে এই স্থানটি ইরাক নামে পরিচিতি লাভ করে। সেই সময় এই অঞ্চলে উরুক নামে একটি শহর ছিল। বলা হয়ে থাকে “ইরাক” নামটির উৎপত্তি উরুক শব্দ থেকেই। সম্পদ আর প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ ছিলো বলে বারবার এর উপর শত্রূদের আক্রমণ ও লুটতরাজ চলতেই থাকতো। মেসোপটেমীয় সভ্যতায় অধিবাসীদের প্রধান পেশা ছিল উন্নত কৃষিকাজ। তারা পাহাড়ের গায়ে দাগ কেটে কেটে সংখ্যা মনে রাখার চেষ্টা করত। এভাবেই ধীরে ধীরে তারা গনিত শাস্ত্রের উন্নতিসাধন করতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের সব সংখ্যাগুলো ষষ্ঠিক বা ষাট কেন্দ্রিক ছিলো। সেখান থেকেই এক ঘণ্টায় ষাট মিনিট ও এক মিনিটে ষাট সেকেন্ডের হিসাব আসে। এছাড়া বছরকে ১২ মাসে এবং এক মাসকে ৩০ দিনে ভাগ করে হিসাব করা শুরু হয় এই সভ্যতায়।
সুমেরীয় সভ্যতা
মেসোপটেমিয়াতে যে সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছিল তাদের মধ্যে সুমেরীয় সভ্যতা সবচেয়ে প্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে এর জন্ম। এ সভ্যতায় প্রথম ‘কিউনিফর্ম’(Cuneiform) পদ্ধতির আবির্ভাব হয়, যা কাদামাটির তৈরী নরম শ্লেটে লেখার একটি পদ্ধতি। সুমেরের প্রাচীন শহর নিপ্পুরের এক মন্দিরে একটি লাইব্রেরি পাওয়া গেছে যেখানে প্রায় চার হাজার মাটির চাকতি ছিল। সুমেরীয়রা বহু দেবতায় বিশ্বাস রাখলেও, পরকালের ব্যাপারে ছিল উদাসীন। তাই তাদের মধ্যে কোনো মমি তৈরির কোনো ইতিহাস পাওয়া যায়নি। এদের প্রধান দেবতা ছিলেন সূর্যদেব ‘শামাশ’। তারা বিশ্বাস করতো পৃথিবী একটি বিশাল ফাঁকা গোলাকার চাকতি, যার আকাশে স্বর্গ এবং মাটির নিচে রয়েছে নরক। পানি সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল, পুরো পৃথিবী পানির তৈরী। তারা সাধারণত মনের ভাব আদান প্রদানের জন্য সেমিটিক ভাষায় কথা বলতো। বিজ্ঞানচর্চা, প্রশাষনিক কাজ, এমনকি ধর্ম পরিচালনার পাশাপাশি সাহিত্যেও তাদের অবদান ছিল অপরিসীম। গ্রীক লেখক হোমার তার সৃষ্টি ইলিয়াড এবং ওডেসি লেখার হাজার বছর আগেই সুমেরীয়রা তাদের নিজস্ব ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছিল, যার নাম ছিল ” গিলগামেশের মহাকাব্য”। কয়েকবার এই মহাকাব্যের সংস্করণ করা হয়েছে। বর্তমানে বারো ফলকের এই সংস্করণের দুই-তৃতীয়াংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর অ্যাসিরীয় রাজা আশুরবানিপালের গ্রন্থাগারে এর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এই সাহিত্য থেকে জানা যায় যে, সেই সময়কার লোকজন অতিমাত্রায় কল্পনাপ্রবণ ছিলো। আর তাদের এই মাত্রাতিরিক্ত কল্পনাশক্তির কারণেই বিজ্ঞান ও সাহিত্যে তারা এগিয়ে গিয়েছিলো অনেকটা দূর। তাছাড়া আমাদের বর্তমানে বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজ যেমন অফিস আদালতে দলিল-দস্তাবেজের প্রচলনও সুমেরীয়দের মাঝেই প্রথম দেখা যায়।
প্রাচীন ব্যাবিলন
২০৫০ খ্রিস্টপূর্বে মেসোপটেমিয় অঞ্চলে এই সভ্যতার গোড়া পত্তন হয়।সিরিয়ার মরুভূমি অ্যামোরাইট থেকে আসা একদল লোক ও তাদের বিখ্যাত নেতা হাম্মুরাবির নেতৃত্বে গড়ে উঠে এই সভ্যতা। তিনি একজন আইন সংকলক হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। এই যুগেও কিউনিফর্ম পদ্ধতিরর প্রচলন ছিল।
আশেরীয় সভ্যতা
টাইগ্রিস নদীর তীর ঘেঁষে ছিল আরেক প্রাচীন শহর ‘আশুর’। এই শহরকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল আশেরীয় সভ্যতা। প্রথমদিকে এই যুগের লোকেরা কৃষি এবং পশুপালনের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে তাদের জীবনে নানা ধরণের সমস্যা দেখা দেয়। তখন আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চলে লুটতরাজ শুরু করে। কিন্তু পরবর্তীতে লুট করা এই সম্পদই তাদের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দেয়। আশেরীয়রা যুগের চাইতে বেশ অনেকটা এগিয়ে ছিল। তাদের ছিল আধুনিক সৈন্যবাহিনী। এই যুগেই আশেরীয়রা প্রথম লোহার অস্ত্র তৈরি করে গোলন্দাজ বাহিনী গঠন করে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তার প্রয়োগও করে। আশেরীয় সভ্যতার শেষ সম্রাট ‘আশুরবানিপাল’ কর্তৃক নির্মিত কিউনিফর্ম পদ্ধতিতে লেখা ২২০০টি কাদামাটির শ্লেট সম্বলিত লাইব্রেরি পাওয়া গিয়েছিলো। তিনশো বছরের শাসনকাল শেষে ৬১২ খ্রিস্টপূর্বে ধ্বংস হয়ে যায় এই সভ্যতা।
ক্যালডীয় সভ্যতা
ব্যাবিলন শহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল ক্যালডীয় সভ্যতা। একে নতুন ব্যাবিলনীয় সভ্যতাও বলা হয়। মেসোপটেমীয় সভ্যতার শেষ ধাপ ক্যালডীয় সাম্রাজ্য গড়ে তোলার সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল সম্রাট নেবুচাদনেজারের। তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো জেরুজালেম শহর। হাজার হাজার ইহুদীকে বন্দী করা হয়েছিল সেই সময়। এই সময়টাকেই ইতিহাসের “ব্যাবিলনীয় বন্দীদশা” (Babylonian Captivity) বলা হয়ে থাকে।
একবার নেবুচাদনেজারের রানীর বিশাল একটি বাগানের শখ হয়েছিল। রাজাও তার রানীর এই শখ পূরণ করেছিলেন। শহরের চারপাশে যে প্রতিরক্ষা দেয়াল ছিল তারই ছাদে তৈরি করেন এক বিশাল বাগান। এই বাগানই আমরা পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্যের একটি আশ্চর্য ‘ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান’ নামে চিনি। জ্যোতির্বিজ্ঞানে ক্যালডীয়দের অবদান ছিল অসামান্য। তারাই সর্বপ্রথম সপ্তাহকে সাত দিনে এবং দিনকে ১২ জোড় ঘণ্টায় ভাগ করে। এ যুগের বিজ্ঞানীরা ১২টি নক্ষত্রপুঞ্জের সন্ধান পেয়েছিলেন, যা থেকে ১২টি রাশিরচক্রের সৃষ্টি হয়। এদের প্রধান দেবতা ছিল ‘মারডক’। কিন্তু পারস্য আক্রমণের পর বিলীন হয়ে যায় এই সভ্যতা।
যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে হাজার সভ্যতা এসেছে এবং চলেও গেছে। কিন্তু কিছু সভ্যতা আছে, ইতিহাসের পাতায় যার স্থান অনেক উপরে। আর তার মধ্যে একটি হলো এই মেসোপটেমীয় সভ্যতা। এই সভ্যতা যেমন অনেক সৃষ্টির জন্ম দিয়েছে , ঠিক তেমনি অনেক সংঘাতের সাক্ষীও হয়েছে।