মিশর আজ নতুন সাজে সেজেছে। চারদিকে তৈরী হয়েছে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। বাদ্য-বাজনার তালে তালে নৃত্য চলছে। পুরোহিতরাও শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে অপেক্ষা করছেন বর-বধূর জন্য। রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রস্তুত হচ্ছেন ফারাও চতুর্থ থুতমোসের ছেলে তৃতীয় আমেনহোটেপ। খানিক বাদেই বিয়ে করতে যাচ্ছেন তিনি। সাধারণত ফারাও বা তার ছেলেদের বহু স্ত্রী থাকেন। আমেনহোটেপেরও নিজস্ব বিশাল হারেম রয়েছে, কিন্তু এতো কিছুর পরও আজকের দিনটি তার জন্য বিশেষ। আজ তিনি পেতে যাচ্ছেন তার ভালোবাসার নারীকে, তার প্রধান স্ত্রীকে। প্রস্তুত হয়ে পুরোহিতের সামনে উপস্থিত হলেন বর তৃতীয় আমেনহোটেপ। অপর পাশ থেকে ভাই আনেনের হাত ধরে এগিয়ে আসছেন আজকের বধূ। বাবা ইউয়া এবং মা থুয়ুর পরমা সুন্দরী মেয়ে টিয়ে হতে যাচ্ছেন মিশরের রাণী। রাজকীয় নারী না হলেও সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকেই এসেছেন টিয়ে। বর-বধূ দু জনই উপস্থিত হলে পুরোহিতরা মন্ত্র পড়তে শুরু করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্পন্ন হলো আমেনহোটেপ ও টিয়ের বিয়ে। আর এরই মাধ্যমে শুরু হলো মিশরের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সমৃদ্ধ যৌথ শাসনের অধ্যায়।
খ্রিস্টপূর্ব ১৩৯১ থেকে ১৩৫৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৮ বছর, অর্থাৎ প্রায় চার দশক সময়কাল যৌথভাবে মিশরকে শাসন করেছেন ১৮ তম রাজবংশের শাসক তৃতীয় আমেনহোটেপ এবং তার স্ত্রী টিয়ে। আর এই শাসনকালে মিশরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও নির্মাণ শিল্প এতোটা সমুন্নত হয়েছিলো যে, এই সময়েই মিশরে স্বর্ণযুগের সূচনা ঘটেছিলো।
বাবা চতুর্থ থুতমোসের কল্যাণে ইতিমধ্যে এক ধনী রাজ্য প্রস্তুত হয়েই ছিলো তৃতীয় আমেনহোটেপের জন্য। তবে নিজ যোগ্যতায় রাজ্যের সীমানাকে প্রসারিত করেছেন আমেনহোটেপ। স্বর্ণ-প্রাচুর্যের দেশ নুবিয়াকেও সফলভাবে দখল করে মিশরকে সমৃদ্ধির চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছিলেন এই ফারাও। তার রাজত্ব শুরুর পর থেকে মিশরীয় প্রজারা স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন-যাপন শুরু করেছিলেন। সৌভাগ্যের প্রতীক গুবরে পোকার আকৃতিতে তৈরী পাথরের উপর তৃতীয় আমেনহোটেপের রাজত্বকালের সাফল্যগাঁথা সবিস্তারে হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে খোদাই করা হয়েছে। রাণী টিয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার পর মিশরের এই সমৃদ্ধি এক অন্য মাত্রা লাভ করেছিলো। মেধাবী, শিক্ষিতা, দূরদর্শী ও যোগ্যতাসম্পন্ন এই রাণীর পরামর্শ এবং ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে মিশর পরিণত হয়েছিলো সে সময়ের বিশ্বের ‘সুপার পাওয়ারে’।
নিজেদের যৌথ শাসনামলে তৃতীয় আমেনহোটেপ এবং টিয়ে প্রায় ২৫০টি বিশাল স্থাপনা নির্মাণ করেছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে অসংখ্য মন্দির, স্মৃতিস্তম্ভ, সমাধিস্থল এবং প্রাসাদ। টিয়ের জন্য বিশেষভাবে তৈরী ‘মালাকাটা প্রাসাদ’-টি ছিলো তৃতীয় আমেনহোটেপের নির্মিত এক অসাধারণ স্থাপনা।
তৃতীয় আমেনহোটেপ ও টিয়ের দাম্পত্য জীবন মিশরীয় রাজ পরিবারের অন্য যে কোনো দম্পতির তুলনায় বিশেষ ছিলো। সমঝোতা ও বুদ্ধিমত্তার এক অতুলনীয় সমন্বয় এই জুটিকে অদ্ভূতভাবে সফলতা ও সমৃদ্ধির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলো। বিদেশী শক্তিগুলোর সাথে মিথস্ক্রিয়া ও সৌহার্দ্যপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে এই দম্পতি যে অসাধারণ দূরদর্শিতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন, তার প্রমাণ আমার্না চিঠিগুলো থেকে পাওয়া গিয়েছে।
ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপ ও রাণী টিয়ের বিয়ে সম্পর্কিত গুবরে পোকার আকৃতির স্মারকগুলো থেকে জানা যায় যে, উভয়েরই অত্যন্ত কম বয়সে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। তবে সম্ভ্রান্ত পরিবারের টিয়ে রাণী হবার জন্য সুযোগ্য ও সুশিক্ষিত হয়েছিলেন। আমেনহোটেপ ফারাও হবার দ্বিতীয় বছরেই টিয়েকে বিয়ে করেছিলেন। জানা যায়, রাণী টিয়ের নিজস্ব লাইব্রেরী ছিলো, যাতে তার পছন্দের বিশাল সংগ্রহ বিদ্যমান ছিলো। রাণী টিয়ের মা-বাবার সমাধি ছিলো তুতেনখামুনের সমাধি আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত সবচেয়ে সুরক্ষিত সমাধি। এই সমাধি আবিষ্কারের সময় তাদের আসল পরিচয় সম্পর্কে জানা ছিলো না প্রত্নতাত্ত্বিকদের।
বিয়ের পরপরই তৃতীয় আমেনহোটেপ স্ত্রী টিয়েকে ‘দ্য গ্রেট রয়্যাল ওয়াইফ’ এর মর্যাদায় সম্মানিত করেছিলেন। স্ত্রী টিয়ের গর্ভে তার মোট ছয় জন সন্তানের জন্ম হয়েছিলো- চার মেয়ে সীতামুন, হেনুত্তানেব, আইসিস ও নেবেতাহ এবং দুই ছেলে থুতমোস ও চতুর্থ আমেনহোটেপ বা আখেনাতেন।
আগেই বলা হয়েছে, আমেনহোটেপের বিশাল হারেম ও অসংখ্য স্ত্রীর মধ্যে টিয়েকে দেয়া হয়েছিলো রাজকীয় প্রধান স্ত্রীর মর্যাদা। তবে এই মর্যাদা ফারাও তাকে নিছক ভালোবাসা থেকেই দিয়ে দেন নি, বরং এমন সম্মান লাভের ক্ষেত্রে যথেষ্ট যোগ্য ছিলেন রাণী টিয়ে। তিনি নিজ যোগ্যতাবলে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবার ও তাতে সংশ্লিষ্টতা লাভের অধিকার অর্জন করে নিয়েছিলেন। প্রাচীন স্মারকগুলোতে কোনো নারীর স্বাক্ষর সে সময়কালের সবচেয়ে ক্ষমতাবান নারীদের পরিচয় বহন করে, যাদের মধ্যে টিয়ে ছিলেন অন্যতম। বৈদেশিক কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষার্থে একজন বিদেশী রাজকুমারীর সাথে স্বামী আমেনহোটেপের বিয়ের স্মারকেও খোদ রাণী টিয়ের নামের অন্তর্ভুক্তি দেখা গিয়েছে, যা সে সময়ের প্রেক্ষাপটে তাকে অত্যন্ত ক্ষমতাবান একজন নারী হিসেবেই চিহ্নিত করে। নারীদের এই ধরনের ক্ষমতায়ন মিশরের রাজপরিবারগুলোতে সে সময় সচরাচর দেখা যেতো না। রাণী টিয়ে নিজের মেধা ও রুচিশীলতা দিয়ে রাজপরিবারে নিজের স্থানকে এভাবেই প্রতিষ্ঠিত ও সুরক্ষিত করেছিলেন।
জানা যায়, পরবর্তীতে আমেনহোটেপ তার দুই মেয়ে সীতামুন এবং আইসিসকেও স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তার এই দুই স্ত্রীর রেকর্ডও পরে আর পাওয়া যায় নি। কিন্তু রাণী টিয়ে তখনও রাজকীয় স্ত্রী হিসেবে বহাল ছিলেন। এমনকি তৃতীয় আমেনহোটেপের মৃত্যুর পরও ছেলে চতুর্থ আমেনহোটেপ যখন আখেনাতেন নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেন, তখনও তিনি রাজকীয় মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আমার্না সমাধিগুলোতে পাওয়া ম্যুরাল থেকে দেখা যায়, রাণী টিয়ে তার নাতনিদের সঙ্গে ভোজ উপভোগ করছেন।
তৃতীয় আমেনহোটেপ আরজাওয়ার একজন, ব্যবিলনের দু জন এবং মিটান্নির দু জন রাজকন্যাকেও বিয়ে করেছিলেন। এমনকি রাণী টিয়ে নিজেই স্বামীকে বেশ কয়েকটি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করিয়েছিলেন। তবু তারা কেউই টিয়ের মতো মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারেন নি। টিয়েই ছিলেন আমেনহোটেপের একমাত্র স্ত্রী, যাকে আনন্দ দেবার জন্য মালাকাটা প্রাসাদের পাশে একটি মানবসৃষ্ট হ্রদ তৈরী করিয়েছিলেন ফারাও।
আমেনহোটেপের শাসনামলে তৈরী শিল্পকর্মগুলো প্রমাণ করে যে, কিভাবে টিয়ের প্রভাব বছরের পর বছর বেড়েই চলেছিলো। রাজকীয় এই দম্পতির ভাস্কর্য দুটিও সমান উচ্চতায় তৈরী করা হয়েছিলো, যা টিয়েকে ফারাও এর সমান মর্যাদাতেই আসীন করে।
আমেনহোটেপ স্ত্রী টিয়েকে সব ধরনের আভ্যন্তরীণ, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক কার্য সম্পাদনে পাশে রাখতেন এবং তার নাম অন্তর্ভুক্ত করতেন। রাজকীয় কার্তুজ সংবলিত বেশ কিছু সীলও পাওয়া গিয়েছে রাণী টিয়ের। আমার্না চিঠিগুলোতে দেখা গিয়েছে, বিদেশী শাসকরাও রাণী টিয়ের নাম উল্লেখ করেছেন এবং তার দক্ষতা ও বুদ্ধিবৃত্তিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই চিঠিগুলো থেকেই প্রমাণ মেলে যে, রাণী টিয়ে বেশ অনেকগুলো বিদেশী ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। মিটান্নির রাজা তুশরাত্তার সাথে আদান-প্রদানকৃত রাণী টিয়ের চিঠিগুলো থেকে বোঝা যায় যে, তিনি আক্কাদীয় ভাষাও জানতেন।
দীর্ঘ ৩৮ বছরের রাজত্বকালে আমেনহোটেপ তিনটি জয়ন্তী উদযাপন করেছিলেন এবং রাণী টিয়ে অধিকারের সাথে এই উদযাপনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই ধরনের উদযাপনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে মিশরের প্রথম নারী ছিলেন রাণী টিয়ে।
রাজত্বকালের ৩০ বছরেরও পরের নির্মিত এই দম্পতির ভাস্কর্যগুলোকে দেখলে আরও বেশি তরুণ মনে হয়। মূলত জয়ন্তী উদযাপনের মাধ্যমে নিজেরদেরকে অলৌকিক পুনঃর্জাগরণ বিশ্বাসের প্রতি ধাবিত করারই এক প্রয়াস ফুটে উঠেছিলো এই নির্মাণগুলোতে।
খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫৩ সালে তৃতীয় আমেনহোটেপের মৃত্যুর পর মিটান্নির তুশরাত্তাসহ বহু বিদেশী শাসকেরা চিঠির মাধ্যমে রাণী টিয়েকে সান্ত্বনা ও আশ্বাসবাণী পাঠিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে, তারা প্রত্যেকেই মিশরের নতুন শাসক অর্থাৎ আখেনাতেন এবং রাণী টিয়ের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।
দেবতা আমুনের প্রতি নিবেদিত আমেনহোটেপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া মন্দিরসহ তার ও তার স্ত্রীর রাজত্বকালের সমস্ত নির্মাণ, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দলিলগুলোতে রাণীর স্বাক্ষর বা তার নামের উপস্থিতি এবং সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজকার্যে রাণী টিয়ের সংশ্লিষ্টতা –এ সব কিছুই মিশরীয় শাসনে রাণী টিয়ের গুরুত্ব এবং এই দম্পতি যুগলের রাজকীয় মর্যাদা ও সফলতাকে চিহ্নিত করবার জন্য যথেষ্ট। সুতরাং এ কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত যে, ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপ এবং তার প্রধান স্ত্রী টিয়ে ছিলেন সমৃদ্ধি ও শৈল্পিক আভিজাত্যের জন্য দায়ী সবচেয়ে সফল মিশরীত দম্পতি।
রেফারেন্স: