নাসিরুদ্দিন হোজ্জা একবার কি যেন একটা কাজে অন্য একটি গ্রামে গেলেন। কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে এক লোক তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই সাহেব, আজ কী বার?’ হোজ্জা লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি বাপু ভিন গাঁয়ের লোক, তোমাদের গাঁয়ে আজ কি বার, সেটা আমি কিভাবে জানবো’’? এ কথা বলেই হোজ্জা আবার হন হন করে হেঁটে চলে গেলেন!
এই হচ্ছে নাসিরুদ্দিন হোজ্জা। মানুষটা ছোটখাটো, বেঁটে। মাথায় পাগড়ি পরে আর গায়ে থাকে জোব্বা। দুরে কোথাও গেলে তার সঙ্গী হয় একটা গাধা। হোজ্জাকে নিয়ে এক হাজারেরও বেশি গল্প চালু আছে।কখনো মনে হয়, সে খুব বুদ্ধিমান কখনো মনে হয় বোকা। তাকে আমরা চিনি তার সুক্ষ্ম রসবোধের কারণে। আর কে না জানে, যেখানে রসবোধ সেখানেই হাসির তুফান উঠে!
একদিন নাসিরুদ্দিন শহরের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, তার সাথে ছিল তার কান্নারত ছেলে, তিনি যেতে যেতে নিচুগলায় কিছু কথা বলছিলেন ‘নাসিরুদ্দিন, শান্ত হও, আর মাত্র একটুখানি পথ বাকি আছে’, ‘নাসিরুদ্দিন মাথা গরম করো না, এই তো বাড়ি এসে গেছি।’ ‘সবঠিক হয়ে যাবে নাসিরুদ্দিন, সামান্য একটু পথ বাকি।’ এটা দেখে এক বৃদ্ধা মহিলা নাসিরুদ্দিনের কাছে গিয়ে বললেন, ‘ছেলের সঙ্গে আপনার ব্যাবহার দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।’ এই বলে তিনি বাচ্চাটার থুতনি নেড়ে বললেন, ‘কান্না করো না নাসিরুদ্দিন, সবকিছুঠিক হয়ে যাবে।’ নাসিরুদ্দিন মহিলাটির দিকে চোখ গরম করে বললেন, ‘ডাহা ভুল করছেন আপনি। নাসিরুদ্দিন আমার নাম, আর ওর নাম জামালুদ্দিন।’
তার জীবন সম্বন্ধে খুব একটা বেশি কিছু জানা যায়নি, সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, ত্রয়োদশ শতকে বর্তমান তুরস্কের এসকিসেহির প্রদেশের সিভ্রিহিসার নামের শহরে তার জন্ম। আবার কারো মতে, তার জন্ম আধুনিক ইরানের পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের ‘খোয়’ শহরে। ইরান, উজবেকিস্তান, আজারবাইজান আর আফগানিস্তানের মানুষও দাবি করে যে, হোজ্জা তাদেরই দেশের লোক। যিনি নাসিরুদ্দিন হোজ্জাকে নিয়ে ব্যাপক রিসার্চ করেছেন, সেই প্রফেসর মিকাইল বায়ারাম জানান, এই মানুষটির পূর্ণ নাম নাসির উদ্দীন মাহমুদ আল খায়ী। জন্ম ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুরস্কে।
তার উপস্থিত বুদ্ধি ও বিজ্ঞতার খ্যাতি দেশে দেশে। কেউ বিপদে পড়লে তার কাছে যেত শলা- পরামর্শের জন্য । নাসিরুদ্দিন মহাবুদ্ধিমান ছিলেন নাকি মহাবোকা ছিলেন তা নিয়ে জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। তবে আসল ঘটনা যাই হোক, নাসিরুদ্দিনের গল্পগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষকে নির্মল আনন্দ জুগিয়ে আসছে।
একবার হোজ্জা আর তার এক বন্ধু একবার এক হোটেলে ঢুকল কিছু খাওয়ার জন্য। খাওয়া শেষে হিসাব করে দেখল যে, দুই গ্লাস দুধ খাওয়ার মতো টাকা ওদের হাতে নেই। তাই দুজনের জন্য এক গ্লাস দুধ চাইল। দুধ আসার পর হোজ্জার বন্ধুটি বলল, ‘ভাই, তুমি আগে অর্ধেকটা খেয়ে ফেল। হোজ্জা জানতে চাইল, ‘কেন?’ বন্ধুটি বলল, ‘আমি আবার চিনি ছাড়া দুধ খেতে পারি না। অথচ, একজনের খাওয়ার মতোই চিনি আছে আমার কাছে। তাই বলছিলাম যে, তুমি অর্ধেকটা খেয়ে নিলে বাকিটা আমি চিনি দিয়ে খাব।’ হোজ্জা তখন গ্লাসটা হাতে নিয়ে তার মধ্যে অনেকটা লবণ ঢেলে বলল, ‘তাহলে আমার অর্ধেক ভাগটা আমি লবণ দিয়ে খেয়ে নিলাম। বাকিটা তুমি চিনি মিশিয়ে মিষ্টি করে খেয়ো!’
তার জীবনের রহস্য ভেদ করা বেশ কঠিন ব্যাপার।তার জীবনের প্রতিটা ঘটনার সাথে কোনো না কোনো রসিকতা জড়িয়ে আছে। সৈয়দ মুজতবা আলীও রসিকতা করে মোল্লা নাসিরুদ্দিনকে নিয়ে বলেছিলেন, “তার সম্পর্কে প্রচলিত দু’আনা পরিমাণ কিংবদন্তি বিশ্বাস করলে আমাদের কালিদাস সম্পর্কে প্রচলিত সব ক’টাই বিশ্বাস করতে হয়।”
একবার মোল্লা নাসিরুদ্দিনের মজলিশে এক লোক তার বয়স জানতে চাইলেন। মোল্লা উত্তর দিলেন তার বয়স চল্লিশ। মজলিশে উপস্থিত কয়েকজন জানালেন, দশ বছর আগেও মোল্লা তার বয়স চল্লিশ বলেছিলেন। তাহলে এখনো তার বয়স চল্লিশ থাকে কী করে? মজলিশের গুঞ্জন শুনে মোল্লা উত্তর দিলেন, তিনি এককথার মানুষ, কিছুদিন পর পর তিনি তার কথা বদলাতে পারবেন না।
মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার নামে যত সব অদ্ভুত গল্প আছে তার সংকলন নিয়ে বেশ কয়েকটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৬৮ সালে ইদরিস শাহ ‘The Pleasantries of the Incredible Mulla Nasrudin’ নামে একটি সংকলন প্রকাশ করেন। এই বই অনূদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়, পৌঁছে গেছে বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে। সত্যজিৎ রায়ও ‘মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প’ নামে হোজ্জার গল্পের একটি সংকলন বের করেছিলেন। তিনি পুরো পৃথিবীর জন্য অনন্য এক সম্পদ।
একবার হোজ্জার জন্মদিন পালনের সময় দীর্ঘদিন পরে তুরস্কে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটে, তো সৈয়দ মুজতবা আলী রসিকতা করে তার চতুরঙ্গ বইয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘’তা হলে বোঝা গেল মা ধরণীর পাকা দুশো বছর লেগেছে হোজ্জার রসিকতার মর্ম গ্রহণ করতে; তাই বোধহয় হয় হাসতে হাসতে তার নাড়িভুঁড়ি এখন ভূগর্ভ থেকে ছিঁড়ে বেবিয়েছে’’।
মোল্লা নাসিরউদ্দিন যে এলাকায় বাস করতেন সেখানকার লোকজন বেশ কিছুদিন ধরেই তাকে অনুরোধ জানাচ্ছিল যে, তাদের স্কুলে গিয়ে ছাত্রদের উদ্দেশে কিছু জ্ঞানের কথা শোনাতে হবে। ওদের অনুরোধ ফেলতে না পেরে হোজ্জা শেষপর্যন্ত স্কুলে গেলেন। তারপর ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে হোজ্জা বললেন, “আমি আজ তোমাদের যা বলতে চাই, তা কি তোমরা জানো?” খুব স্বাভাবিকভাবেই ছাত্ররা জবাব দিল, “না মোল্লা সাহেব, আমরা কেউই জানি না আপনি কী বলবেন।” হোজ্জা তখন বললেন, “জানোই না যখন, তখন আর জেনে কী হবে?” এই কথা বলে হোজ্জা গটগট করে হেঁটে চলে আসল। পরের সপ্তাহে স্কুল থেকে আবার কয়েকজন এল হোজ্জাকে নিয়ে যেতে। হোজ্জা আবারও ওদের সামনে গিয়ে বললেন, “আমি আজ তোমাদের যা বলতে চাই, তা কি তোমরা জানো?” এবার কিন্তু ছাত্ররা খুবই সাবধান। ওরা সবাই একসঙ্গে বলল, ‘জি মোল্লা সাহেব, আমরা সবাই জানি আপনি কী বলবেন।” হোজ্জা তখন বললেন, “জানোই যখন, তখন আর আমার বলার দরকার কী?” এই কথা বলে হোজ্জা আবার গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন। স্কুলের ছাত্ররাও নাছোড়বান্দা, ওরা পরের সপ্তাহে আবার হোজ্জাকে ধরে নিয়ে গেল কিছু বলার জন্য। হোজ্জা এবারও ওদের সামনে গিয়ে বললেন, “আমি আজ তোমাদের যা বলতে চাই, তা কি তোমরা জানো?” ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ বলল, ‘জি মোল্লা সাহেব, জানি।” আর কেউ কেউ বলল, “না মোল্লা সাহেব জানি না।” ভাবখানা এমন, এবার বাছাধন যাবে কোথায় ? কিন্তু হোজ্জাও দমবার পাত্র না। তিনি বললেন, “তোমাদের মধ্যে যারা জানো তারা এক কাজ করো। কাজটি হলো- যারা জানে না, তাদের তা জানিয়ে দাও।” এই কথা বলে আবার হোজ্জা গটগট করে হেটে বাসায় চলে আসলেন।
তুরস্কে মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার সম্মানে ‘আন্তর্জাতিক নাসিরুদ্দীন হোজ্জা উৎসব’ পালন করা হয়। জুলাইয়ের পাঁচ থেকে দশ তারিখের মাঝে তুরস্কের আকশেহিরে এই উৎসব হয়। তুরস্কের আকশেহির শহরেই নাসিরুদ্দিন হোজ্জার সমাধি রয়েছে।সারাবিশ্ব থেকে হোজ্জা অনুরাগীরা সেখানে পাড়ি জমান, হোজ্জাকে স্মরণ করেন। সেই উৎসবে একজন প্রতিকী নাসিরুদ্দিন আকশেহিরে ঘুরে বেড়ান। হোজ্জার কাজকর্মের আলোচনা, ছবি আঁকার মাধ্যমে তাকে স্মরণ করা হয়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ছাড়াও মধ্য এশিয়া আর ইউরোপের বিস্তীর্ণ এলাকায় নাসিরুদ্দিন ভীষণ জনপ্রিয়। নাসিরুদ্দিন হোজ্জার কিংবদন্তি সারা পৃথিবীর মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে ইউনেস্কো ১৯৯৬-৯৭ সালকে আন্তর্জাতিক নাসিরুদ্দিন বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার নাম আর তার কিংবদন্তী পৌঁছে যেতে শুরু করে তখন থেকেই।