দৃশ্যপট ১: ২০১৪ সাল। ইংল্যান্ডের লন্ডন। লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক কিম ওয়াগনার নিজের অফিসে বসে কম্পিউটারে তার বর্তমান গবেষণার বিষয়বস্তু ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করছিলেন। ঠিক সেই সময় এক ব্রিটিশ দম্পতির কাছ থেকে একটি ইমেইল আসে। ইমেইলটি পড়ার পর তিনি ভিতরে ভিতরে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠেন। তারা জানিয়েছিলেন, তাদের বাড়িতে একটি মানুষের মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছে। এখানেই শেষ নয়। সেই খুলির সাথে আছে একটি চিঠি। সেই চিঠিটিতে খুলিটি সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা ছিল। কি আশ্চর্যজনক আর লোমহর্ষক ব্যাপার, তাই না! নিজেদের বাড়িতে এইরকম একজন মানুষের খুলি তারা রাখতে চাচ্ছিলেন না। তিনিও আর দেরি না করে তাদের বাড়িতে চলে যান। খুলিটির সাথে রাখা চিঠিটি পরে তিনি জানতে পারেন, খুলিটি ৪৬তম রেজিমেন্টের বেঙ্গল ইনফ্যান্ট্রির হাবিলদার আলম বেগের। ১৮৫৭ সালে সংঘটিত সিপাহি বিদ্রোহে এই সিপাহি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন।। চিঠিটি পড়তে পড়তে তিনি যেন সেইসময়ে চলে গেলেন। সেই ১৮৫৭ সাল।
দৃশ্যপট ২: ১৭৫৭ সাল। ভারতীয় উপমহাদেশ। পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর ইংরেজরা নিজেদের হাতে রাজদণ্ড তুলে নেয়। পুতুল নবাবদের সিংহাসনে বসিয়ে রাজ্য শাসন করেছে এই ইংরেজরা। প্রায় ১০০ বছর এভাবেই এই উপমহাদেশের সম্পদ তারা লুটেপুটে নিয়েছে। মানুষের উপর চালানো হয়েছে অকথ্য নির্যাতন। এতগুলো বছর ইংরেজদের অত্যাচার সহ্য করতে করতে উপমহাদেশের মানুষের মনে ইংরেজদের প্রতি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হতে থাকে। তারই ফল হিসেবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নানা সময়ে বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠে। এই ছোট ছোট বিদ্রোহগুলোই একসময় স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহই ছিল তার পূর্ণাজ্ঞ রূপ। এই বিদ্রোহেরই এক যোদ্ধা হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশের বুকে আবির্ভাব ঘটে আলম বেগের। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ শুরু করেন। সিনেমার মতো ছবিগুলো যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
দৃশ্যপট ৪: ২০১৪ সাল। ওয়াগনার খুলিটি হাতে নিয়ে এক গভীর চিন্তায় ডুবে ছিলেন। চিঠিটি পড়ে তিনি জানতে পারেন আলম বেগের সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য। খুলিটির অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে তিনি বুঝতে পারছিলেন খুলিটি বেশ পুরোনো। হালকা লালচে খয়েরি রঙের খুলিটির চোয়ালের নীচের হারটি এখন আর নেই। চোয়ালের ওপরের পাটির কয়েকটি দাঁত এখন বেশ নড়বড়ে অবস্থায় আছে। কামানের আঘাতে মৃত্যু হয়েছিল বলে খুলিটিতে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। আর ওয়াগনার যদি চিঠির তথ্য সত্যি ধরে নেন, তাহলে এর বয়স হবে প্রায় ২০০ বছরের কাছাকাছি। কিন্তু তবুও তিনি বুঝতে পারছিলেন, শুধুমাত্র একটি চিঠি দিয়ে কিছুই প্রমান করা সম্ভব নয়। তাই তিনি ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম’এ ফরেনসিক পরীক্ষা করতে নিয়ে যান এবং সেই পরীক্ষার রিপোর্টের মাধ্যমেই প্রমান হয়, খুলিটি একজন ভারতীয়ের এবং মৃত্যুর সময় বয়সও ছিল ৩০-এর উপর এবং তার মৃত্যুর সময়কালও উনিশ শতকের মাঝামাঝি।ওয়াগনারের বুঝতে বাকি রইলো না খুলিটি সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম নেতা আলম বেগেরই। ১৯৬৩ সালে প্রথম আলম বেগের খুলিটি “দ্য লর্ড ক্লাইড” নামের একটি পাবে পাওয়া গিয়েছিলো। পরবর্তীতে সেই বৃদ্ধ দম্পতিরা এর মালিক হন। কিন্তু খুলিটি সেই পাবে কি করে গিয়েছিলো, মালিকের সাথে সেই ব্রিটিশ অফিসারের কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা তা আদৌ জানা যায়নি।
কিম ওয়াগনার তার এই বইটিতে আলম বেগের সংগ্রামকে সম্মান করেছেন। সেই ১৮৫৭ সালের ভারতীয় উপমহাদেশের সংগ্রামের ইতিহাসকে তুলে ধরেছে তিনি তার বইতে। কিম ওয়াগনার বলেছেন, প্রায় ২০০ বছর পর আলম বেগের মতো একজন সিপাহীর আত্মার শান্তির জন্য তিনি চেষ্টা করছেন। কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়। ওয়াগনার তার বইতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, সিপাহী বিদ্রোহের পরে তারা যে নদীতীরে লুকিয়ে ছিল, সেখানেই যেন তাকে সমাহিত করা হয়। তাহলে হয়তো আলম বেগ সহ আরও হাজারো সিপাহীর আত্মার শান্তি হবে। লেখকের সেই ইচ্ছা এখনো পূরণ হয়নি। আমরা সকলেই সেই ইচ্ছা পূরণের অপেক্ষায় আছি।