তরতর করে বয়ে চলছে এক নৌকা। নৌকায় বসা কয়েকজন বিদেশি । গ্রামের কৌতূহলী লোকজন ঘুরে ঘুরে তাদের দেখছে। সময়টা ১৬ শতকের দ্বিতীয় দশক। নৌকায় বসা কয়েকজন পর্তুগিজ রাজ- প্রতিনিধি। তারা যাচ্ছে বাংলার সুলতান নাসির উদ্দিন শাহের দরবারে। যাত্রীরা দুই দিকের গ্রামের দৃশ্য উপভোগ করছে। তারা দেখতে পেল ধানের পাশাপাশি এসব গ্রামে প্রচুর আখও চাষ হয়। তার মানে প্রচুর চিনি উৎপন্ন হয়। এতো চিনি দিয়ে এরা করে কি? পাউরুটি তো বানায় না এরা। চিনির দামই বা কত? ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিদেশি পর্যটকদের বর্ণনায় ও বাংলা সাহিত্য থেকে জানা যায় সেই সময় বাংলা থেকে প্রচুর চিনি বিদেশে রপ্তানি হতো। এই চিনি ছিল খুব ভালো জাতের। ইতিহাসবিদ মনতাজুর রহমান তরফদার ও সৈয়দ এজাজ হোসেনের গবেষণা হতে জানা যায় – রপ্তানি পণ্যের তালিকায় প্রথম ছিল সূতিবস্ত্র। মসলিনের স্থান তো সবার সেরা ছিলই। এরপরই চিনির স্থান। চীনা কূটনীতিবিদ মাহুয়ানের বর্ণনা থেকে জানা যায় বাংলায় তখন তিন ধরনের চিনি উৎপাদিত হতো।
১) কণা সমষ্টির আকারে চিনি
২) সাদা চিনি
৩) দানা বাঁধা চিনি বা মিসরি।
রপ্তানি পণ্যের শীর্ষে থাকা সুতিবস্ত্র ও চিনির আন্তর্জাতিক মান যেমন ছিল উন্নত তেমনি চাহিদাও ছিল ব্যাপক।
স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণের পর এই চিনি বহির্বিশ্বে রপ্তানি করা হতো। তবে আজ কেন এর উল্টা চিত্র দেখি। আমাদেরকে এখন কেন বাইরের দেশ থেকে চিনি আমদানি করতে হয়? কখনো কখনো আবার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বাজার থেকে চিনি উধাও হয়ে যায়। চড়া দাম দিতে হয় ভোক্তাদের। সরকার বাধ্য হয় প্রতিবেশী দেশের শরণাপন্ন হতে।
বাংলা সাহিত্যেও এই আখ ও আখ মাড়াইয়ের উল্লেখ আছে। বিখ্যাত কবি মুকুন্দরাম তাঁর চন্ডীমন্ডল গ্রন্থে চিনি তৈরির দক্ষ কারিগর গোষ্ঠীকে ‘শিউলি’ জাতির অন্তর্ভুক্ত করেন। এছাড়াও ‘মোদক’ শ্রেণীভুক্ত জনগোষ্ঠী ছিলেন ইক্ষু চাষ ও চিনি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ‘বাঙ্গালির ইতিহাস আদি পর্ব’ গ্রন্থে নীহারঞ্জন রায়ের শ্লোক থেকে গ্রামের বর্ণনা এরূপ – কৃষকের বাড়ি কাটা শালিধান্যে সমৃদ্ধ হইয়া উঠিয়াছে। গোরু বলদ ও ছাগগুলি ঘরে ফিরিয়া আসিয়া নতুন খড় পাইয়া আনন্দিত। অবিরত ইক্ষু যন্ত্রের ধ্বনি মুখর গ্রামগুলি গুড়ের গন্ধে আমোদিত। এছাড়াও বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন কাব্যে যে মিষ্টান্ন ও মিষ্টিজাত খাবারের উল্লেখ আছে তা হতে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, বাঙালির খাদ্য তালিকায় চিনির স্থান ছিল পাকাপোক্ত। বাংলার উৎপাদিত পণ্য ও ফসলের তালিকা উল্লেখ করতে গিয়ে ইতালীয় পর্যটক ভারথেমা বলেন এ দেশের শস্য, সব রকমের মাংস, চিনি, আদা এবং তুলা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় প্রচুর হতো, যা মধ্যযুগে পূর্ব পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল গুলোর পাশাপাশি পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানির প্রক্রিয়াকে গতিশীল করেছিল। এমনকি ১৭৫৬ সালেও শতকরা ৫০ ভাগ হারে চিনি রপ্তানি হতো।
ধীরে ধীরে আমাদের ঐতিহ্য শিল্প সংস্কৃতি থেকে হারানো জিনিসের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে চিনি উৎপাদনের প্রক্রিয়া। বাংলার যে আখ ও আখজাত চিনি সুলভ পণ্যের তালিকাভুক্ত ছিল তা আজ হারাতে বসেছে। দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে চিনি কল গুলো। চেষ্টা ও সদিচ্ছা দ্বারা কি সেই পুরানো ঐতিহ্য আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়?